শিশিরের চোখ ভরা বিস্ময়। এসিডে ঝলসে দিয়েছে প্রিয়বোনের মুখটি। চিরচেনা সেই সুন্দর রুপটি আজ সুদূর অতীত। স্বপ্না শিশিরের বড় বোন। ৭ম শ্রেণীতে পড়াকালিন তার বিয়ে হয় হতেয়ার খলীলের সাথে স্বপ্না খুবই মেধাবী ছিল।
পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি ও পেয়েছিল। কিন্তু চেয়ারম্যানের বখাটে ছেলে ফরিদ তার পিছু লাগে। দেয় নানান কুপ্রস্তাব স্কুলে যাওয়া আসার পথে নানান ভাবে ডিস্টাবকরত । ফরিদ ছিল মাদকাসক্ত চেয়ারম্যানের ছেলে বলে কেউ কিছু বলার সাহস করতনা। ফলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয় স্বপ্নার।
তাতেও উৎপাত থামেনি ফরিদের ফলে অল্প বয়সেই বিয়ের পিড়িতেই বসানো হয় স্বপ্নাকে। শিশিরও বুঝত বাল্যবিবাহ আইনগত ভাবেও অবৈধ। নানান দিক থেকেই ক্ষতিকর। কিন্তু তার তেমন কিছুই করার ছিলনা। এ বিয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
খলীল ও তার পরিবারের অমানসিক নির্যাতন চলে স্বপ্নার উপর। যৌতুক হিসেবে মোটর সাইকেল দাবি করে। স্বপ্না তা ভালবাসা নয়। মোটর সাইকেলই মূখ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু শিশিরদের যে সামর্থ্য ও ছিলনা।
এত আদরের ছোট মেয়ের গায়ে আঘাতের নানা চিহৃ রক্তাক্ত দেহ কেউ সহ্য করতে পারেনি। বনিবনা হয়নি, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। যৌতুকের অভিশাপে সুখের স্বপ্ন সৌধ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। স্বপ্নাকে আবার স্কুলে ভর্তি করানো হয়। বাবা সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন।
কিন্তু ফরিদের পাগলামো কমেনি, উৎপাত বেড়েছে। চেয়ারম্যানের কাছে বিচার যায় তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে ফরিদ। একদিন স্বপ্নাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। তারপর ধর্ষন, এসিডে ঝলসে দেয় আজকালকের প্রেম ভালবাসা যেন শরীরই মূখ্য, তাই লালসার শিকারও হয় শরীর। ক্রোধ ক্ষোভ ও রাগের বহিঃপ্রকাশও শরীরেই ঘটে থাকে।
সম্পদ ক্ষমতার জোরে ফরিদের কিছুই হয়নি কিন্তু শিশিরদের সংসারে জ্বলছে দুঃখের আগুন।
স্বপ্নার জীবন নানা বাধা বিপত্তির পরও থেমেনেই গতিপথ পাল্টেছে তবে গতি কমেনি। নিজের উৎসাহেই পুকুরে মাছ চাষ, ছাগল পালন, হাঁস মুরগি পালন শুরু করেছে। পারিবারিক আয়ের এগুলো অন্যতম উৎস। এছাড়া শাক সবজির চাষ ও বৃক্ষ রোপনে তার আগ্রহের কমতিনেই।
ফলে সবুজ শ্যামলে ভরেউঠেছে বাড়ির উঠান ও তার চারপাশ। স্বপ্নার রুপ কেড়ে নিতে পারলেও গুনতো কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। স্বপ্নার অক্লান্ত পরিশ্রমে এসেছে পারিবারিক সচ্ছলতা। সে পরিবারের বোঝা নয়, অভিশাপ নয়, বাড়ধরনের আর্শীবাদ যেন।
শুধু শিশিরের পরিবারে নয় পুরো গ্রামেই এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে।
দেখা যায় না হাডুডু, লুকোচুরি, দাড়িয়াবাদ্ধা, গোল্লাছুট, ডাংগুলি খেলা। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন এগুলোর স্থান দখল করেছে। গভীর নলকূপ বেড়েছে। খাবারের আগে পরে হাতধোয়া, ঘুমানোর আগে ও ঘুম থেকে জেগে দাঁত মাঁজা সহ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যাপারে সকলেই সচেতন।
শিশির এখন নটরডেম কলেজে পড়ে।
ছুটিতে বাড়ী এসে চুপচাপ বসে না থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নানান কাজে। সে ঘুরে ঘুরে অসুস্থ রোগীদের কাছে যায়। মৃত আত্মিয় স্বজনদের কবর জিয়ারত করে তাদের মাগফেরাত কামনা করে। ছোট শিশু কিশোরদের সে একজন প্রিয় মানুষ। তাকে পেলে এ কচিপ্রান মানুষ গুলোর আনন্দের সীমা থাকেনা।
শিশির ও তাদের বড় হবার স্বপ্ন দেখায়। পড়াশুনার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। কাছে টেনে বুকে জরিয়ে চুমু খায়, প্রয়োজনে পরামর্শ দেয়। সমস্যায় জর্জরিতদের সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে উত্তরনে সাধ্যানুযায়ী সাহায্য সহযোগিতা করে। এইতো দুমাস আগে এস এস সিতে এ+ প্রাপ্ত জটিল রোগে আক্রান্ত মাফুজের চিকিৎসার জন্য শিশিরই উদ্যোগী হয়ে কালেকশন করেছে।
পরের কল্যানে তার নিঃস্বার্থ ত্যাগই তাকে অনেকের হৃদয়ের অতি কাছাকাছি করেছে। এখন মাফুজ অনেকটা সুস্থ্য তার দরিদ্র পরিবারের কাছে শিশির এক অসাধারণ মানুষ। এরকম সুন্দর ঘটনাই শিশির ঘটিয়ে থাকে। ছোট ভাই শিশিরকে স্নপ্না প্রানের চেয়েও বেশি ভালবাসে। বুনে নানা স্বপ্নের জাল ।
স্বপ্নার ইচ্ছা শিশিরকে ডাক্তার বানাবে। শিশিরের জন্মের সময় তার মা মারা যায়। তখন স্বপ্নার বয়সও বেশী নয়। গ্রামের মানষের অসচেতনতা তাকে খুবই পীড়া দেয়। এখানে দাইদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস প্রবল ভাবে কাজ করে যেন।
অনেকের সামর্থ্য নেই আবার অনেকে এমনিতেও ডাক্তারের কাছে যেতে চায়না। শুধু স্বপ্নার মা কেন অনেক মা বাচ্চা প্রসবের সময় প্রাণ হারায় অথচ এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। সচেতনতামূলক কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেই। ঝাড়ফুক তাবিজ কবজ, পানি পরা এসব নানান মাধ্যমে চিকিৎসাদানের প্রক্রিয়া আছে। একদিক থেকে গ্রামের অনেক মানুষই দরিদ্র তার পর অশিক্ষিত অসচেতন।
তাই সহযেই কবিরাজ হাতুড়ে ডাক্তারদের প্রতারনার শিকার হচ্ছে। শিশির বঞ্চিত দুঃখী মানুষের পাশে দাড়াবে নিঃস্বার্থসেবা দেবে এতেই মায়ের আত্মা তৃপ্তি পাবে বলে স্বপ্নার বিশ্বাস।
সারা এলাকা জুড়েই রয়েছে শিশিরের সুনাম। চমৎকার আচার ব্যবহার আন্তরিকতার কারনে তার নাম সবার মুখে মুখে। সে এলাকার কিশোর তরুন ছাত্র ছাত্রীদের উদ্বদ্ধ করেছে নিরক্ষরতা দূরীকরনে ভুমিকা রাখতে।
এমন ভাবে তাদের অনুপ্রানিত করেছে যে এলাকার বয়স্ক অনেক স্বাক্ষর জ্ঞানহীন, অশিক্ষিতরাও বাধ্য হচেছ লেখাপড়া শিখতে। কে কত বেশি নিরক্ষরকে স্বাক্ষর জ্ঞান দিতে পারে সেজন্য চলে প্রতিযোগিতা। নাতির পীড়াপীড়িতে অনেক দাদু মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করলেও মনে মনে ঠিকিই নাতিকে ভালবাসে, নাতিও আনন্দ পায়। সবার প্রিয় শিশিরের এ জনপ্রিয়তা অসহ্য রাকিবের। রাকিব শিশিরের চাচাত ভাই।
ভিডিও সেমস্ গান বাজনা, খেলাধুলা, গল্পগুজব ও আড্ডা তার পছন্দ গভীর রাত পর্যন্ত জেগে মোবাইলে মেয়েদের সাথে আলাপ করে ফলে তার বাবা মাও তার উপর ভীষণ অসস্তুষ্ট। বয়সে শিশিরের দুই বছরের বড় সে। অথচ এসএসসি দুবার পরীক্ষা দিয়ে এবার পাশ করেছে। সে যাদের সাথে মেশে এলাকায় তারা অধিকাংশই বখাটে ছেলে হিসেবে পরিচিত। তাদের দুষ্টুমির কোন অন্ত নেই জীবন ও জগৎ ভভিষ্যৎ ও বাস্তবাতা সর্ম্পকে চরম উদাসিন রাকিব।
আনন্দ উল্লাসের মধ্যেই তার চিন্তা ধারা সীমাবদ্ধ
শিশিরের চাচা মাঝে মাঝে তার ছেলেকে বুঝায়ে মেয়ে শিশিরের উদাহারণ দেন, রাগারাগি করেন। একদিন শিশির রাকিবকে উপদেশ দিতে গেলে সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বয়সে ছোট হয়েও তাকে জ্ঞান দেবে এলজ্জা তার ক্রোধ বারায় টায়, করে গাল কষে একটা চরমেরে বসে। ব্যর্থ হয়ে শিশির কষ্টে ভারাক্রান্ত মনে ফিরে আসে।
শিশিরের ভাবনা যেখানে গোটা জগৎ ব্যাপি বিস্তৃতি রাকিবের চিন্তা ভাবনা স্বপ্ন, আশা অত্যন্ত সংকীর্ণ পরিসরেই সীমাবদ্ধ।
নিজেকে নিয়েও তার সুনিদিষ্ট পরিকল্পনা নেই। উদ্দেশ্য বিহীন ছুটে চলা। শিশিরের জগত বিরাট কিন্তু রাকিবের জগৎটাই অত্যন্ত ক্ষুদ্র বয়সে চেহারায়, শারীরিক শক্তি বংশ মর্যাদা। অর্থ সম্পদে দুজন প্রায় সমান হলেও জ্ঞান শিক্ষা আচরণ ও চিন্তাধারাই ব্যবধান সৃষ্টি করেছে তাদের মাঝে, শিশির জীবন সংগ্রামে বিজয়ীর বেশে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আর রাকিব পিছিয়ে পড়েছে।
একই আলো বাতাসে বেড়ে উঠলেও দুজন যেন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা গুন বা বৈশিষ্টে একজন আরেকজনের সম্পূর্ণ বিপরীত। একজন অনেক মানুষকে পথ দেখাচ্ছে আরেকজন নিজেই পথ খুজে না পেয়ে দিশেহারা।
স্বপ্না অনেক সময় শিশিরকে নিয়ে আতংকিত হয়ে পড়ে। না জানি তার সাফল্য ও সম্ভাবনা দেখে কেউ ঈর্ষাকাতর হয়ে অপ্রত্যাশিত ক্ষতি করে বসে। তাই সে শিশিরকে এলাকায় কম আসতে পরামর্শদেয়।
কিন্তু মাটি ও মানুষের টানে নাড়ির টানে সে ঠিকই ছুটে পেলেই বাড়ীতে চলে আসে তার কোন ভয় নেই নেই দ্বিধা সংকোচ। উদার আকাশের মত বিশাল মনটা তাকে ঘরে বসে থাকতে দেয়না। বোনের বাধা সতর্কবাণী উপেক্ষা করে সে ছুটে চলে। সবাই তর আপন পরের মুখে হাসি দেখেই তার আনন্দ।
টিউশনী করেই শিশির নিজের খরচ চালায়।
ঐঝঈ তে গোল্ডেন এ + পেয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়। স্বপ্নার স্বপ্ন পূরন হবার পথে। ধ্বংসাতর্ক ছ্াত্র রাজনীতি সে পছন্দ করেনা। সে এলাকার প্রতিষ্ঠিত লোকজনের সহযোগিতায় লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা নেয়। সুযোগ পেলেই সে গ্রামে চলে যায়।
শহরের ব্যস্ত ও যান্ত্রিক জীবনের বাইরে গ্রামীন সহজ সরল মানুষ ও সবুজ শ্যামল প্রকৃতি বার বার তাকে কাছে টানে। সে এলাকায় মানুষের নয়নমনি, প্রাণের ধন তাকে নিয়ে কত আলোচনা সবার সে মধ্যমনি, শিশির শুধু নিজের নয়, পরিবারের নয়, সে যেন সবার। মাতৃহারানোর বেদনা সুন্দর চেহারা এসিডে দ্বগ্ধ হয়ে বিকৃত হওয়ার দুঃখ, পড়াশুনা ছেড়ে দেয়া, অল্প বয়সে সংসারী হয়ে সংসার ভাঙ্গার কষ্ট সব যন্ত্রনা ভূলে স্বপ্না শিশিরকে পেয়ে। স্বপ্নার স্বপ্নের জগতে অনেক মানব সন্তানের বসবাস। যারা দুঃখী, বঞ্চিত।
সমৃদ্ধ দেশ ও উন্নত জাতি গঠনে শিশির ভূমিকা রাখবে এ প্রত্যাশা স্বপ্নার, শিশিরের স্বপ্ন মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে মানব সেবার মহৎ কাজে নিজেকে সদা ব্যস্ত রাখা। স্বপ্না এক সুন্দর ভবিষ্যতের, এক সুন্দর আগামীর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।