আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিছক একটি গল্প

শারদশশীর অনন্ত অপেক্ষায় তোর চোখের সবুজ রঙ আকাশনীল হয়ে গেলে ঠিক ধরে নিস আমি হারিয়ে গেছি ঘাসেদের দলে...
ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল কোন এক নভেম্বরে, এক শীতের বিকেলে। শীত তেমন জাকিয়ে বসেনি, আকাশে তখনো সুর্য্য ছিল, তবে তার ছিল না কোন উষ্ণতা। বাতাসে কিসের যেন সুবাস, চমকে ফিরে তাকিয়েছিল স্মরণ। ভেজা পথে কোথা থেকে যেন নেমে এসেছিল স্বর্গের অপ্সরী। শাদা সালোয়ার কামিজ পরিহিতা মেয়েটিকে অন্তত স্মরণের কাছে তাই মনে হয়েছিল।

অপ্সরী ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি একজোড়া চোখ তার পিছু নিয়েছে। শুধু কি তাই? মনে মনে কী অপ্সরীকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন স্মরণকে নাড়া দেয়নি? তার পিছু পিছু স্মরণ গিয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরীতে, জীবনে প্রথম বার! পুরোটা সময় বইয়ের পাতায় মগ্ন অপ্সরীকে নিজের অস্তিত্বের খুব কাছাকাছি অনুভব করতে চেয়েছে স্মরণ, কতটা সফল হয়েছে নিজেও জানেনা। অপ্সরীকে দেখে মুগ্ধ হওয়া যদি সে অনুভবের কাছাকাছি কিছু হয়, তাহলে অন্য কথা। তারপর কি হল? অপ্সরী যখন লাইব্রেরী থেকে বের হল তখন সন্ধ্যা। স্মরণও মন্ত্রমুগ্ধের মত বের হল সামান্য কিছুক্ষণ পর, কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে, সন্ধ্যার আলো আধারীতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে তার অপ্সরী।

অপ্সরীর সাথে যে আবার দেখা হবে, একথা ভুলেও কল্পনা করেনি স্মরণ। আবার যখন দেখা হল, একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল সে। আনন্দের যে হিল্লোল তার মধ্যে বইছিল, তা সামলাতে একটু অবশ্য বেগ পেতে হয়েছিল, পাছে কেউ না আবার দেখে ফেলে! দ্বিতীয়বার ওদের দেখা হয়েছিল একটা পার্কে। একা একাই হাটছিল অপ্সরী, পার্কের সবাইকে অনেকটা অগ্রাহ্য করে। স্মরণ ভেবেছিল, ঠিকই আছে।

যে সুন্দরী মেয়ে, তার ওরকম না করলে চলে না। কত হবে মেয়েটার বয়স? ১৮-১৯? হয়ত। অপ্সরী হাটছিল পাতাঝরা পথে। আর তাকে অনুসরণ করে চলছিল স্মরণের দৃষ্টি। এভাবে কতক্ষণ? অবশেষ মায়াগ্রস্থ স্মরণ আবিষ্কার করল অপ্সরী নেই, চলে গেছে।

সেদিনের পর থেকে স্মরণের রাতের ঘুম চুলোয় গেল, নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাদিন কী যেন ভাবত। ঘুমালে স্বপ্নে এসেও হানা দিত অপ্সরী, নতুন নতুন প্রেমে পড়লে যা হয় আর কি! স্মরণ কায়মনবাক্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিল, ওদের যেন আবার দেখা হয়। ঈশ্বর তার সে প্রার্থনা রেখেছিলেন। সদ্য কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে স্মরণ আবিষ্কার করল, অপ্সরী তার সেকশনেই পড়ে। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! রক্ত ছলকে উঠেছিল স্মরণের বুকে।

এত কাছে সে, অথচ সে তার অপ্সরীকে চাইলেই ছুতে পারেনা। ততদিনে ভালবাসা নামক ভাইরাস স্মরণের মনে আস্তানা করে নিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। নাম তার রিশিতা। কল্পনাতে অনেক ছবি আকে স্মরণ। সে ছবি ভালবাসার, বিশ্বাসের।

রিশিতা তার কল্পনাতে ঘুরে বেড়ায়। বাস্তবে ঠিক তার উলটো, ক্লাসের এক কোণে চুপ করে পড়ে থাকে রিশিতা, কারো সাথে তেমন মেশে না, কথা বলে না। ক্লাস শেষ হলে আপনমনে বাড়ী ফেরে। অনেক চেষ্টা করেও স্মরণ তার নজর কাড়তে পারেনা, অথবা রিশিতাই হয়ত বুঝতে দিতে চায়না। এভাবে দিন যায়, স্মরণ সাহসী হয়ে উঠতে থাকে।

স্মরণ ভালবাসে আড্ডা আর বেহিসেবী চলাফেরা, অন্যদিকে রিশিতার সঙ্গী বই আর নিস্তব্ধতা। রিশিতার জন্য স্মরণ মেনে নেয় নিস্তব্ধতাকে, অনেকটা বেরিয়ে আসে বেহিসেবী জীবন থেকে। মাঝে মাঝে স্মরণের সন্দেহ হয়, রিশিতা কি আদৌ কথা বলতে পারে? কাউকে কখনো রিশিতার সাথে কথা বলতে দেখেনি সে। কৌতুহল মেটাতে একদিন টিফিন ব্রেকে রিশিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তুমি কি কথা বলতে পারো?” রিশিতা হাসে। ভাঙ্গা কাচের মত রিনিঝিনি শব্দে না, প্রায় নিঃশব্দে।

স্মরণ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়! এ হাসির অর্থ কী? সেদিন ক্লাসের পরে রিশিতা স্মরণকে ডেকে বলে- “হ্যা আমি কথা বলতে পারি। আরো অনেক কিছুই পারি। তুমি যদি সেসব জানতে চাও, তবে আজ বিকেলে সেন্ট্রাল পার্কে এস”। হেসে হেসে বলে রিশিতা, বলে চলে যায়। সেই নিশঃব্দ অথচ গতিময় পদক্ষেপ।

স্মরণ যেন দম ফেলতেও ভুলে যায়। কতদিন ধরে এই একটা সুযোগের জন্য অপেক্ষা করেছে সে! আজ একটা কিছু করতেই হবে, সুযোগ যখন নিজেই এসে কড়া নাড়ছে। স্বভাব বশঃত কিছুটা দেরি করেই পার্কে ঢোকে স্মরণ। রিশিতা আগেই অপেক্ষা করছিল তার জন্য। “ইউ আর লেইট!” কপট অভিমানে বলে রিশিতা।

ওরা হাটতে থাকে পাশাপাশি। “আমাকে তুমি ফলো কর কেন?” রিশিতা সরাসরি জিজ্ঞেস করে। স্মরণ নার্ভাস হয়ে যায়, যে কথা গুলো বলবে বলে তৈরী হয়ে এসেছিল, সেগুলো আদৌ বলা হবে তো? স্মরণ কে নার্ভাস দেখে রিশিতা আবার বলে “ইতস্তত করার তো কিছু নেই। আমি জানি কেন কর, তবুও তোমার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই”। এবার স্মরণ স্বস্তির নিঃশাস ফেলে, মনে মনে কথা গুলো একটু গুছিয়ে নেয়।

তারপর স্মরণ বলতে থাকে, অনেক অনেক কথা, এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা সব কথা। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে, সুর্য্যটা দিগন্তে মুখ লুকোয়, তবুও ওদের কথা শেষ হতে চায় না। রিশিতা বাড়াবাড়ী রকমের একগুয়ে মেয়ে। একটা কথা বললে সেটা হতেই হবে। ওদের দেখা করার সময় যদি বিকেল চারটায় হয়, পাচ মিনিট দেরি করলেই সেদিনের মত ডেট মাটি, রিশিতা বাড়ীর পথ ধরবে।

রিশিতার এরকম স্বভাব স্মরণকে অনেকটা বদলে দিয়েছে। এখন আর স্মরণের দেরি হয়না। বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান বলে যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে রিশিতা। অবশ্য রিশিতার নিজের জগত বলতে ওর নিজের ঘর আর শেলফ ভর্তি বই, ছোটবেলা থেকেই বইয়ের পোকা সে। কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, অ্যাডভেঞ্চার কোন কিছুতেই অরুচি নেই।

স্মরণ যদি ওকে কিছু গিফট দেয়, সেটা যেন অতি অবশ্যই বই হয়, সেকথা রিশিতা আগেই জানিয়ে রেখেছে। স্মরণও এর অন্যথা করেনা। ভালোই চলছিল স্মরণ-রিশিতার দিন গুলো। অবশ্য কেউই জানত না যে ওদের মধ্যে কোন ধরণের সম্পর্ক আছে। দেখা করত লুকিয়ে।

কখনোই কারো কাছে নিজেদের সম্পর্কের ব্যপারে বলত না ওরা। এমনকি স্মরণের খুব কাছের বন্ধুরাও জানত না এ কথা। এরই মধ্যে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল। ক্লাস শেষে রিশিতারই এক বান্ধবী ত্বিশা স্মরণকে প্রপোজ করে বসল! তখন রিশিতার চেহারা হয়েছিল দেখার মত! যাহোক, স্মরণ কিন্তু খুব বিনয়ের সাথেই ত্বিশার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন বিকেলে রিশিতা আর স্মরণ বসে ছিল ফাস্টফুড কর্ণারে।

রিশিতার মুখ তখনো থমথমে। “ত্বিশা কিভাবে পারল?” অস্ফুট স্বরে বলল সে। “আরে বাদ দাও তো, যা হবার তাতো হয়েই গেছে। এসব নিয়ে ভেবোনা” স্মরণ সান্তনা দেবার ভঙ্গিতে বলে। “আমার স্মরণকে কেড়ে নিতে চায়! ওকে খুন করে ফেলতে পারলে শান্তি পেতাম!” দাতে দাত পিষে বিড়বিড় করে রিশিতা।

কথাটা অবশ্য স্মরণের কানে যায় না। ওরা প্রায় ভুলতে বসেছিল ঘটনাটা, কিন্তু তিন দিনের মাথায় ভয়াবহ একটা ঘটনা ঘটল, ত্বিশাকে কে যেন খুন করল! ক্লাসের সবাই মিলে ত্বিশার বাসায় গেল ওরা। সবাই বলাবলি করছিল, যতদূর জানি মেয়েটা ভালো ছিল, খুব ভদ্র। কারো সাথে কোন শত্রুতা ছিল তাও শুনিনি। কে ওকে খুন করল? রিশিতা বসে ছিল ত্বিশা’র মা’র পাশে।

ভদ্রমহিলা অঝোরে কাদছিলেন। কিন্তু রিশিতার মুখে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলা করছিল। স্মরণের নজর এড়ায় না সেটা। হঠাৎই এক অজানা আশঙ্কায় চমকে ওঠে স্মরণ। রিশিতাকে একটু নির্জনে ডেকে নেয়।

“তোমার বান্ধবী কে কারা যেন খুন করেছে, তাতে তুমি এত খুশি কেন রিশিতা?” ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে স্মরণ। রিশিতার চোখের তারা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ঠোটে আঙ্গুল চেপে বলে “শসসস! আস্তে আস্তে! কেউ শুনে ফেলবে তো!” অপ্রকৃতিস্থের মত হাসে রিশিতা। “ত্বিশা কে আমি খুন করেছি, হ্যা, আমিই!” স্মরণ হঠাৎ যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। ও কল্পনাও করতে পারেনি রিশিতার দ্বারা এটা করা সম্ভব।

স্মরণ কে চুপ করে থাকতে দেখে রিশিতা আবার বলতে শুরু করে “ভাবছ, কিভাবে করলাম, তাইতো? গতকাল রাতে আমি ত্বিশাদের বাসায় এসেছিলাম। কেউ জানতে পারেনি, শুধু ও ছাড়া। ওকে বলেছিলাম রাতে অনেক ফান হবে... ফান! ওর গলায় যখন অ্যান্টিকাটার দিয়ে পোচ দিলাম, রক্তে আমার হাত ভিজে গিয়েছিল... অনেক রক্ত... আর বলবি আমার স্মরণের নাম ওই মুখে...?” রিশিতা দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পরে। স্মরণ অনেক কষ্টে শুধু বলে, “তুমি একটা সাইকো!” রিশিতা মুখ ঢেকে অঝোরে কাদতে থাকে। স্মরণের মনে হয়, সব কিছু ভয়ানক স্যাতসেতে হয়ে যাচ্ছে...ভয়ানক স্যাতসেতে।

সামনে বসে থাকা রিশিতাকে তার খুব অচেনা মনে হয়... নাহ, গল্পটা কি একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে? ভাবি আমি। কিভাবে একটু নতুনত্ব দেয়া যায়? কাহিনীতে মোড় সৃষ্টি করা যায়? এই কাহিনীতে নতুন কিছু দেয়ার সুযোগ কি আছে? আমি কি সেগুলো দেখছি, না আমার চোখের আড়ালেই থেকে যাচ্ছে? ভাবতে থাকি আমি, ভেবে ভেবে কোন কুল-কিনারা পাই না, কোন সিদ্ধান্তেও আসতে পারিনা। ল্যাপটপ বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। বিকেল শেষ হয়ে এল প্রায়। আকাশে অনেক মেঘ।

হয়ত এখুনি বৃষ্টি নামবে। কফির তেষ্টা পেয়ে বসেছে। কিচেন থেকে এক কাপ ধোয়া ওঠা গরম কফি নিয়ে আমি স্টাডির বারান্দায় এসে দাড়াই। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আমি জানি, গল্পটা আর লেখা হবে না।

প্রায়ই এরকম হয় আমার, গল্প গুলো কেন যেন শেষ করতে পারিনা। গল্পটা কাগজে লেখা হলে ভাল হত, কাগজ গুলো ছিড়ে উড়িয়ে দিতে পারতাম। বৃষ্টি জলে ধুয়ে যেত এক একটা অক্ষর, আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। হয়ত একটু কষ্টও পেতাম, নাকি এক ধরণের আত্বতৃপ্তি পেয়ে বসত আমায়? বিশ্ব ভালবাসা দিবস উপলক্ষে স্বপ্নজয় ভাইয়া কর্তৃক প্রকাশিত পিডিএফ "ভালবাসি" এবং একুশের বইমেলায় প্রকাশিত ব্লগারদের গল্প সংকলন "অফলাইন" এ পূর্ব প্রকাশিত।
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।