জানার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন, বই হলো তার বাহন, আইনের মৃত্যু আছে কিন্তু বইয়ের মৃত্যু নেই। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন পারভীন আক্তার। লাঠিতে ভর দিয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করেন। সাথে ছোট একটা বস্তা। স্বামী ও সন্তানদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় বস্তা রেখে বসলেন।
যেন মনে হলো, মনের জমে থাকা কথাগুলো বলার সুযোগ পেয়েছেন। বললেন- ‘এগুলারে (সন্তানদের) আমার কাছে রেখে, অনেক আগেই সে (স্বামী) মারা গেছে। ছেলেমেয়েরে বড় করছি, এখন আমার খবরও লয় না, কই থাকে আমিও জানি না। ’ কাঁপা কাঁপা স্বর আর অশ্রুসিক্ত নয়নে অকপটে বলে গেলেন। থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে উত্তর দিলেন- ‘মাইনষের বারান্দায় পইড়া থাকি।
আর বয়সের জন্য সব দিন ভিক্ষার জন্য বাইর হইতে পারি না। মাইনষের থেইকা চায়া খাই। ’
এটা হলো এক গরিব পরিবারের মায়ের অবস্থা। এবার একটু ধনী পরিবারের দিকে তাকাই। বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষার্থী বললেন- ‘দাদী গ্রামে থাকে।
ছোটবেলায়... দেখেছিলাম। এরপর আর খেয়াল নেই। বাবা বছরে টাকা পাঠিয়ে দেয়, এই তো...’।
এক দিকে অসচ্ছল ও অশিক্ষিত পরিবার, অপর দিকে সচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবার। এক পরিবারের সন্তানের কাছে মা বেঁচে আছে কি নেই, সেই পরোয়া নেই, অপর পরিবারে সন্তান মনে করছে বছরে টাকা পাঠিয়ে দেয়াই বুঝি প্রধান কর্তব্য।
তবে উভয় দিকে সমস্যা একই। বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা অবহেলিত, আপনজনের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, নিঃসঙ্গ, অনেকটা সন্তানদের কাছে বোঝা।
ধনী হোক কি গরিব, এসব সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের মাঝে প্রকৃত শিক্ষার অভাব। মনুষ্যত্ব, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাব। দিন দিন আমরা আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক হয়ে উঠছি।
আমাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠছে- কিভাবে সমাজে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হব। আমরা এতই ব্যস্ত যে, নিজের জীবনের অসহায় অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থা পর্যন্ত চিন্তা করারও সময় নেই। মা-বাবার নিঃস্বার্থ সংগ্রাম-সাধনা, অক্লান্ত পরিশ্রমকে আজ বড় হয়ে আমরা মূল্যায়ন করি না। সত্য হলো, তারা আমাদের মুখ থেকে শুধু মূল্যায়নই শুনতে চান। পরিবারের ঐক্য তিনি কামনা করেন।
অথচ আমরা লক্ষ্য করছি- যে বয়সে তাদের যত্নের প্রয়োজন, পারিবারিক সহায়তা ও আন্তরিকতার প্রয়োজন, সেই বয়সেই জীবন বাঁচাতে কেউ ভিক্ষা করছেন এবং অন্যের বাড়ি থাকছেন। অপর দিকে কেউ টাকা পেলেও অসহায়, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন।
একটা শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার পরিবার থেকে। তারপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে। তাই পিতামাতার কর্তব্য, তারা যেন সন্তানদের সময় দেন, ধর্মীয় শিক্ষার আলোকে নৈতিক শিক্ষা তথা মূল্যবোধ গড়ে তোলেন; যাতে পরবর্তীকালে সন্তানদের থেকেই তার সুফল পেতে পারেন।
কোরআনে মাতা-পিতা সম্পর্কেঃ--------
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা। (বনী ইসরাইল: ২৩
হাদীসের আলোকে মাতা-পিতাঃ---------
১.
এক ব্যক্তি নবীজীর স. কাছে এসে বলল, সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার বেশি কোন মানুষের? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটা বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, এরপরও তোমার মা। লোকটা বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, এরপরও তোমার মা।
লোকটা বলল, এরপর কে? তিনি বললেন, এরপর তোমার বাবা। -বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী
২.
এক ব্যক্তি নবীজীর স. কাছে এসে জিহাদের জন্য অনুমতি চাইল। নবীজী স. বললেন, তোমার পিতা-মাতা জীবীত নাকি? লোকটা বলল,হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তাদের জন্যই পরিশ্রম করো (এতেই তুমি জিহাদের সওয়াব পাবে)। -বুখারী, মুসলিম
৩.
এক ব্যক্তি নবীজীর স. কাছে এসে বলল, আমি আল্লাহর কাছে সওয়াবের আশায় আপনার হাতে হিজরত ও জিহাদের ব্যাপারে শপথ করছি।
নবীজী স. বললেন, তোমার পিতা-মাতার কোনো একজন জীবীত নাকি? লোকটা বলল,হ্যাঁ, বরং উভয়ই। তিনি বললেন, তুমি তো আল্লাহর কাছে সওয়াব আশা করো। লোকটা বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তোমার পিতা-মাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। - মুসলিম
৪.
একদা নবীজী স. বললেন, ধ্বংস হোক।
ধ্বংস হোক। পুনরায় ধ্বংস হোক। বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কার কথা বলছেন? তিনি বললেন, যে তার পিতা-মাতা উভয়কে বা কোনো একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেয়েছে, অথচ এরপরও সে (তাদের খিদমত করে) জান্নাতে যেতে পারে নি। -মুসলিম
৫.
নবীজী স. বলেছেন, সর্বোত্তম কাজ হলো, পিতার সৃহৃদদের (বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন) সাথে সম্পর্ক রাখা। বুখারী, মুসলিম
৬.
নবীজী স. বলেছেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, আর পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।
-তিরমিযী
৭.
আবু দারদা রা. বলেন, আমি নবীজীকে স. বলতে শুনেছি, পিতা-মাতা জান্নাতের মাঝের দরজা। যদি চাও, দরজাটি নষ্ট করে ফেলতে পারো, নতুবা তা সংরক্ষণও করতে পারো। - তিরমিযী
৮.
রাসূলুল্লাহ স. বলেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ কোনগুলো তা বলব না? সাহাবাগণ বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। বর্ণনাকারী বলেন, এতটুকু বলে নবীজী স. বসে পড়লেন, এতক্ষণ তিনি হেলান দিয়ে ছিলেন।
অত:পর নবীজী স. বললেন, মিথা সাক্ষ্য দেয়া। এ কথাটি তিনি এতবার বলতে থাকলেন যে আমরা মনে মনে বললাম, আর যদি না বলতেন! -তিরমিযী
৯.
রাসূলুল্লাহ স. বলেন, অন্যতম কবীরা গোনাহ হলো, ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে গালমন্দ করা। সাহাবাগণ বললেন, পিতা-মাতাকেও কি কেউ গালমন্দ করে? নবীজী স. বললেন, হ্যাঁ। কেউ কারো পিতাকে গালি দিলে সেও তার পিতাকে গালি দেয়। আবার কেউ কারো মাকে গালি দিলে, সেও তার মাকে গালি দিলে।
(এভাবে অন্যের পিতা-মাতাকে গালমন্দ করলে প্রকারান্তরে নিজের পিতা-মাতাকেই গালমন্দ করা হয়। ) -তিরমিযী
১০.
রাসূলুল্লাহ স. বলেন, তিন রকম দোয়া নি:সন্দেহে কবুল হয়। মজলুমের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া আর সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দোয়া। -তিরমিযী
১১.
রাসূলুল্লাহ স. বলেন, সন্তান কোনো ভাবেই পিতা-মাতাকে প্রতিদান দিতে পারে না। তবে যদি পিতা-মাতা গোলাম হয়, তখন তাকে ক্রয় করে আজাদ করে দিলে হয়ত প্রতিদান হয়।
-তিরমিযী
পরিশেষে...........হে মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে পিতা-মাতার হক আদায়ে তৌফিক দান করুন। আমিন,ছুম্মা আমিন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।