এডিট করুন
আলম রাস্তা দিয়ে হাটছে। দুপুরের কড়া রোদ। গায়ের শার্টটা ভিজে পিঠের সাথে লেপ্টে গেছে। সকাল থেকে তাকে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। আলম একটা লন্ড্রীতে কাজ করে।
পাশাপাশি সে একজন রঙ মিস্ত্রী। কখনো কখনো কামলাও দেয়। মোটকথা যে কাজই পায় না কেন আলম তা আগ্রহের সাথেই করে। কারন তার একটা স্ত্রী আছে, একটা মেয়ে আছে , বৃদ্ধ বাবা-মা আছে এবং তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ আছে। মাঝারি উচ্চতার, শ্যামলা চেহারার হালকা পাতলা আলমকে সবাই পছন্দ করে।
ইচ্ছা করলে আমি এখন আলমের চেহারার খুটিনাটি বর্ণনা দিতে পারি ডিকেন্সের পথ অনুসরণ করে। অথবা দায়সারা ভাবে বর্ণনা এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারি।
এই লেখাটার উপরেরটুকু বেশ কয়েকদিন আগে লিখে ড্রাফট করে ফেলে রেখেছিলাম। লিখতে ইচ্ছা করছিল না, অথবা লিখতে পারছিলাম না। কষ্ট কল্পনা করে হয়তো কিছু লেখা যায়, কিন্তু তা পরীক্ষার খাতায় সুন্দর সুন্দর শব্দমালা ব্যাবহার করে, সুবিন্যস্তভাবে লেখা মুখস্ত রচনামূলক প্রশ্নের উত্তরের মত হয়ে যায়।
তাতে হয়তো নম্বরও পাওয়া যায় কিন্তু আত্মার চাহিদা আর মেটে না।
আমি সাধারণ একজন তৃতীয় শ্রেনীর ব্লগার। নিজের ভাললাগার জন্য লিখি। লেখার মান খুবই নিম্নমানের সেটা আমি নিজেই খুব ভাল করে জানি। যারা আমার লেখা ভাল লেগেছে বলে মন্তব্য করেন তারা নিতান্তই উদার ও বিশাল মনের মানুষ।
নয়তো এইসব তৃতীয় শ্রেণীর লেখা কারো পক্ষে ভাল লাগা সম্ভব নয়।
তারপরেও এইসব আবজাব কেন চালিয়ে যাচ্ছি? উত্তর একটাই, নিজের কাছে ভাল লাগে। আত্মার চাহিদা মেটে। একটা লেখা সাদা কাগজে লিখে ফেলে রাখলে ততটা ভাল লাগে না যতটা ভাল লাগে কেউ সেখানে মন্তব্য করলে। তাই স্বার্থপরের মত নিজের জন্যই লিখি।
একটা ছোট বাচ্চা যদি কাদামাটি দিয়ে একটা ব্যাকাত্যাড়া পুতুলও তৈরী করে তাও সে সেটা তার মাকে নিয়ে দেখায়। তাতে তার আনন্দ বাড়ে। আমিও সেই একই কাজটি করি। এখানে মাটির ঢেলা হচ্ছে আমার বাংলা ভাষা, পুতুলের শারীরিক গঠন হচ্ছে আমার চিন্তা ভাবনা আর পুতুল গড়ার আঙ্গুলের সাথে অতিরিক্ত যোগ হয়েছে এই কী-বোর্ড।
নিজের কথা বলছিলাম এতক্ষণ, এবার আলমের কথায় আসি।
আলম হচ্ছে সাগর ভাই। উনার আসল নাম সাগর। আমাদের কারখানার সাথের এক লন্ড্রীতে কাজ করত। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। এখন পর্যন্ত ক্লাস ভাই হচ্ছে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়।
আমি আমার সেই ক্লাস ফাইভের এক বছর প্রচুর লোকজনের সাথে মিশেছি, তাদের কথা শুনেছি। বয়স কম ছিল, তাই মানুষ আমাকে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবত না, বিশ্বাস করত। অনেকেই তার জীবনের অনেক কথা অকপটে আমার কাছে বলেছে। সবগুলো মানুষের ভেতরেই একজন দুঃখী মানুষ বাস করে। সুখী মানুষটা দুঃখী মানুষকে চাপা দিয়ে রাখে।
মাঝে মাঝে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে দুঃখী মানষটা বের হয়ে আসে। কেউ মদ খেয়ে মাতাল হলে তার ভিতরের দুঃখগুলো উগড়ে দেয়। কেউ লোডশেডিং হলে বাড়ীর ছাদে বসে বন্ধুর কাছে দুঃখগুলো উগড়ে দেয়। কেউ খোজ করে একজন নিরাপদ শ্রোতার। যে শ্রোতা তার দুঃখের কাহিনী জেনে পরবর্তীতে তাকে বিপদে ফেলবে না, হেনস্তা করবে না।
ক্লাস ফাইভের একটা কম বয়সী ছেলে, যে কিনা খুব মনযোগ দিয়ে সব কথা শোনে, এক্ষেত্রে খুবই উপযুক্ত।
তাই আমি শুধু শুনতাম, শুনতাম আর শুনতাম। মনে হত যেন গল্প শুনছি। ভালো লাগত।
মানুষগুলো জীবকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরগুলোতে আসে।
দলে দলে শ্রমিকরা এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পাড়ি দেয়। বেশীরভাগেরই লক্ষ্য থাকে ঢাকা ও তৎসংলগ্ন জেলাগুলো। কি করবে কোথায় থাকবে, কি খাবে না খাবে কিছুই না জেনে তারা রাতের বাস ধরে।
তুমার বাড়ী কই?
অংপুর।
আইছ কহন?
আইতের গাড়ি।
খাইছ কি?
উটি আর কলা।
শুনেছিলাম তাজুল ভাইয়ের কাছে। তাজুল ভাই একজন রাজমিস্ত্রী। উনি নিজেও রংপুরের লোক।
রুটি আর কলার উপর ভরসা করে চরম সাহসী এই লোকগুলো একসময় কোন না কোন এক চিলতে ছাউনির নীচে জায়গা করে নেয় রোদ বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য।
জায়গা না পেলেও সমস্যা নাই, পুরো পৃথিবীটাই তাদের জায়গা।
একসময় তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তাদের বর্তমান জীবনে। কোথাও না কোথাও ঠাই করে নেয়। বাড়ীতে টাকা পাঠায়, ঈদে কেনাকাটা করে বাড়ী যায়। মানুষ সর্বংসহা।
পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন তাকে কেউ হত্যা না করলে সে বেচে থাকে।
সাগর ভাইও বেচে ছিলেন। সাথে ছিলেন শাজাহান ভাই। উনারা দুইজন দুই জায়গা থেকে এসেছিলেন। কিভাবে যেন মিলে গিয়েছিলেন একসাথে।
মাঝে মাঝে দল তৈরী করতে হয়, নতুবা পতন আনিবার্য।
এমন হেন কোন কাজ নাই যে উনারা করতেন না। মাটি কেটে গর্ত তৈরী করা, কুয়ো খোদা থেকে শুরু করে রঙ মারা, চুনকাম করা, লন্ড্রীতে কাপড় ইস্ত্রি করা সব করতেন। তাদের মজুরী ছিল দৈনিক পঞ্চাশ টাকা। খেতেন লন্ড্রীর মালিকের বাসায় আর বিনিময়ে লন্ড্রীর কাপর ইস্ত্রি করতেন রাত্রের সময়টুকু।
মাঝে মাঝে লন্ড্রীর মালিক হয়তো বিশ ত্রিশ টাকা ধরিয়ে দিত মজুরি হিসেবে, আর তাদের রাত্রে ঘুমানোর সুযোগ দেওয়া হত লন্ড্রীতে। জীবন এভাবেই চলে যায় কর্মব্যাস্তভাবে। সকলেই চিরতরুণ, সকলেই কর্মে উৎসাহী, সকলেই কাজে ব্যাস্ত।
কল্পনা করুন কোন একটি সকালের কথা। সকালে আধা ঘন্টা হালকা বৃষ্টি হয়েছে।
আশেপাশের সবগুলো গাছের পাতা ধুয়ে পরিষ্কার সবুজ উঠেছে। একটা পাতার উপরেও ধুলিবালির আস্তরণ নেই। একসময় সূর্য উঠল। পরিষ্কার আকাশে সূর্যের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিটি গাছ যেন এক একটা উজ্জ্বল সবুজের ভান্ড হয়ে উঠেছে।
গাছগুলোর পাতা থেকে ঠিকরে পড়ছে আলো, প্রতিফলিত হচ্ছে। যেটুকু পানি জমা হয়েছিল মাটির উপর তা ইতিমধ্যে মাতি শুষে নিয়েছে। পরিষ্কার রৌদ্রজ্জ্বল একটি দিন। শাজাহান ভাই চুক্তি নিয়েছেন মাটি কাটার। মাটি কেটে সাড়ে চারফুট বাই সাড়ে চারফুট গর্ত করতে হবে কতগুলি।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন দৈনিক মজুরি হিসাবে নিবি নাকি গর্ত প্রতি চুক্তি হিসাবে নিবি। দৈনিক মজুরী পঞ্চাশ টাকা আর গর্ত হিসাবে নিলে পয়ত্রিশ টাকা প্রতি গর্ত। দর দস্তুর করে চল্লিশ টাকা ঠিক হল প্রতি গর্ত। কঠিন লাল মাটি। শাহাজাহান ভাই গর্ত খোড়ার কাজে লেগে গেলেন।
ঐদিকে সাগর ভাইকে দায়িত্ব দেওয়া হল পুরানো ঘরগুলি থেকে বাতিল মালামাল পরিষ্কার করে চুনকাম করার। শাহাজাহান ভাই একটা কোদাল আর টুকরি নিয়ে কাজে লেগে গেলেন। মাটিতে ধমাধম কোপ পড়ছে। ঐদিকে সাগর ভাই ধুলা থেকে বাচার জন্য একটা কাপড় মুখে পেচিয়ে ঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেলেন। সবাই ব্যাস্ত।
আমি ঘুরে ঘুরে একবার এইখানে যাই একবার ঐখানে যাই। ভাবলাম মাটি কাটি কতক্ষণ। আমিও একটা কোদাল আর একটা টুকরি নিয়ে শাজাহান ভাইয়ের কাছে এসে বললাম, শাজাহান ভাই পরের গর্তডা কোনখানে খুড়তে হইব দেখায়া দেন। শাজাহান ভাই কোদাল দিয়ে চারকোনা একটা বর্গ একে দিল। আমি কতক্ষণ খুড়লাম।
আধা ঘন্টা পরে দেখি একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। মাটি কাটা খুবই পরিশ্রমসাধ্য একটা কাজ। কোদাল ভাল না হলে কষ্ট আরো বেড়ে যায়। কোদালের বাট হতে হবে হালকা নয়তো অতিরিক্ত পরিশ্রম হবে কোদাল ওঠাতে। আর কোদালের বাটে যেখানে হাতে দিয়ে ধরতে হবে সেখানে কাপড় পেচিয়ে নিতে হবে।
নয়তো কিছুক্ষণ পরেই হাতে ফোস্কা পড়ে যাবে আর পরিশ্রম বেড়ে যাবে। এই কাজে সবচেয়ে বেশী চাপ পড়ে কোমড়ের উপর। কোমর বা মাজা পুরা ব্যাথা হয়ে যায় মাটি কাটতে গিয়ে।
আধা ঘন্টা পরে কতক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। মাটি কাটার শ্রমিকরা প্রায়ই বিশ্রাম নেয় কিছুক্ষণ পর পর।
অবশ্য সব শ্রমিকরাই বিশ্রাম নেয়, তবে মাতি কাটার শ্রমিকদের বিশ্রামের সময় একটু দীর্ঘ হয়ে থাকে। আর যদি মাটি কাটতে হয় দুপুরের খাড়া তপ্ত রোদের নিচে দাঁড়িয়ে তাহলেও অবস্থা শেষ। চৈত্র মাসে অনেক শ্রমিককে আধা বেলা কাজ করে কাজ ছেড়ে দিতে দেখেছি শুধু এই খরতাপ রৌদ্রের জন্য। সকল মানুষের সবদিকে একটা সীমা আছে। সব কাজেই সে একটা সীমায় বাধা পড়ে, সীমার বাইরে সে আর যেতে পারে না।
শাজাহান ভাইও বাধা পড়েন। আমি চেষ্টা করি তার সাথে পাল্লা দিয়ে গর্ত খোড়ার কিন্তু আমি তখনও যে ইস্কুলে পড়ি সাধে কুলোলেও সাধ্যে কুলোয় না। আমার হাত আর মাজার বয়স অনেক কম শাজাহান ভাইয়ের তুলনায়। সূচক অথবা ঘাত ফাংশানের গ্রাফের মত আমি এক্স অক্ষ আর শাজাহান ভাই ওয়াই অক্ষ।
বারোটা পর্যন্ত মাটি কাটলাম।
স্কুলে যেতে হবে। আমি সাগর ভাইকে যেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "চুন কখন মারবেন?" কারণ চুন মারায় আমার বড়ই আগ্রহ। সাগর ভাই বললেন, "আজকে হয়তো চুন মারা হইব না। " আমি স্কুলে চলে গেলাম। স্কুল থেক ফিরে এসে দেখি শাজাহান ভাই আর সাগর ভাই দুইজনে মিলে ঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গিয়েছে।
গর্ত খোড়া হয়েছে একটার এক তৃতীয়াংশ। মানে চল্লিশ টাকার কাজও হয় নাই। হওয়ার কথাও না। শাজাহান ভাই বেশ ভালই বিশ্রাম নিয়েছেন। দুপুরে নাকি এক ঘন্টা ঘুমিয়েছেনও।
যেহেতু চুক্তি দিয়ে দিয়েছেন তাই বাবা আর কাজের দিকে খেয়াল রাখেন নি।
শাজাহান ভাই খুব সৌখিন মানুষ। চেহারায় প্রচন্ড ফর্সা, স্বচ্ছল ঘরের সন্তান। কিছুদিন আগে বিয়ে করেছেন। হাতে একটা সোনার আংটি থাকে সবসময়।
উনার বিয়ের আংটি। ভাইয়েরা উনাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দিয়েছে। কারণ উনার ভাইদের ভাষায় উনি একজন ভাদাইম্মা। শুয়ে বসে দিন কাটানোই উনার প্রিয় কাজ। বসিয়ে বসিয়ে ভাইয়েরা উনাকে আর উনার বউকে খাওয়াতে রাজী না।
তাই বাকী ভাইয়েরা একসাথে থাকলেও উনি আলাদা। বাড়ি থাকাকালিন জমিজমা বিক্রি করে চলেছেন। তার সৌখিনতার দরুন কিছুদিনের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়। পরবর্তীতে বউয়ের ঝাড়ি খেয়ে জীবিকার তাগিদে ঘুরতে ঘুরতে এখানে আসেন। তার হাতের মূল্যবান ঘড়িটা জানান দেয় যে উনি এখন মাটি কাটলেও কিছুক্ষন আগেই একজন ফুলবাবু ছিলেন।
চলবে............(জানিনা চলব কিনা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।