কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না, ইহাতে উহারা কষ্ট পায়
পূর্ব কথনঃ গত দু বছর আগে জিয়া আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরের সামনে থেকে লালনের ভাস্কর্য ভেঙ্গে বা সরিয়ে ফেলায় এই ব্লগে তুমুল প্রতিবাদ উঠেছিল। অনেকেই লিখেছেন, বেশীরভাগই এর প্রতিবাদ করে। তখন একটা পঠিত লেখার কথা আমার বার বার মনে হচ্ছিল, ছাত্রাবস্থায় একটি কলাম পড়েছিলাম অধুনালুপ্ত পাক্ষিক পালাবদলে। গত কয়েকদিনে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে লেখাগুলো খুঁজে পেলাম। পক্ষে বিপক্ষে হয়তো অনেক কথাই থাকবে এই লেখার।
আমি সম্পূর্ণ নিরাসক্তভাবে এই লেখাটি ব্লগে কয়েকটি পর্বে দিয়ে দেব। মূল লেখকের কোন ঠিকানা আমার জানা নেই। থাকলে তার নিকট থেকে অনুমতি নিতাম। যা হোক, এই লেখাগুলো আপনার চিন্তার খোরাক যোগাবে নিঃসন্দেহে, লালন সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য আপনার পূর্ব ভাবনাকে বদলে দিতে পারে। তাই ধৈর্য্য ধরে কয়েকটি পর্ব পড়তে অনুরোধ করছি।
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতিঃ এই পদ্মা এই মেঘনা, যমুনা সুরমা নদী তটে অথবা তোমরা ভুলে গেছো মল্লিকাদির নাম সহ শত শত গানের গীতিকার ও সুরকার জনাব আবু জাফর কে অনেকেই চিনেন না। নিভৃতচারী এই ব্যক্তি এক সময় গান নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকতেন। বিশেষ করে লালন সংগীত নিয়ে। তার নিজের লেখা অনেক জনপ্রিয় গান আছে। বাংলা বিভাগে দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
প্রসঙ্গক্রমে বলি, নাটোরের বিখ্যাত লালন সংগীত শিল্পী ফরিদা পারভীনের স্বামী এই আবু জাফর লেখাপড়া করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁর লেখা তুলে ধরলামঃ
পর্বঃ ১
শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই কবিতা লেখার কাজটিকে প্রীতির চোখেই দেখা হয়। যদিও এই দেখার মধ্যে সর্বদা যে প্রীতিই প্রতিভাত হয় তা নয়, অবজ্ঞা, করুণা ও কৌতুকও মিশ্রিত থাকে। অর্থাৎ কবিরা নিজে যাই ভাবুন, বিদগ্ধ সাহিত্যপ্রেমীরা যাই বলুন- এটা সত্য যে, কবিদের সামাজিক মূল্য বিশেষ আশাপ্রদ নয়, উল্লেখযোগ্যও নয়। নোবেল পুরস্কার পেয়ে কেউ কেই আকস্মিকভাবে ধনাঢ্য ও জগদ্বিখ্যাত হয়ে যান বটে, কিন্তু সে নিতান্তই ব্যতিক্রম।
অধিকাংশ কবিই আমৃত্যু এক ধরণের অবহেলার মধ্যেই জীবন যাপন করেন। অবশ্য একালের কবিরা যেহেতু একটু চতুর প্রকৃতির, তাঁরা কবিতার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকেও যথোচিত মনোনিবেশ করেন। তাঁরা যুগপৎ শিক্ষিত, সংস্কৃতিসেবী-ব্যবসায়ী এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চর্তুদিকে সততই এমন অনুগত লাটিমের মত ঘূর্ণায়মান যে, তারাও বহু সভায় সভাপতি বা প্রধান অতিথির আসন প্রায়শ অলংকৃত করেন। কিন্তু সবাই জানে, তাঁরা নিজেরাও জানেন, এই সম্মান ও প্রতিষ্ঠার মূলধন কবিতা নয়, চাটুকারিতা ও ক্ষমতাবানদের সম্মুখে নতজানু হয়ে নিজেকে এক সহজ দ্রবণে পরিনত করার অসামান্য দক্ষতা এবং যে কবি যত চাতুর্যের সঙ্গে এই দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেন, তিনি তত বড় কবি। কবিরা এ কথায় উষ্মা প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু কথা সত্য।
অবশ্য চিরকাল এমন ছিল না। বিদূষক ধরণের রাজকবি চিরকালই ছিল, কিন্তু তার বাইরের কবিতার প্রতি সৎ ও বিশ্বস্ত এমন অনেক কবিও ছিলেন যারা কারো মন রক্ষার কথা না ভেবে এক সঙ্গে নিজস্ব আবেগে ও অনুরাগে ফুলে ফুলে উঠতেন। এরকমই একজন আত্নমগ্ন, সামাজিক স্বীকৃতির প্রতি সর্বাংশে ভ্রুক্ষেপহীন, একান্ত আবেগে আন্দোলিত একজন লোককবির নাম লালন ফকির। কেউ কেউ বলেন 'সাঁইজী'। তবে 'সাঁই' বা 'ফকির' যাই হোক, লালন যে বাউল পদরচনায় অমিত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, এবং তাঁর গানের আকর্ষণ যে খুবই দুর্বার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এবং সুর ও বাণীর সমন্বয়ে লালন যে অসংখ্য শিল্পসুষমামন্ডিত, নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ হৃদয়দ্রাবী গান উপহার দিয়েছেন, সেই উপহার বাংলাভাষী জনগণের একটি চিরায়ত সম্পদ।
কিন্তু লালনকে নিয়ে অন্য সমস্যা আছে; এবং সমস্যা একটি নয়, একাধিক। এখনো যে একটি বিষয়ের মিমাংসা হলো না, তাহলো লোকটি জন্মসূত্রে কী ছিলেন, হিন্দু না মুসলমান? নানা রকম তর্ক বির্তকের পর এখন অবশ্য মুসলমান বলেই মনে করা হচ্ছে। যারা তাকে হিন্দু বলে বিশ্বাস করেন, কান্তি ও অনীহাবশত তারা এখন অনেকটাই নীরব। লালন যে সকল গবেষকের কাছে মুসলমান তারা লালনের জন্মস্থান হরিশপুরসহ পিতামাতা, আত্নীয়-পরিজনের পরিচয়ও নির্ভূলভাবে চিহ্নিত করেছেন।
লালন নিজে অবশ্য নিজের সম্পর্কে কিছুই বলেন নি, এমনকি ভুলক্রমে গানের কোথায়ও কোনরূপ পরিচিতি প্রকাশ হয়ে পড়ে এ বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন।
অর্থাৎ খুব সচেতনভাবেই লালন তার ধর্ম ও জন্মগত পরিচয় গোপন করেছিলেন। গবেষকদের চিন্তাভাবনার পরিসরও বড়, রহস্যভেদী দুরদর্শিতাও অপরিসীম। তাদের কারও সাথেই কোন তর্কে প্রবৃত্ত হবার ইচ্ছে নেই, শক্তিও নেই। অতিশয় ক্ষীণকন্ঠে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই, প্রাণদন্ডে দন্ডিত কোন খুনী বা বড় ধরণের কোন দস্যু-তস্কর ছাড়া কোন মুসলমান কি কখনো আত্নগোপন করে? তার তো জাতি ধর্ম নিয়ে কোন ভয় নেই, হীনমন্যতাও নেই, বিনা কারণে সে কেন জন্ম ও ধর্ম পরিচয়কে সর্বদা আড়াল করে রাখবে? সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে এই ধরণের গান লেখার জন্য রহস্যময় আবরণ সৃষ্টি করার কোন প্রয়োজন হয় না; সব ধর্মকেই অস্বীকার করাই যথেষ্ট অথবা সব ধর্মকেই আপন ভেবে সর্বপ্রেমী ধর্ম নিরপেক্ষ হলেই যথেষ্ট।
আসলে লালনের এই ধরণের আত্নগোপন ইচ্ছেকৃত নয়, বাধ্যতামূলক।
ডঃ উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কথাই সর্বাংশে সঠিক, লালন ছিলেন জন্মসূত্রে একজন কায়স্থ হিন্দু এবং তার জন্মস্থান ছিল কুমারখালীর অপর পারে গড়াই নদী তীরবর্তী ভাঁড়রা গ্রামে। বর্তমান নিবন্ধকারের যুক্তি, লালনের সমসাময়িক হিন্দু সমাজ ছিল অত্যন্ত কঠোর। ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক লালন মুসলমান পরিবারে অবস্থানসহ 'অন্নজল' গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভাঁড়রায় ফিরে গিয়ে তিনি দেখলেন, তিনি কঠিনভাবে সমাজচ্যুত।
হয়ত প্রায়শ্চিত্তের কোন ব্যবস্থা ছিল কিন্তু স্ব সমাজের প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা ও ক্ষোভে এবং অভিমান নিয়ে লালন ফিরে এলেন ছেঁউড়িয়ায় তার মুসলমান আশ্রয়দাত্রীর কাছে। সমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করলো। তিনিও রক্ত-ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে পরিণত হলেন এক নবজাত-লালনে। যৌক্তিক দিক থেকে জন্ম পরিচয়হীন এই ধরণের আত্নগোপনতাই স্বাভাবিক বলে ধারণা করা হয।
আর তিনি যদি মুসলমান হতেন এবং তার জন্মস্থান হতো হরিশপুর, তিনি চাইলেও তার পরিচয় তিনি আড়াল করে রাখতে পারতেন না।
তিনি জীবদ্দশায়ই বিখ্যাত; এবং তার ছেঁউড়িয়াস্থ আখড়া থেকে হরিশপুরের দুরত্ব এমন বেশী নয়। হরিশপুর থেকে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বলতো-এ লালন আমাদেরই সন্তান। কিন্তু না, তার দীর্ঘ জীবনে এমন কথা কেউ কখনো বলে নি। অতএব দু’একজন উপাধি লিপ্সু গবেষক যত যাই বলুন, যত দলিল প্রমাণই উপস্থাপন করুন, বিশ্বাস করা খুবই কষ্টকর যে, লালনের বাড়ি ছিল হরিশপুর এবং তিনি মুসলিম সন্তান। যে এক কলমিপুঁথির অবলম্বণে লালনকে মুসলমান বানানো হয়েছে, খুবই রহস্যময় ও কৌতুককর যে সেই পুঁথিটিও কোন এক সর্বনাশা অগ্নিকান্ডে ভস্মীভূত হয়ে গেছে; এখন একটি নকল পুঁথিই সম্বল।
কিন্তু আসলটা যখন অক্ষত ছিল তখন আরেকটি নকল লেখনের কী প্রয়োজন ছিল? তারপর মূলকপিটি যখন পুড়েই গেল, হুবহু দ্বিতীয় একটি কপি তৈরী হলো কি করে? পুরো ব্যাপারটাই কোন মতলবী-নাটক নয় তো? বিশেষ করে পুঁথি বিশেষজ্ঞরা যখন ভাষা শব্দ ও অন্যান্য বিচারে উপস্থাপিত এই নকল কপিটিকে ঘোরতরভাবে সন্দেহ করেন, তখন আমাদের মত মুর্খজনেরা ভাবতে বাধ্য হয় যে, আমাদের কতিপয় উপাধিলোভী গবেষক গবেষণার চেয়ে নাটক রচনাতেই বেশী পারঙ্গম।
বলা আবশ্যক, আমার নিজের নানা কারণে আমার মধ্যে লালনের প্রতি কিছু অনুরাগ জন্মেছিল, সেই সূত্রে তার জীবন ও শিল্পকর্ম সম্পর্কে কিছু চিন্তা-ভাবনাও করেছিলাম। আমার মনে হয়েছে, আমাদের মধ্যে একজন মাত্র আছেন যিনি লালন গবেষণায় নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী, তিনি ডঃ আবুল আহসান চৌধুরী। তাছাড়া অধিকাংশই পূর্ব ধারণা ও মতলবী-উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত। তবে সুখের বিষয় আলোচ্য সমস্যাটি একটি অতিশয় লঘু সমস্যা।
এ নিয়ে কেউ কেউ জীবনপাত পরিশ্রম করলেও করতে পারেন কিন্তু এতে মেধা ও মনীষার কোন হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। লালন হিন্দু ছিলেন না মুসলমান ছিলেন, এ বিষয়ে সাধারণ জনমনে যদিও কিছুটা কৌতুহল আছে, কিন্তু এই অনাবশ্যক লঘু-কৌতুহল আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়; এবং এতে বিশেষ কিছু এসেও যায় না।
চলবে...........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।