এই ব্লগের কোন লেখা আমার অনুমতি ব্যতীত কোথাও ব্যবহার না করার অনুরোধ করছি
আজকাল প্রায়ই চুপচাপ শহীদ মিনারে বসে থাকি গভীর রাতে, সম্পূর্ণ ক্যাম্পাস যখন নিঃস্তব্ধ। নির্জনতারও এক ধরণের কোলাহল আছে, সেটাই উপভোগ করি। শীত কমে গেছে, তাই কপোলে অশ্রুর শীতল ছোঁয়ায় ঈষৎ শিউরে উঠি না আর। মাঝে মাঝে একটা সিগারেট ধরাই, অনুভব করি আমার মতো আরও একজনকে, পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হচ্ছে। সিগারেট পুড়ে গেলে শেষ হয়ে যায়, আমি নতুন করে পুড়তে থাকি।
তখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে আমার পৃথিবী, আমার বিশ্ববিদ্যালয়, নির্জন পথ, সুবিশাল বৃক্ষরাজি এবং নিরন্তর নৈশ প্রহরীর মতো ক্লান্ত পাহাড়। হঠাৎ খুব অসহ্য লাগে সবকিছু, মনে হয় মহাজগতের সব সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, আর্তনাদ করছে গভীর নিনাদে, ডাকছে আমাকে অই ধ্বংসলীলায় অংশ নিতে, আমাকেও শেষ করে দিতে চাইছে, চূর্ণ করে দিতে চাইছে। একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছি, এখন আঘাত আসলে আমি আর কখনোই দাঁড়াতে পারব না, সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ব, যতটুকু বিশ্বাস আছে সবটুকু নিঃশেষ হয়ে যাবে একেবারে, অবশেষটুকুও বিলীন হয়ে যাবে। অনেক দিন আমি বৃষ্টি দেখিনি, অনেকদিন আমি পাখিদের কোলাহলে আনমনা হইনি, অনেকদিন আমি রোমন্থন করিনি বহু সুখকর স্মৃতি, অনেকদিন আমি খুঁজে পাইনি আমাকে, অনেকদিন আমি নিশাচর হয়ে আছি। অনেকদিন আমি নির্জন রাতে হাঁটি আমার ছোট্ট ঘরের বাইরের প্রশস্ত বারান্দায়, আমার অসংখ্য অন্ধগলিতে; আমি মনের অন্ধকার অংশের অচেনা অনুভূতিগুলোকে বিচিত্র আবেগে তুলে এনে অনেকক্ষণ ধরে বোধ করি, ওরা আমার নিঃসঙ্গতাকে ব্যঙ্গ করে, ওরা অশ্লীল হয়ে উঠে আমার প্রতি, ওরা ভয়ানক হিংস্র হাসি হাসে আমার একাকীত্ব দেখে, আমি সহ্য করতে পারি অনেকটা সময়, এবং একসময় আমি আর পারি না, আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি, আমি হাহাকার করে উঠি সহস্র বছর ধরে, আমি দু'হাতে মাথা চেপে বসে থাকি অগুনতি অজস্র মূহুর্ত, আমি চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে চাই, কিন্তু আমি আরও বেশি অক্ষম হয়ে উঠি, আমার সমস্ত শুভ বোধ বিবস্ত্র বালিকার মতো কুঁকড়ে উঠে আতঙ্কে।
একসময় ঘরে ফিরে আসি, চারপাশে তাকাই, একরাশ চেনা পরিবেশ স্মিত হেসে আমার দুর্দশাকে ক্লান্ত পদক্ষেপে প্রদক্ষিণ করে চলে। আর অল্প কিছুদিন, আমি নিজেকেই বলি, তারপর আর থাকব না এখানে, যেমন ছিলাম না এখানে জীবনের অনেকগুলো মূহুর্ত। এই থাকা আর না থাকার মাঝখানে অস্পষ্ট ধোঁয়াশার মতো পাক খেয়ে চলে কিছু সময় এবং অসময় এবং তারা আমাকে নিজের কাছে অনেক অচেনা করে তোলে। মুক্তি আসছে, আসছে স্বাধীনতা, আর মাত্র কয়েকটি ঋতু, একটি বসন্ত, একটি গ্রীষ্ম, একটি বর্ষা, একটি শরৎ এবং হয়তো একটি শীত। আমি হারিনি হেরে যাওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত, আমি অসীম সাহসিকতায় লড়াই করেছি অনেকগুলো বছর এবং এখন ক্লান্ত, বুড়ো সৈনিক হয়ে গেছি।
মুক্তির প্রতীক্ষা বড় আনন্দের, কিন্তু এটা মানুষের বয়সকে এক ধাক্কায় অনেক বাড়িয়ে দেয়। এখন বসন্ত, সম্ভবত এটাই শেষ বসন্ত এখানে, শেষবারের মতো আবার দেখতে চাই কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ার আগুন রাঙ্গা শোভা, আবার উপভোগ করতে চাই পলাশ-শিমুলের আলো, শেষরাতে জানালার ফাঁক গলে আসা একচিলতে হিমশীতল বাতাসে আর একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই এবং গোপন করতে চাই যত অপূর্ণতা গভীর, গোপন, মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাসে; ভোরের নরোম আলোয় নাম না জানা পাখির বিস্মিত নয়নে আমি পৃথিবীকে আরও কিছুদিন দেখতে চাই- অথচ আমি জানি, এখনই শেষ সময়। জীবনের যেই শক্তির জন্যে এতোটা পথ অবিশ্রান্ত চলে এসেছি, যেটুকু বাধা দিয়ে রেখেছিল সকল কামনা, ব্যর্থতা আর স্বাধীনতার সুখ, ওরা আজ গোধূলীলগ্নে এসে পৌঁছেছে। হয়তো পারব, হয়তো পারব না, আজকাল আর কিছুই ভাবি না। যাক না যেমন চলে যাচ্ছে সব দিনরাত্রিগুলো, আসুক যেভাবে খুশি কালবোশেখী ঝড় তার সমস্ত শক্তি নিয়ে, আমি উদ্বিগ্ন নই আর; আমি এখন বড় ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, পরিত্যক্ত, বিপুল সম্ভাবনাময় একরাশ স্বপ্নের স্তিমিত স্পন্দন, আমি এখন হার না মানা পরাজিত নিরর্থক আবেগের এক সুবিশাল ধ্বংসস্তূপ, আমি এখন অনুভূতিহীন এমন অনেক কিছু যার কোনও প্রকাশ নেই।
আমি ধ্বংসের অপেক্ষায় ন্যুব্জ হয়ে থাকা অনন্ত জীর্ণ মহাকাল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।