এইসব ভালো লাগে...
-ও ম্যাভাই! গলুই এ যাবার পথখান কোনদিকে?
- জ্বী?
-গলুই এ যাবার পথখানডা ইট্টু দেখায় দে না ভাই
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি দুষ্টুমি করে ড্রয়িং রুম দেখিয়ে দিলাম…
আসলে দাদীর মতিভ্রম হয়েছিল তখন। আমাদের খুলনার বাসায় ছিলেন। শহরের ওই দোতলার উপর গলুই আসবে কোত্থেকে!
মজা করতে ড্রয়িং রুমটা দেখিয়ে দিয়ে বললাম, “ঐ দিকে”
বলেই মুচকি মুচকি হাসছি। দাদী এর মধ্যে ড্রয়িং রুম ঘুরে এসেছেন। মায়া হলো।
-“দাদী এখানে গোয়ালঘর কোথায়!?”
-হুমম…
দাদীর ই বা কি করার! দাদু বেশ কদিন ধরে সঙ্গাহীন। আছেন গরীবে নেওয়াজ ক্লিনিকে। দাদী উঠেছেন বড় ছেলের বাসায়। গ্রামের সদাব্যস্ত মানুষটির এখানে কোন কাজ নেই। নেই অবাধ উঠোন… তার উপর স্বামীর অসুখ তাকে বড়ো বেশি ম্রিয়মান করে দেয়।
এই আমাদের প্রানপ্রিয় দাদীজান। সহজ সরল গ্রাম্য, আপাত দৃষ্টিতে বোকা বোকা অথচ তীক্ষ্ণধী সপন্ন একজন মানবী।
সকলের মঙ্গল কামনায় অস্থির, দুঃখী স্বজনদের তরে দিলদরদী, বড়ো বেশি নির্লোভ… আজকাল দেখা যায়না এমন এক নারী…
হ্যাঁ! একটা মোহ তার ছিল বটে! তাইতো পাতাকপি দিয়ে শোলমাছটা আমারও বড়ো ভাল্লাগে, ঐতিহ্য ধরে রেখে!
আমার প্রিয় বোকা বোকা দাদী, আরবী জ্ঞান ছাড়া আর লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি তোমার। যখন আরবী পড়তাম হুজুরের ভয়ে, তুমি তাকিয়ে দেখতে আর হরফ গুলো উচ্চারণ করতে… বাংলা বা ইংরেজী পড়ার সময় কোন ছবি দেখলেই মানে জানতে চাইতে… টিভিতে খাওয়ার সিন এর সময় চ্যানেল পালটে দিলে বলতে “খাচ্ছে তো খাতি দে না!”
মনে আছে দাদী? একবার টিয়ার বায়না ধরলাম! সেদিন ই তুমি বেড়াতে এলে ছেলের বাড়ী। টিয়ার এক পা ভাঙ্গা ছিল তুমি ই দেখিয়ে দিলে! ব্যস আমার হুকুম “টিয়া বদলকে লাও!”
তুমিই না শেখালে দাদী? টিয়াকে ধান খাওয়ানো? মরিচ যে ওরা এত কচকচিয়ে খায় আমি কি জানতাম তুমি না বললে?
বিকেলের নাস্তায় বিস্কুট খেতম দুজনে।
তোমার দাঁত গুলো গিয়েছিল আগেই। আমার চাতে ডুবিয়ে নরম করে নিতে। বলতে “মুখ লাগা দিকটা ডুবাচ্ছিনে…” পাগলী দাদী! আমি কোনদিন কিছু মনে করেছি এতে?
তোমার জাপানীজ ছোট বৌমার সাথে ফোনে বলা কথা মনে আছে? ’৯৮ তে? ছোটচাচীর বাংলা তখন আজকের মতো অনর্গল ছিলনা। ওদিকে তোমার বকবকের বিরাম নেই। হঠাত বলে উঠলে ফোনে, “সারাদিন পেটের মধ্যে ভুসভুস করে বৌমা বুইজলে? মনে হয় চ্যাং ঠেলে উঠতেছে!” কথা শেষ হওয়ার আগেই আমরা কাজিনরা হাস্তে হাস্তে গড়াগড়ি!
আমার ভিতুর ডিম দাদী, মনে আছে একবার ওয়ারাকে ধরতে গিয়ে তোমার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম দুজনেই? চশমা গেল উড়ে।
তুমি বললে তোমার নাকি নাকের হাড় ভেঙ্গে গেছে! বলেই নাকে হাত দিলে, দেখলাম তুমি নাকের কচি হাড়টাই নেড়ে দেখাচ্ছ! এই ঘটনা আম্মুকে বলতেই দুজনে হেসে উঠলাম।
জানিনা কেন, কিন্তু প্রায়ই বলতে “যখন বিয়ে করবি, নাতবউ আসবে বুঝবি ঠেলা!” আমি বেশ লাজুক মুখ নিয়ে চুপ মেরে যেতাম। আরো বলতে দাদী মরলে বুঝবি দাদী কি জিনিস।
সত্যিই দাদী… তুমি থাকতে কত্ত মজা হত দাদুবাড়ি। ভোর হলেই খেজুর রস দিয়ে মুড়ি, তারপর ছিটে রুটি দিয়ে টাটকা খেজুর গুড়… উফফ মিস করি দাদী! রসের পিঠে তেমন খেতাম না তখন, কিন্তু, এখন কেন খুব খেতে ইচ্ছে করে জান দাদী?
আম্মুর যখন খুব অসুখ তখন তুমি এ আমাকে খাইয়ে দিতে দাদী।
আমার গোসল, ঘুম, এমন কি সেই কাজটুকুন ও তুমি করতে! উফফ অনেক জ্বালিয়েছি তোমাকে…
হঠাত করেই চলে গেলে তুমি। ফাইনাল এক্সাম থাকায় যেতে পারিনি। যাক সে এক মন্দের ভাল। মনে হয় যেন তুমি লুকিয়ে আছ কোথাও! টুকি দিয়ে এসে পড়বে!
গ্রাম ভাল লাগে বলে এখনও গ্রামে যাই দাদী। আবারো যাব ইনশাল্লাহ।
কিন্তু এখন আর কেউ খুব শীর্ণ দেহে করিডোর দিয়ে হাটে না রাতে। কেউ আমাদের জন্য বসে থাকেনা তালার চাবি নিয়ে ঐ বাইরের সোফাটায়। কাছের যারা তারাই তোমাকে শুইয়ে দিয়ে এসেছে পুকুরপাড়ের শিশুতলায়। খুব ভিতু তুমি ঐ অন্ধকারে কিভাবে থাক দাদী? ছেলেদের মুখ মনে পড়েনা? অন্তত মঈনের মুখ? ও দাদী! না থাক শান্তিতে ঘুমাও তুমি। পৃথিবী খারাপ হয়ে গেছে… তোমার বড় ছেলের ভার্সিটি নরক বনে গেছে… অনেক কষ্ট করেছ তুমি…এসব দেখলে শান্তিপ্রিয় তোমার কষ্ট আরো বাড়বে।
ভাল থেক দাদী… অঅঅঅনেক ভাল থেক…
পুনশ্চঃ দুপুরে খাটে শুয়ে পায়ের উপর পা তুলে পা নাচানো তোমার স্বভাব ছিল। একপায়ের তালু দিয়ে আর পায়ের পাতার উপর ঘষতে তুমি। জান দাদী তোমার এই স্বভাবটা আমার মধ্যে আছে! বাবার কিন্তু নেই!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।