#
আবাহনী-মোহামেডান এর মারদাঙ্গা লড়াই চলছে। এক দলের বাহাদুর খেলোয়াড় রক্ষণাত্মক ভঙ্গীতে আরেকদলের খেলোয়ারকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছে। একটা শুভ লক্ষণ দেখা দিল। পড়ে থাকা খেলোয়ারটি এমনভাবে পড়ে থাকলো যেন সে কোমায় চলে গেছে। দুই দলের সকল খেলোয়ার, কোচ, ম্যানেজার সবাই একে একে মাঠে চলে আসছেন।
হাতাহাতি শুরু হল। যে খেলোয়ারটি কোমায় চলে গিয়েছিল সেও উঠে দাঁড়িয়ে যোগ দিয়েছে, যেন এতক্ষণ তারা যা খেলছিল তা হচ্ছে হাতাহাতি, আর মাঝে মাঝে ফুটবল। রেফারীগণ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন। কাকে কোন কার্ড দেখালে কি হবে তা ভাবার চিন্তা করছেন। অবস্থা বেগতিক দেখলে দৌড় দেবেন, কেন না বেড়ালের রাগ চিনির বস্তার উপর! টেলিভিশনে লেখা উঠল “ অনিবার্য কারণ বশতঃ প্রচারে বিঘœ ঘটায় আমরা দুঃখিত”..
খেলা শেষ।
পরাজিত দলের গোলরক্ষক কানন একটা চেয়ার তুলে রেফারীকে তাড়া করে ফিরছেন, রেফারী তাড়া খেয়ে সারা মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছেন। ফুটবলের জায়গায় গোল্লাছুট। বেচারা। কেউ এগিয়ে আসছে না। হঠাত টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে উঠল “ বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে প্রচারে বিঘœ ঘটায় আমরা দুঃখিত”
সপ্তাহের পুর্ণর্দৈঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখতে বসেছি।
হঠাত পর্দা পড়ে গেল। এখনকার জেনারেশন সেই পর্দা কখনো দেখেছে কি? বাংলার অগণিত মানুষকে গ্রাফিকস্ শেখানোর পর্দা..প্রথমে বড় বড় দাগ..তারপর ছোট ছোট দাগ... আমরা অধীর আগ্রহে দাগগুলো গুনতে থাকতাম.. দাগ গোনা শেষ হলেই বুঝি পর্দা চলে যাবে.. গোনা শেষ হলে আবার গুনতাম.. আর কান ফাটানো সুপারসনিক বিশ্রী শব্দ ” টি-ই-ই-ই” তো থেকেই যেত।
প্রিয় সম্পাদক তুষার আব্দুল্লাহ, আমার শৈশবে এই ছিল সম্প্রচারের ভাষা...
#
বিটিভিতে আশির্বাদের আলো হয়ে আসলো কিছু ভারতীয় সিরিয়াল...“দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান”, “আলিফ লায়লা”.. কয়েকশ’ বিজ্ঞাপনের মাঝে কয়েক মিনিটের ভন্ডামী। আমি ভারতে বেশ কয়েক বছর বসবাস করেছি। সেখানে কেউ এইসব সিরিয়ালে ব্যবহহ্ত ভাষা যেমন,“আম্মিজান..আব্বা হুজুর..” আর হিন্দী-আরবী মিশিয়ে অদ্ভূত বাংলা কেউ বলে না।
প্রচন্ড জনপ্রিয়তা সেই অপ-ভাষাকে লুফে নিল।
নবাব হায়দার আলী বাসর রাতে তার নব পরিণিতা স্ত্রীকে বলছেন, “ আমি কি আপনার কাছে একটা সন্তান পেতে পারি?”
#
আমাদের দেশে যখন ডিশ-অ্যান্টেনা নামক একটি উল্টো ছাতা সদৃশ যন্ত্র উঠতে থাকলো দালানগুলোর ছাদে তখন আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের সংস্কৃতি ডুবে যাওয়ার আশংকা দেখা দিল। ভারতীয় চ্যানেলগুলো তখন পৌঁছে গেছে আমাদের ঘরে ঘরে। তখনও বাংলাদেশের কোন স্যাটেলাইট চ্যানেল নেই। প্রাগৈতিহাসিক বোকাবাক্স বিটিভি তখনও মানুষের হা হুতাশ এর জায়গা।
এইতো তারও কিছুদিন আগে আমরা আমাদের বাড়ির টিভি-অ্যান্টেনার বাঁশ লম্বা..আরো লম্বা বাঁশে রিপ্লেস করে সেই বাঁশ ঘুরিযে ঘুরিয়ে ভারতের দিকে মাথা ঘোরাতাম.. শনি /রবিবারে ওদের ছবি দেখার জন্য.. ভাগ্য ভাল থাকলে মৌমাছির চাকের মত ঝিরঝির করতে করতে ভেসে আসতো হিন্দি ছবি.. অথবা ভি.সি.আর. এ .. গানের ক্যাসেটে আমরা জীবনটাকে হিন্দী-আমোদে ভরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম । এইসব ঝিরিঝিরি শুন্যতায় এক গামলা বিনোদন পেয়ে বাঙ্গালীর খুশী দেখে কে! নিজেরা আস্ত একটা ডিশ অ্যান্টেনার মালিক না হয়েও শুধু ক্যাবল লাইনের কানেকশন দিয়ে মাসে কয়েক শো টাকায় আমাদের সামনে হাজির হল “ডিশ-দেবতা”। ইংরেজী চ্যানেলগুলোও তখন ভরপেট গিলতে শুরু করেছি।
#
তারপর একদিন হিন্দী চ্যানেল এটিএন এ কয়েক ঘন্টা করে বাংলাদেশের মারদাঙ্গা ছবির গান শুরু হল, এভাবে দেখতে দেখতে একদিন এটিএন পুরোপুরি এ দেশের। শুরু থেকেই রুচি‘র যে অভাব এই চ্যানেলটির পর্দায় দেখা দিয়েছিল তা তারা আজও উতরাতে পারেনি।
এরপরতো একে একে অনেক চ্যানেল। সারাদিন বিজ্ঞাপনের মাঝে দুই এক ঝলক অনুষ্ঠান বিরতি আর সঞ্চালকদের মিষ্টি হাসি সমৃদ্ধ,“ (পৃথিবী জাহান্নামে যাক) আমাদের সঙ্গেই থাকুন”
#
এরপর সংবিধিবদ্ধ অনুকরণ। ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য ষ্টাইল। বাংলা ইংরেজী মিশিয়ে কথা বলার অভ্যেসটা আমাদের আগে থেকেই ছিল.. কিন্তু চ্যানেলগুলোর কল্যাণে আর বিশেষ করে এফএম রেডিওগুলো.. এই দেশের সর্বোচ্চ ট্যাক্সদাতা - স্বাধীনতার ধারকবাহক - মা-বাবার প্রতি সন্তানের ভালবাসার একমাত্র নিয়ামক - কিছু মোবাইল ফোন অপারেটর এর পৃষ্ঠপোষকতায় সম্প্রচারের ভাষাকে বদলে দিল এইভাবে,
“ কি হইছ্ছে তোমার? ব্যাথ্থা পাইছ্ছো? কোন গান শুনবা? কি বোল্লা? আমাক্কে সুইট লাগতাছ্ছে? ডিয়ার লিসনার, চলো শুনি অমুকের গান”
আমাদের সম্প্রচারের ভাষা তখন মোবাইল ফোনে কন্টেন্ট হয়ে ব্লু টুথ হয়ে গেছে।
#
একটা সময় ছিল।
টিভি পর্দায় নাটকে আঞ্চলিক ভাষা মানেই ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অথবা হাওড় অঞ্চলের ভাষা। তাও আবার হুমায়ুন আহমেদ এর কল্যাণে। মাঝে মাঝে কিছু নাটকে পুরোনো ঢাকার কুট্টিদের ভাষাও দেখা যেত।
স্বাভাবিকভাবেই ওই ভাষাগুলোর সাথে দেশের বেশিরভাগ মানুষ কমিউনিকেট করতে পারতো না। হুমায়ুন সাহেবের অসম্ভব সহজ রসিকতা তখন আমাদের বিনোদন-উপজীব্য।
যতটুকু জানি জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কথ্য ভাষা ব্যবহার করতেন। তারপর তার শিষ্য আহমদ ছফা। ছফা তার জীবিতকালে কিছু শিষ্য-সামন্ত রেখে যান যারা বাংলা-ভাষা‘র গোষ্ঠি উদ্ধারকে নিজেদের দাঁড়াবার ষ্ট্যান্ট হিসাবে ধরে নেন।
তৎকালীন মঈন চৌধুরী সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন “প্রান্ত” এ এইসব শিষ্যরা অতিমাত্রায় স্ল্যাঙগ আর উল্টো-পাল্টা ভাষা ব্যবহার করে বাংলা শিল্প-সাহিত্যে নিজেদের ব্রাম্মণ হিসাবে দাঁড় করানোর পায়তারা করেন। মিডিয়ার বিরুদ্ধে “এন্টি-এষ্টাবলিষ্টমেন্ট” এর পে তারা প্রচুর গলাবাজি করেন।
আর পরবর্তীতে টুপ করে ঢুকে পড়েন মিডিয়ায়। পরবর্তিতে প্রকাশিত হয় যে এরা আসলে লিটল ম্যাগাজিনকে শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন।
এদের একজন কবিতা লেখেন এইভাবে ,
“ সেই ফ্ল্যাটে বাওয়া ব্যাঙে কোরছে চো * চু *”
আর এ হেন ভাষা চর্চাকে তারা তকমা লাগালেন “পোষ্ট-মর্ডান” এবং তারও পরে “সিউডো-পোষ্ট মর্ডান” বলে...
এদের মধ্যে সবচেয়ে আগে মিডিয়াতে যোগ দেওয়া কবিটি যিনি কি না ততকালীন একটি দৈনিকে “রাজনৈতিক স্যাটায়ার” লিখে বিশেষ পরিচিতি অর্জন করে ফেললেন, পরবর্তীতে বর্তমানে সর্বাধিক জনপ্রিয় দৈনিকে তার অবস্থান দৃঢ় হওয়ায় তার জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকলো। মজার বিষয় হচ্ছে এই দৈনিকটি স্বল্প সময়ে এমন একটি অবস্থানে চলে আসলো যে তারা যাই প্রেসক্রাইবড্ করতে থাকলো তাই সত্য বলে ধার্য হল। খবরের কাগজের প্রতি পাঠকের এত অগাধ বিশ্বাস এর আগে এদেশে তেমন একটা দেখা যায়নি।
যাই হোক ওই কাগজের প্রপাগান্ডার কল্যাণেই হোক আর নিজস্ব নৈপূণ্যে কাগজটির মতই অতি স্বল্প সময়ে দেশের একজন জনপ্রিয় লেখকের কাতারে পৌঁছে যান তিনি। বিনিময়ে আমরা কিছু রিপোর্টধর্মী প্রামাণ্য উপন্যাস পাই। এরপর দু‘একটা নাটক। বেশিরভাগই স্যাটায়ার।
এরপর যা ঘটল তা হচ্ছে এই, হঠাত করে আমরা একটা চ্যানেলে অদ্ভূত একটা নাটক অথবা টেলিফিল্ম দেখতে পাই, সেখানে বুয়েটের একজন ছাত্র একজন বিবাহিতা সিনিয়র বুয়েট-শিকিার প্রেমে পড়েছে, নাটকে ভাষা-ব্যবহার চটুল।
ম্যাডামের স্বামী প্রবাসে থাকেন। উপজীব্য ছাত্র-শিকিার পরকীয়া। নাটকটি সম্প্রচারিত হওয়ার পর সারা পড়ে গেল,“হেবভী হইছে!”। আমারও অনেক ভাল লাগলো। আমাদের দেশে সম্প্রচারের ভাষায় “চড়–ইভাতি” ছিল আরেকটি বড় আঘাত।
এরপর থেকে তার সাথে জুটি বেঁধে সদ্য আজিজ-ফেরত একজন নির্মাতার হাতে সেই ভাষার জম্পেশ ব্যবহার আমরা সাদরে গ্রহণ করলাম। রক্ষনাত্মক ইরানী চলচ্চিত্র থেকে ভালটুকু গ্রহণ না করে এরা যা গ্রহণ করলেন তার সাথে সেল্ফ ইম্প্রোভাইজেশন এর জগাখিচুড়ি টিভি-নাটকের কমন ফরমেটকে ভেঙ্গে আমাদের আশাবাদী করল ঠিকই কিন্তু সেই একই ষ্টাইল- একই কুপমন্ডকতা আমাদের আবার দমিয়ে দিল। সেই নির্মাতা আরেকটি ভাল কাজ করলেন। নেশাগ্রস্ত কিছু উচ্চাভিলাষী তরুণকে রাস্তা থেকে তুলে এনে ডিরেক্টর বানিয়ে দিলেন। দেখা গেল, তার গ্রুপ এর সবাই ডিরেক্টর।
সবাই একই রকম “মাল” বানায়। দর্শকরা আবারও ব্ল্যাক মেইলড্ । কারণ “যা কিছু ভালো” - কাগজটি অথবা টিভি চ্যানেলগুলো যারা আসলে প্রকৃত মিডিয়ার চরিত্রকে আঁকড়ে ধরে হলুদ হয়ে গেছে তারা রীতিমত হাইব তৈরী করে অখাদ্যগুলোর ব্যাপক কাভারেজ দিতে থাকলো। আমরা ছোটবেলায় যেমন বিটিভির কাছে জিম্মী ছিলাম, এই বড়বেলায় এসে বেশ কয়েকটি চ্যানেলের কাছে জিম্মী হয়ে গেলাম। আমরা গিলতে বাধ্য।
কিন্তু এভাবে গিলতে থাকলে একসময় বের হয়ে আসার কথা, তা সে যেখান থেকেই হোক না কেন, কিন্তু এই মিডিয়াগুলো নিজেদের মত করে গল্প ফাঁদতে থাকলো। এই নির্মাতার প্রথম ২টি চলচ্চিত্র আমার জানামতে পৃথিবীর কোন চলচ্চিত্র উতসবেই প্রদর্শনের যোগ্যতা রাখেনি, যাও বা দু‘একটা জায়গায় দেখানো হয়েছে তা অনেকটাই প্রবাসী বাঙ্গালীদের নিজস্ব আয়োজনে। আসলে আমাদের মিডিয়ার দৌড়তো আমাদের মাঝেই। আমাদের মিডিয়ায় সাফাই গেয়ে তো আর বিদেশীদের হার্টথ্রব হওয়া যায় না! প্রথম ২টি নাটক সেলুলয়েডের ফিতায় চলচ্চিত্র না হয়ে ওঠায় ৩য় নাটকের প্রচারণায় তারা লিখলেন “ইহা আর্ট নয় হার্ট ফিল্ম” তাও আর্ট এর উপরে একটা লাল ক্রস। আমরা সবাই বিষয়টাকে কত আনন্দের সাথে গ্রহণ করলাম।
নিজের মাকে যদি কেউ বেশ্যা বলে গালি দেয়, ওই কথাটিও আমার কাছে তাই মনে হল, এখনও হয়। বিশ্বস্ত সূত্রে জানলাম, ছবির কাটতি বাড়ানোর জন্য এই শ্লোগান সর্বত্র। কাটতি বাড়ানোর কৌশল আমরা ততদিনে জেনে গেছি। আমরা জেনে গেছি সাম্প্রতিক সময়ের একটি গ্রীক-মিথোলজিকে বাংলাকরণ করে শুধুমাত্র মিডিয়ার ম্যানুপুলেশনের মাধ্যমে একটি অবাস্তব কাহিনীকে জনপ্রিয় করে তোলার সফল প্রচেষ্টা, দেখেছি মনোমুগ্ধকর গানগুলো আগে থেকে শুনে আশাবাদী মানুষগুলো হল থেকে বের হয়ে ঘরে ফিরছে চরম বেদনাহত হয়ে। বোনাস খালি সরলা বাঙ্গালী নায়িকার কোমড় থেকে শাড়ি নামানো দৃশ্যগুলো।
শুনেছি ওই প্রগতিশীল চিত্রপরিচালকও বাজার মূল্যায়ণ করতে গিয়ে এ রকম শাড়ি-সহযোগ করেছেন। আর মোদ্দা কথা এই যে, এ রকম একটি চলচ্চিত্রের শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র প্রোমোশন এর জন্য বাজেট করা হয়েছিল ১০ কোটি টাকা। যা দিয়েছিল একটি নারিকেল তেল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে এর আগে কোন চলচ্চিত্রের প্রচার-প্রচারণায় এত লগ্নি করা হয়নি। ফলশ্র“তিতে বাঙ্গালী দর্শকেরা আবারও হতাশ।
শুধু নাটকপাড়ার সেই পরিচালকটির উত্তরণ ঘটল, তার প্রচুর টাকা ও খ্যাতি হল। তিনি চেয়ারে হেলান দিতে শিখলেন। এই চলচ্চিত্র মুক্তি পাবার পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই পরিচালকের এমন কোন সাক্ষাতকার অথবা পত্রিকায় ছাপানো ছবি দেখাতে পারবেন না যে তিনি কোন কিছুতে হেলান দিয়ে নেই। যাই হোক দর্শকের মন পুড়ে যাওয়ার গল্প বাদ দিয়ে সেই “ইহা আর্ট নয় হার্ট ফিল্ম” এর জায়গায় আসি। ছবিটি মুক্তির কমপক্ষে ২ বছর আগে থেকে মিডিয়া আমাদের খবর দিতে শুরু করল।
আসবে, আসছে করেও এল না তা, কিন্তু মিডিয়াগুলো থামলো না। যতদিন আসতে থাকলো “যা কিছু ভাল”-রা বিনোদন পাতার প্রথম পাতাটা ছাড়তে শুরু করল। আর সবচে’ হাস্যকর বিষয় এই যে, এই ছবিটি মুক্তির প্রথম দিনেই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে দেওয়া হল, “ ইহা ব্লক ব্লাষ্টার হতে চলেছে”। ছবির ওয়ান অব দ্যা কাহিনীকার সুদুর টরেন্টো না কই থেকে একটা অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ওই দিনই লিখলেন, “ ইহা ব্লক ব্লাষ্টার হতে চলেছে ”। অনেকটা রাতের বেলা থানায় টিএনটি থেকে ফোন করে বলা , “স্যার, মনে হচ্ছে ডাকাতি হচ্ছে”।
যাই হোক ওই দিন একটি চ্যানেলে টক শো করে জাতিকে বোঝানো হল যে জাতি ওই দিন ওই সিনেমা-জ্বরে আক্রান্ত হইয়াছে, তাও আবার তৃতীয় মাত্রায় ! আর পরের দিন মানে মুক্তির দিন রাতেই ছাপা পরের দিনের “যা কিছু ভালো” দৈনিকে এল “ “ উহা ব্লক ব্লাষ্টার হতে চলেছে ”। আর তাই দর্শকরা হলে গিয়ে দেখেছে অদ্ভূত-সেক্সুয়াল-ডিজাষ্টার। বেড সিনে রণসঙ্গীতের ব্যবহারে আঘাত লাগেনি কোন নজরুল সঙ্গীতজ্ঞের, অথবা যারা মুক্তিযুদ্ধে বা যে কোন গণ-আন্দোলনে এই গানটিকে গণ সঙ্গীত হিসাবে গেয়েছেন, আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কথাতো বাদই দিলাম, বিগত বছরগুলোতে এদের ভূমিকা আমাদের সবার কাছেই পরিষ্কার। সে যাই হোক, এ কথা অনস্বীকার্য দর্শককে একটি চটুল প্রেমের নাটককে সেলুলয়েডে ভরে চলচ্চিত্র হিসাবে দেখানোর প্রচেষ্টা চুলোয় যেত যদি এর পেছনে মিডিয়া-কর্পোরেটদের হাত না থাকতো।
প্রিয় পাঠক, মিলিয়ে দেখতে পারেন।
বর্তমান সময়ে “সম্প্রচারের ভাষা” প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে আমি কেন এসব গল্প ফেঁদেছিলাম, তা না বললে নিশ্চয়ই আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন না। বললাম এই জন্যে যে, আমাদের দেশে সম্প্রচারের ভাষা এইভাবেই পাল্টে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম যখন টিভি-রেডিওতে টকশো-নাটক-সিনেমায় এ রকম ভাষা ব্যবহারকে অহরহ দেখতে পাচ্ছে, তার সাথে যোগ হয়েছে বড় বড় কর্পোরেটরা এইসব ভাষায় বিজ্ঞাপন বানিয়ে ফেলায়। যেহেতু এইসব “মাল” আমরা নিয়মিত দেখছি, মানে গিলছি, তাই ভাষা-অভাষা ঠাহর করতে না পেরে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ওই “মাল” কেই আত্মস্ত করেছি।
এবার আরেকটি সমীকরণ দেই।
হিসাব করে দেখুন “যা কিছু ভাল” দৈনিকটি থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আসল মালিক একজন শিল্পপতি কাম রাজনীতিবিদ। এদের প্রায় প্রত্যেকেই করাপ্টেড। সিন্ডিকেট-ব্যবসা এদের প্রধান পেশা আর রাজনীতি এদের ইনভেষ্টমেন্ট। এদের বিজ্ঞাপনগুলো যারা বানাচ্ছে, তারাই মিডিয়ায় নাটক-সিনেমা-টকশো বানাচ্ছে, যারা রিপোর্ট করছে স্তুতি গেয়ে তারাও ওই কর্পোরেটদেরই কোন না কোন বেতনভূক্ত ! আবার এই কর্পোরেটের চ্যানেলে আরেক কর্পোরেটের পৃষ্ঠপোষকতায় দাঁড়িয়ে যাওয়া নির্মাতা-অভিনেতা-উপস্থাপকদের জায়গা দেওয়া হচ্ছে বিনিময় প্রথায়। সব মিলিয়ে এরা সবাই একই ।
সবাই বাজারে পণ্য বিক্রি করতে এসেছে। তাই “ইহা আর্ট নয় হার্ট ফিল্ম” বলে শিল্পকে গালি দিলেও আমরা হলুদ বুদ্ধিজীবীরা মেনে নিচ্ছি। কারণ, আমরা বারবার টকশো‘তে ডাক পেতে চাই, আর টক শো করে করে সুশীল সমাজের তকমা লাগিয়ে ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা চালু থাকলে সাদামনের উপদেষ্টা হতে চাই। প্রিয় পাঠক, হিসাব করে দেখুন, এ সবই একই কুমিরের একই বাচ্চা, আমরা বিভিন্ন রুপে একই জিনিস গিলছি। কেন না আমরা অন্ধ জাতি, আমাদের জন্ম হয়েছে এসব গেলার জন্য।
অন্যদিকে নাটক-সিনেমা বানানোর জন্য পুনে অথবা য়্যুরোপ থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসা প্রতিশ্রুতিশীল কিছু তরুণ দেশে এসে সুরসুর করে বিজ্ঞাপন নির্মাণের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, সেই একই ষ্টাইল, কেন না শুধুমাত্র টাকার জন্য তারা সেই একই থলের বেড়াল হয়ে ঢুঁকে পড়লেন কর্পোরেটের ঝুলোয়। আমি এমন একজন শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞাপন-নির্মাতাকে চিনি যিনি পুনে থেকে পড়ে এসে মিডিয়ায় কমপে ৫ বছর ধরে কাজ করছেন, নিজেকে চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসাবে পরিচয় দেন, কিন্তু কতিপয় সস্তা দরের ভারতীয়-কপি বিজ্ঞাপন আর “বিগ ব্রাদার” এর হুবুহু নকল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা “উত্তরাধিকার” নামক রিয়েলিটি শো ছাড়া আজ পর্যন্ত তাকে কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে দেখা যায়নি। ডিজিটাল চলচ্চিত্র নিয়ে আন্দোলন করা এমন একজন নির্মাতাকে চিনি যিনি যা কিছু বানান তা ওই টিভিতে বেঁচার জন্য, এমনকি ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে তিনি যা বানাচ্ছেন তাও। এরা প্রত্যেকেই নাটক বানান। এবং ভাষাগত দিক সেই “খাইছ্ছো? বেশী পাকনা হইয়া গেছ্ছো?”
তো এই সব মিলিয়ে আজকের নির্মাতারা তা তারা যাই বানান না কেন ওই ভাষাটার ব্যাপক ব্যবহার করছেন, যে ভাষা আমার নয়, আপনার নয়, ঢাকার বাইরের দর্শকদেরতো নয়ই।
আমি এই ভাষার নাম দিয়েছি “কায়স্থ ভাষা”। এ ভাষা না পুরোপুরি ঢাকাইয়া, না বরিশালের, না কুমিল্লার, না চট্টগ্রামের। ভাষাটার বেশিরভাগ ব্যবহার হয় রাস্তাঘাটে, বন্ধুমহলে। যে ছেলেটা তার বন্ধুদের সাথে, সিগারেটের দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে সে ঘরে এসে একই ভাষায় তার মায়ের সাথে নিশ্চয়ই কথা বলে না। কি অদ্ভূতভাবে একটি আধা-খেঁচড়া-ভাষাকে মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে!
প্রেমিক প্রেমিকাকে ফোনে বলছে, “ কি হইছ্ছে বাবা? রাগ করেছ্ছো বাবা?”
প্রেমিকা ওপাশ থেকে বলছে, “ হুম, আমার মন ভালো নেই বাব্বা”...
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা সংস্কৃতিকে উদ্ধার করা এক দম্পতি ভারত থেকে “ননদ-বউ-শাশুড়ী-চোখ রাঙগানী” বিষয়ক কোর্স করে এসে বিভিন্ন চ্যানেলে ডেইলি সোপ বানাচ্ছেন, আমাদের জনজীবনের বাইরে অদ্ভূত এক কাহিনী!
এইসব ভাষা ব্যবহারের মূল পৃষ্ঠপোষকেরা অর্থাত যারা অর্থের যোগান দিচ্ছে, যারা মিডিয়াতে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করছে তাদের শেকড়ই আমাদের দেশের নয়, তারা বেশীরভাগই এসেছে আমাদের দেশের বাইরে থেকে।
এদের মধ্যে একটি তো প্রথমে এদেশের একজন সফল এনজিও-মহাজন এর গুড উইল নিয়ে এদেশে ঢোকে, তারপর নরওয়ে থেকে হঠাত শান্তিতে নোবেল প্রদান এবং ওই সময়ে ওই ফোন কোম্পানীর আরো কিছু শেয়ার নিজেদের হস্তগত করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং মিডিয়ায় আমরা তাদেরই জয়জয়াকার দেখি, “ মা যদি তার সন্তানকে এতই ভালবাসে তাহলে তার জন্য এই প্যাকেজ!, একইভাবে সন্তানের ক্ষেত্রেও”.. এমনকি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস.. সবকিছুতে তারা বোঝাতে চায় তারা এই দেশের দেশপ্রেমে টুইটম্বুর .. আর তাই একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে জোট বেঁধে সাম্প্রতিক সময়ে করা একটি বই “ ৭১ এর চিঠি” সংকলনের জন্য শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনের জন্যই বোধহয় তারা খরচ করেছিল কয়েক কোটি টাকা.. তারপর ওই বইটি হাজার হাজার কপি বিক্রি করে তারা আমাদের দেশ-উদ্ধার করেছিল.. এই বিজ্ঞাপনের পেছনে এত টাকা লগ্নি না করে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে কিছু একটা করলে হত না?.. হত না .. কেন না “ যা কিছু ভাল” দৈনিকটির মত এই ফোন কোম্পানীটিও চায় আমাদের আপন প্রতিষ্ঠান হতে! .. আর প্রতিদিনের আয় প্রতিদিন য়্যুরোপে পাঠাতে এদের জুরি মেলা ভার.. যে জন্য শুনেছি মাঝে মাঝে আমাদের ব্যাংক- রিজার্ভে টান পড়ে!.. তাহলে বলুন, এইসব কর্পোরেট এবং মিডিয়ার দালালেরা আমাদের মূল ধরে যখন টানছেই.. তখন আমাদের ভাষাকে একটা আধা-খেঁচড়া ভাষায় পরিণত করলে তাদের কি আসে যায়? আমাদের সংস্কৃতির নাড়ি-ভুড়ি পাল্টে দিয়ে নতুন প্রজন্মকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করাই এদের কাজ। এদের ইন্টেনশান শুধুমাত্র বাজারজাতকরণ।
প্রিয় সম্পাদক, আমি জানি না আমার এই লেখাটি কোন প্রকার সেন্সর ছাড়া আপনার কাগজে ছাপা হবে কি না। শুধু এইটুকু জানিয়ে রাখতে চাই মিডিয়ার প্রতি আমার কোন বিরুপ মনোভাব নেই, হয়ত তার যোগ্যতাও রাখি না। আমি বারবার শুধু মিডিয়ার চরিত্রকে পাল্টাতে বলি।
আর বলি শুধুই আকাশ-সংস্কৃতির প্রভাব নয় বাংলা-ভাষা-সংস্কৃতিকে টেনে হিঁচড়ে নর্দমায় নামিয়া ফেলার নীল ষড়যন্ত্রে নেমেছে কর্পোরেট-মিডিয়াবাজরা। রুখে দাঁড়াবার কেউ নেই।
#
প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক, গায়ক অঞ্জন দত্ত আসছেন আমার ছবিতে কাজ করতে, নাম “আমরা একটা সিনেমা বানাবো” । শুধু তিনি নন বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পি এগিয়ে এসেছেন তাদের কমার্শিয়াল তকমা পায়ে দলে। আমার সাথে কাজ করেছে কয়েক শো’ গ্রাম থিয়েটার কর্মী।
দৈব দূর্বিপাক আর অর্থ-লীর অভাবে অনেক কাঁচা হাতের কাজে অন্তত এইটুকু বলতে পারি আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে বাংলা ভাষাকে আমি ন্যাংটো করে ফেলিনি।
“আমরা একটা সিনেমা বানাবো”। প্রোগৃহে চলবে। এই সময়ের কাহিনী। কিন্তু পুরোটাই সাদাকালো।
সাদাকালো মানে প্রথাগত মিডিয়ার এই চরিত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ছবিটার শুটিং প্রায় ৭০% শেষ হয়েছে, বাকিটাও শেষ হবে শিঘ্রি। এই ফিল্মটা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন মিডিয়া একটা লাইনও লেখেনি, অথচ মিডিয়ায় কাজ করে এমন খুব কম মানুষ আছেন যারা এই ফিল্ম এর খোঁজখবর রাখেন না। হয়ত এর কারণ, এই ছবির নেপথ্যে কোন কর্পোরেট-বেনিয়া নেই অথবা মিডিয়ার দালালদের আমরা প্রশ্রয় দেই নি। সারা বাংলাদেশে আমরা একটা আল্টারনেটিভ প্লাটফরম গড়ে তুলেছি, যা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও।
আমরা মানুষকে সিনেমা দেখাতে চাই। এ ছবির ভাষা জনমানুষের ভাষা, আরোপিত কায়স্থ ভাষা নয়।
অঞ্জন দত্ত এর প্রসঙ্গ চলে এল এই কারণে যে, এইভাবে যদি সম্প্রচারের ভাষা ক্রমাগত নর্দমার ভাষায় পরিণত হয়, নাবালক-খিস্তি-খেউর যদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঢুকে পড়তে থাকে ভাই-বেরাদার এবং তাদের মনিবদের কল্যাণে তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আপনার সন্তানকে একদিন শোনাতে বাধ্য হবেন সেই গান, “অঞ্জন বলছে টিভি দেখো না”
আমি বিশ্বাস করি দর্শকদের আমরা যত বোকা মনে করি তারা তত বোকা নন। ভাষা বহমান নদীর মত বলে যারা খিস্তি-খেউড়কে আমাদের মজ্জাগত করতে চাইছে তারা নিক্ষিপ্ত হবেই ইতিহাসের আঁস্তাকুঁড়ে..
____________________________________________________________________________________
(Written on 10-01-2010)
(এই লেখাটি তুষার আব্দুল্লাহ সম্পাদিত "মাধ্যম" পত্রিকার ফেব্রুয়ারি ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।