If you donot see bangla, download: http://www.omicronlab.com/avro-keyboard-download.html
পূর্বনির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা এসে দরজায় কলিংবেল বাজাতে লাগল। সবসময় পরীক্ষার আগেরদিন মনে হতো, আর যদি একটা দিন পরীক্ষাটা পেছাতো, তবে এ+ এক্কেবারে নিশ্চিত। এবারে অনুভূতি একটু ভিন্ন। মনে হচ্ছিল, পরীক্ষাটা যদি কেউ একটু মাসখানেক পেছাতো তবে অন্তত পাসের কথাটা একবার চিন্তা করা যেত। ‘পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করাটাই মূলকথা’, ‘পাস-ফেল জীবনের অংশ’, ‘এবার যাচ্ছি বিদেশি পর্যবেক্ষক হিসেবে শুধুই দেখতে’, এ ধরনের নানান দিব্যবাণী মাথায় নিয়ে, হাতে রুলটানা কাগজ ও একটা কলম নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকলাম।
পিএইচডি কোয়ালিফায়ার এক্সামেও নিজের কাগজ নিজেই নিয়ে যেতে হচ্ছে শুনে অবাক হবার কথা। কিন্তু আমেরিকার অনেক জিনিসই আজব, তাই ইদানিং আর অবাক হইনা। সেদিনের পরীক্ষা ‘থিওরি’র ওপর। থিওরি বলতে বুঝায় এ্যাল্গোরিদম, থিওরি অফ কম্প্যুটেশন এসব। ঢুকে দেখতে পেলাম অগণিত পরিচিত বিমর্ষ মুখ।
চোখ-মুখের আতঙ্ক দেখে ঠিক ঠিক ক্লাসিফাই করা যাচ্ছে কে কোন ইয়ারের স্টুডেন্ট। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত তৃতীয়বর্ষের গ্রাডরা কারণ ওদের এবার পাস করতেই হবে, আর থিওরি হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন বিষয়। দ্বিতীয়বর্ষের স্টুডেন্টরা সে তুলনায় বেশ ফুর্তিতে আছে। এরা আগেরবার পাস না করতে পারলেও, একবার পরীক্ষা দিয়েছে বিধায় পরীক্ষাভীতিটা নেই। যেমন, ক্লেয়ার এসেছে দেখলাম রাজ্যের যত খাবার-দাবার আছে সব নিয়ে।
বার্গার, চিপস, বিস্কিট, জুস, পেপসি, কিচ্ছু বাদ নেই। পাঁচ ঘন্টার পরীক্ষা, তাই এত প্রিপারেশন। আগেরবার বোধহয় ক্ষুধার্ত থাকায় পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। তাৎক্ষণিকভাবে মেয়েটাকে ‘ফুড সার্ভার’ নামকরণ করা হলো। তাকে এখন আমরা সবাই এ নামেই চিনি।
ব্লেইক-কে দেখা গেল তার স্বভাবজাত স্টাইলে উচ্চস্বরে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে লাফিয়ে লাফিয়ে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছে। সে যা পোশাক পরেছে বা বলা উচিত ব্যস্ততার কারণে যে পরিমাণ পোশাক পরার সময় পায়নি, তাতে মনে হলো আজকে অনেকেরই পরীক্ষায় মনোযোগ রাখাটা দুরূহ হবে। আমাদের ব্যাচের সিরিয়াসতম আঁতেল, লুথারকে দেখলাম ফার্স্ট বেঞ্চে বসে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। এই ব্যাটার সাথে আমাদেরই আরেক ছাত্র ড্যারেকের গলায় গলায় বন্ধুত্ব থাকায় আমরা আড়ালে এ দুজনকে ডাকি ‘সম। নামটা আমি দিইনি, এটা এনামুলের আবিষ্কার।
তবে যে কেউ এদেরকে ক্লাসে একসাথে দেখলে এই নামই দিত বলেই আমার ধারণা। একবার তো অপারেটিং সিস্টেমস ক্লাসে প্রফেসর মার্টি রসিকতা করে বলেই ফেলেছিল- কী ব্যাপার ড্যারেক আজকে যে ক্লাসে বেশ চুপ- ওও লুথার নেই আজকে মনে হচ্ছে। পরীক্ষার টেনশনে আজ প্রথম দেখলাম দুজন দুই বেঞ্চে বসেছে। এরকম প্রায় জনা তিরিশেক ছাত্র-ছাত্রী এসেছে পরীক্ষা দিতে। প্রফেসর জ্যাক ডেভিডসন ঠিক বিকেল চারটায় এসে প্রশ্নপত্র দিয়ে চলে গেলেন।
যাবার সময় বলে গেলেন, যার লেখা শেষ হবে সে যেন নিজেই অফিসরুমে গিয়ে খাতা জমা দিয়ে আসে। ইউভিএ’র এই বিষয়টা খুবই অদ্ভুত। পরীক্ষায় কোন গার্ড থাকবেনা, নিজেই নিজের গার্ড। আমি ইচ্ছে করলে পরীক্ষা ফেলে আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে আবার পরীক্ষায় বসতে পারি। তবে সচরাচর কেউ নিয়ম ভঙ্গ করেনা, কেননা ধরা পড়লে শাস্তি খুবই ভয়াবহ।
‘সচরাচর’ বলছি একারণে যে, আমাদের রিসার্চ গ্রুপের এক মহা ফাঁকিবাজ চায়নিজ ছেলেকে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ব্যাটাকে দেখেছি সব পরীক্ষায়ই অন্তত তিন-চার বার বাথরুমে যায় আর প্রতিবারই দশ-পনের মিনিট পর ফেরত আসে। আমি ঠিক করেছিলাম, একবার ব্যাটার পিছু পিছু আমিও যাব দেখার জন্য যে সে কোথায় যায়। কিন্তু সে যে কখন চুপচাপ রুম থেকে বেরোয়, সেটা টের পাওয়াই মুশকিল।
থিওরি পরীক্ষা শেষে মনে হলো কোনমতে উৎরে গেছি।
বেশিরভাগ প্রশ্নই বইয়ের বাইরে হলেও প্রশ্নগুলো বেশ মজার ছিল। যেমন, একটা প্রশ্ন ছিল, দুটো ট্রেন আর একটা পাখি নিয়ে। ট্রেন দুটো একে অন্যের দিকে ছুটে আসছে, আর পাখিটা তাদের মাঝে ছুটোছুটি করছে। এখন প্রশ্ন হলো, ট্রেনদুটো সংঘর্ষের সময় পাখিটা কতটুকু দূরত্ব উড়বে? খুবই সহজ অঙ্ক। ক্লাস ফাইভের একটা বাচ্চারও এটা পারার কথা।
কিন্তু আমি পড়ে গেলাম চিন্তায়। এত সহজ অঙ্ক পিএইচডি কোয়ালিফায়ারে আসতে পারেনা এটা ভেবে প্রশ্নের প্রতিটি বাক্য বার বার পড়তে লাগলাম। শেষমেশ যতভাবে এটাকে সমাধান করা সম্ভব সবরকম ভাবে করে দিয়ে আসলাম অঙ্কটা। পরীক্ষা শেষে বেরিয়ে শুনতে পাই কমবেশি সবাই প্রশ্নটায় অবাক হয়েছে। মুনির বলল, সে রিকারসিভ ফর্মুলা বের করে একটা সি-প্রোগ্রামও লিখে দিয়ে এসেছে! এনামুল আরও সুন্দর কাজ করেছে।
সে দু-তিন পৃষ্ঠা জুড়ে ট্রেন, পাখি, ইত্যাদি এঁকে প্রতি মুহূর্তে কে কতটুকু যাচ্ছে এভাবে করে উত্তর বের করেছে। আবার অনেকে শুনলাম, কনফিউজড হয়ে অঙ্কটা করেইনি! আমি হয়ত ব্যাপারটা বোঝাতে পারছিনা সবাই কেন এমন বিচিত্র বিচিত্র কাজ করেছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য একটা থট এক্সপেরিমেন্ট করা যেতে পারে। যেমনঃ বুয়েটের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় যদি পুরো পঁয়ত্রিশ মার্কের একটা প্রশ্ন দেয়া হয়ঃ ২ + ২ = কত? তবে আমার ধারণা, শতকরা একশভাগ ছাত্র-ছাত্রী এটাতে কনফিউজড হয়ে একই রকম বিচিত্র বিচিত্র কাজ করবে। কিছু ছাত্র হয়ত সঠিক উত্তর হিসেবে ২+২=৪ লিখবে।
কিন্তু তারপরও পুরো পরীক্ষা জুড়ে বিষয়টা তাকে বিব্রত করবে এবং সে অন্য প্রশ্নোত্তর রেখে বার বার এটার দিকে তাকাবে ও অনেক সময় নষ্ট করবে। হয়ত আমাদের ক্ষেত্রেও প্রফেসর আভিশেলাত এই মজাটাই করেছেন। সত্যি বলতে কি, আমি বাসায় ফিরেও এটা নিয়ে বেশ সময় নষ্ট করেছি এবং শেষমেষ ইন্টারনেট ঘেঁটে আবিষ্কার করেছি প্রশ্নটা মাইক্রোসফটের ইন্টারভ্যূতে একবার ক্যান্ডিডেটদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল শুধুই তাদেরকে ভড়কে দেয়ার জন্য। আমার হাইপোথিসিস যে, আভিশেলাত ওই ইন্টারভ্যুতে ফেল মেরে বিষয়টা এখন আমাদের ওপর অ্যাপ্লাই করছে।
আরেকটা মজার প্রশ্নের কথা না বললে মনটা খচ খচ করছে।
এটা পাঠকদের জন্য একটা ধাঁধাঁ বলা যেতে পারে। প্রশ্নটা হচ্ছে দুটো কম্পিউটার প্রোগ্রাম নিয়ে। সাধারণ দুটো প্রোগ্রাম- কোন ইনপুট আউটপুট নেই। শুধু একটাই ব্যাপার যে প্রোগ্রাম দুটোর একটা কম্পিউটেশন শেষে থামে (হল্ট করে), আর আরেকটা কখনই থামেনা (হল্ট করেনা); এখন আপনাকে একটা পদ্ধতি (অ্যালগোরিদম) বলতে হবে যেটা দিয়ে সবসময়ই ডিটেক্ট করা যাবে কোন প্রোগ্রামটি থামে আর কোনটি থামেনা, অথবা প্রমাণ করতে হবে যে এধরনের কোন অ্যালগোরিদম থাকা সম্ভব নয়। আমার খচ খচ ভাবটা এখন পাঠকের মনের ভেতর ঢুকিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি।
বাকি পরীক্ষাগুলোর দিকে এখন একটু নজর দেয়া যায়।
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় হাতে উল্কি আঁকা আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ জেসন এসেছে পরীক্ষা দিতে। তার বোধহয় এই একটা পরীক্ষাই বাকি। এই পরীক্ষার সিলেবাস এত বেশি বড় যে ছাত্ররা সাহসই পায়না এই পরীক্ষায় বসতে। একটা ছোট্ট রুমে ডাইনিং টেবিলের সাইজের একটা টেবিলে গোল করে আমরা জনা দশেক পরীক্ষার্থি বসেছি।
আমার ঠিক বাম পাশেই জেসন। ছেলেটার বৈশিষ্ট্য, সে তার প্রতিটি কথার শেষেই অদ্ভূত একটা অট্টহাসি জুড়ে দেয়। এনামুলের ভাষ্যমতে, মন খারাপ থাকলে এই ছেলেটার সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলা উচিত। ওর অট্টহাসিতে নাকি যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। সেদিন আমারও টেনশনে মনটন ভালো নেই।
খামাখা পাঁচ ঘন্টা সময় নষ্ট করার জন্য পরীক্ষা দিতে এসেছি। ফার্স্ট ইয়ারের বোধহয় শুধু আমিই গেছি পরীক্ষা দিতে। আমাকে দেখে জেসন আমার সাহসের বেশ প্রশংসা করল এবং একই সাথে পাস করতে পারবনা বলে আগাম সমবেদনাও জানাতে লাগলো। প্রশ্নপত্র দেখে আমার মধ্যেও সে ধারণা বদ্ধমূল হলো। খাতা-কলম গুটিয়ে উঠে যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না।
দামি কোন রেস্টুরেন্টে প্রথমবারের মত ঢুকে খাবারের মেন্যুতে দাম দেখে যে অনুভূতিটা হয়, আমার সেটা হতে লাগলো। এসব ক্ষেত্রে বেরিয়ে আসার সময় রেস্টুরেন্টের বেয়ারারা যে একটা হাল্কা হাসি উপহার দেয়, সেটা হজম করা খুবই কষ্টকর। এখন পরীক্ষা ছেড়ে উঠে গেলে সবাই আমার দিকে রেস্টুরেন্টের বেয়ারার মত তাকিয়ে মুচকি হাসি দেবে। এই ভয়ে আমি আর উঠতে পারলাম না। নিরুপায় হয়ে গোড়া থেকে প্রশ্নগুলো পড়তে লাগলাম।
প্রথম প্রশ্নে লেখা- ‘ব্রুকসের মতে কন্সেপচুয়াল ইন্টিগ্রিটি একটি গুরূত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু আজকের ওপেন সোর্সের যুগে এই ব্যাপারটি কী করে সম্ভব ...’- এধরনের একটি প্রশ্ন। বিড় বিড় করে চিন্তা করতে লাগলাম, কন্সেপচুয়াল ইন্টিগ্রিটি তো পরের জিনিস, এই ব্রুকস ব্যক্তিটা যে কে ছিল সেটাই মাথায় আসছে না। আমার কথা জেসন শুনে ফেলেছে। শোনামাত্রই সে হো হো করে হাসতে হাসতে সবাইকে জানাতে লাগলো, ব্রুকসকে চেনেনা এরকম একজন এসেছে আজকে পরীক্ষার হলে। আমাকে সে এক প্যাকেট বিস্কিট এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা খেতে থাক, পরীক্ষা শেষে বুঝিয়ে দেব ব্রুকস কে।
বেয়ারার হাসির ভয়েই হোক, আর বিস্কিটের লোভেই হোক, টানা পাঁচ ঘন্টা দাঁতে দাঁত চেপে ইনিয়ে বিনিয়ে নানান প্রশ্নের উত্তর করব বলে মনস্থির করলাম। এটা হচ্ছে প্রশ্নকর্তার প্রতি আমার এক ধরনের প্রতিশোধ। সে যেমন বিভিন্ন খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে আমাকে বিব্রত করার চেষ্টা করেছে, আমিও তেমনি ঝাপসা ঝাপসা আনসার করে তাকে দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দেয়ায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম। পারি আর না পারি, যতক্ষণ কলমে কালি আছে ততক্ষণ কিছু না কিছু লিখতে থাকলাম। টানা চার ঘন্টা লেখার পর এক পর্যায়ে বুঝলাম হাত দিয়ে আর কলম ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা।
খাতার আকৃতি দেখলাম সেটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। আল্লাহর নাম নিয়ে হলুদ খামের ভেতর পৃষ্ঠাগুলো ভরে প্রফেসর ডেভিডসনের রুমের দিকে ছুটলাম। পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী তার রুমের দরজার নিচে দিয়ে খামটি ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে আশ্বস্ত হলাম, যাক, আরেকটা পরীক্ষা শেষ।
দেব কী দেব না, যাব কী যাব না, এরকম নানান টালবাহানা করতে করতে বাকি পরীক্ষা গুলোতেও উপস্থিত হলাম। সত্যি বলতে কি, প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এমন ছিল যে, বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরেই কিছু না কিছু লেখা সম্ভব।
হয়ত পুরোটা সঠিক হবেনা কিন্তু বেনিফিট অফ ডাউটের ভিত্তিতে কিছু নম্বর পাওয়া যাবে- এ ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে গেছে ততদিনে। এর সাথে সাথে কিছু টেকনিকও বের করে ফেলেছিলাম যা কিনা সব পরীক্ষাতেই কাজে লাগছিল। যেমন, প্রশ্নে যা-ই জানতে চাওয়া হোক না কেন, শুরুতেই প্রশ্নের ভেতরের বিভিন্ন কী-ওয়ার্ড গুলোর সংজ্ঞাসহ উদাহরণ দেয়া শুরু করতে হবে। ধরাযাক, প্রশ্নকর্তা জানতে চেয়েছে, ‘খেজুরের রস কী করে তৈরি হয়?’ এর উত্তরে প্রথমেই সুন্দর করে খেজুরের সংজ্ঞা দিতে হবে। এরপর প্রয়োজনে একছড়া খেজুর এঁকে লেবেলিং করে বিভিন্ন পার্টস দেখিয়ে দিয়ে হবে।
তারপর ‘রস’ জিনিসটা কী সেটাকে এক্সপ্লেইন করতে হবে। ফাইনালি, সঠিক উত্তর যদি জানা না থাকে, তবে অন্য কোন ফলের রস কী করে তৈরি হয় সেটার আদলে পুরো প্রসিডিউরটা লিখে দিতে হবে। এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ পরীক্ষিত। নেহায়েত কট্টর কোন শিক্ষক না হলে এই পদ্ধতিতে যে কোন প্রশ্নে শতকরা ষাট থেকে আশি ভাগ নম্বর পাওয়া সম্ভব। প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ ও কম্পাইলার পরীক্ষায় এই ‘খেজুর পদ্ধতি’ আমার বেশ কাজে লেগেছিল।
আমি বুয়েটের ছাত্র বিধায় কম্পিউটার সায়েন্সে আমার মাতৃভাষা হচ্ছে ‘সি’ প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ। কিন্তু কোয়ালিফায়ার এক্সাম যে বইটির ওপর সেটাতে লেখক প্রায় শ’খানেক প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করেছেন। এই পরীক্ষায় তাই যে প্রশ্নই আসুক না কেন আমি সবকিছুর আনসার করছিলাম সি এর জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে। উদাহরণ স্বরূপ, ‘মেমরি’ নিয়ে কোন একটা সমস্যার কথা প্রশ্ন করা হলে, আমি বসে বসে চিন্তা করে বের করতাম সি-প্রোগ্রামিংয়ে মেমরি নিয়ে কি কি ঘটে, ইত্যাদি। তারপর সেটার উপর ভিত্তি করে আন্দাজ করার চেষ্টা করতাম প্রশ্নে যেটার কথা জানতে চাওয়া হয়েছে তাতে জিনিসটা কেমন হতে পারে।
এরপর একটা কিছু লিখলে দেখা যেত শতকরা আশিভাগ ক্ষেত্রে আন্দাজ সঠিক হয়েছে! এই পদ্ধতি কাজ করার মূল রহস্য হচ্ছে, সব প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজেরই ভেতরকার থিওরেটিক্যাল স্ট্রাকচার মূলতঃ একি। সবগুলোই ঘুরে ফিরে সেই আমাদের মত মানুষেরই তৈরি। … বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির সবকিছুর মাঝের নিখুঁত মিল থেকেও কিন্তু এরকম কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। বুদ্ধিমান মানুষেরা সহজেই সেটা বুঝার কথা। মাথায় ঘিলু না থাকলে বোঝাটা একটু মুশকিলই বৈকি।
পরীক্ষার দিনগুলো বিভিষিকার মত আসলেও, সুন্দর কিছু স্মৃতি দিয়ে বিদেয় নিল। নতুন নতুন অনেকের সাথে এই পরীক্ষার দিনগুলোতে পরিচয় হলো। পাঁচ ঘন্টার পাঁচটি পরীক্ষায় প্রতিদিনই অনেক কিছু জানলাম ও শিখলাম। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো নিজের জ্ঞান কতটা সীমিত এটা বুঝতে পারা। সব পরীক্ষাতেই কিছু না কিছু লিখে এসেছি।
তারপরও পাশ হয়ত হবেনা। ঘাগু ঘাগু সব প্রফেসররা খাতার মূল্যায়ন করবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর অন্তত তিনজন ফ্যাকাল্টি আলাদাভাবে মার্কিং করবে। তিনজনই পাশমার্ক দিলে একটা প্রশ্নে পাশ পাওয়া যাবে। এভাবে করে প্রতিটি বিষয়ের সবকটি প্রশ্নে আলাদা আলাদা পাশ করতে হবে।
আমাদের অনেকেই দু-দফায় (ফল ও স্প্রিং সেমিস্টার) পাঁচটি পরীক্ষাই দিয়ে দিয়েছে। সবারই আশা, যদি একটা পরীক্ষাতেও পাশ হয় তবুও কম না। পরের বছর তাহলে সেটা নিয়ে আর চুল ছিড়তে হবেনা। রেজাল্টের দিন যতই এগোতে লাগলো আমার নিজেকে নিয়ে আশঙ্কা বাড়তে লাগল। জন্ম থেকে মাথার শোভা বর্ধনকারী শখের চুলগুলো বোধ হয় আর একটাও আস্ত থাকবে না আগামীবছর।
সপ্তাহ দুই পরের কথা। সেদিন শুক্রবার। কোয়ালিফায়ার এক্সামের রেজাল্ট দেয়া হবে। রুদ্ধদ্বার ফ্যাকাল্টি মিটিং চলছে। মিটিং শেষে প্রত্যেক স্টুডেন্টকে তার অ্যাডভাইজার পার্সোনালি রেজাল্ট জানাবে।
অ্যাডভাইজাররা নিজেরাও টেনশনে আছেন। কেননা নিজের কোন স্টুডেন্ট ফেল করলে তাদের নিজেদেরকেও ফ্যাকাল্টি মিটিংয়ে ছাত্রের সপক্ষে বা বিপক্ষে জবাবদিহি করতে হয়। ছেলেপুলে পরীক্ষায় পাশ করলে বাবা-মা যেমন খুশি হয়, মিস্টি পাঠিয়ে পাশের বাসাগুলোতে সেটা স্বগর্বে জানান দিতে হয়- প্রফেসরদের মাঝেও এখানে একই রকম অবস্থা। কখন কি সংবাদ শুনব, সেটা নিয়ে সকাল থেকে আমরা টেনশনে আছি। ঠিক দুপুর একটায় আমার অ্যাডভাইজার প্রফেসর জ্যাক স্ট্যানকোভিকের একটা ইমেইল পেলাম।
ইমেইলে শুধু দুটো শব্দঃ ‘সী মী’; জুম্মার নামাযের আগে দোটানায় পড়ে গেলাম, কই যাই? মসজিদ না ডিপার্টমেন্ট? চিন্তা করে ঠিক করলাম পরীক্ষার রেজাল্ট তো জানিই, দুনিয়া-আখিরাতের মধ্যে অন্তত একটা ভালো হোক আজকে- এটা মাথায় নিয়ে মসজিদের দিকেই ছুটলাম। এখানে নামাযের শেষে আমাদের দেশের মত হাত তুলে মুনাজাত পড়া হয়না। আজকের দিনে আমার দুআ’র খুবই দরকার। সত্যি সত্যি এত তাড়াতাড়ি যে রেজাল্ট দেবে ভাবিনি। বুঝতে পারলে অ্যাডভান্স কিছু দুআ করে রাখা যেত।
বার বার মনে হতে লাগল, আমার মা কী জানেন আজকে তার ছেলের সবচাইতে বড় পরীক্ষার রেজাল্ট? অযথা টেনশন করবেন বিধায় তাকে জানতে দিইনি পরীক্ষার কথা। এখন মনে হচ্ছে বিশাল ভুল হয়ে গেছে।
ইউনিভার্সিটির নীল বাসে করে যত দ্রুত সম্ভব ডিপার্টমেন্টের দিকে ছুটলাম। আমার সাথে আছে মুনির। তাকেও স্ট্যানকোভিক একই ইমেইল পাঠিয়েছে।
ইমেইলের হেডার দেখে বুঝতে পেরেছিলাম এক সাথে কয়েকজনকে জ্যাক একই ইমেইল করেছে। ইমেইলে ছিল দুটো শব্দঃ ‘সী মী’- এটার মানে কী হতে পারে দুজন মিলে এনালাইসিস করা শুরু করলাম। মুনিরের বক্তব্য, ‘আমরা গেছি। আমাদের কোন আশা নেই। পাশ করলে জানাতো কনগ্রাচুলেশন।
কিন্তু মেইলে লেখা- দেখা কর। এর মানে আজকে কঠিন ঝাড়ি আছে কপালে। তার মধ্যে আমরা আবার লেইট…’ মুনিরকে সমবেদনা জানাবো নাকি নিজেকে সমবেদনা জানাবো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। বাস থেকে নামতে নামতে মনে মনে নিজেকে বোঝালাম, পরাজয়ে ডরেনা বীর। আজকের দিনে নিজেকে কষ্ট করে একটু বীর ভাবতে হবে।
ব্যস, তাহলেই হলো।
করিডোরে আমরা দুজন স্ট্যানকোভিকের মুখোমুখি। তার পিছে এনামুলকেও দেখা যাচ্ছে। এনামুলের মুখবিস্তৃত হাসি। এই ধরনের হাসি সে দুই ক্ষেত্রে দেয়- (এক) অবস্থা খুব ভালো, (দুই) অবস্থা খুবই হতাশাব্যঞ্জক।
বেশিরভাগ সময়েই দ্বিতীয় কারণটাই সঠিক হয়। আজকের হাসিটা দেখে আমি একটু কনফিউজড। রান্নার ঠিক আগ মূহুর্তে এনামুল সচারচর যেমন হাসি হাসি মুখে বলে, ‘ভাইয়া, পিয়াজ কিন্তু একটাও নাই’ এই টাইপ হাসি। আরও কনফিউজড স্ট্যানকোভিকের মুখেও সেই হাসি দেখে। ভালো-মন্দ কিছু বুঝে ওঠার আগেই জ্যাক বলল, ‘কনগ্রাচুলেশান্স! ইউ গাইজ ডিড আ ওয়ান্ডারফুল জব।
নাউ, ইউ শুড ওয়ার্ক টুগেদার ফর ও’রালস। ’ আমি ঘটনাটা বুঝে ফেললাম। আমরা তিনজনই পাশ! মনে মনে মনে হল অজ্ঞান হয়ে যাব আনন্দে, কিন্তু জ্যাকের সামনে ভাব দেখালাম এসব আসলে কোন ব্যাপারই না আমাদের জন্য। পাশ তো করবো মাস্ট, পরীক্ষা দেয়াটা শুধুই ফরমালিটি ছিল আমাদের জন্য- এরকম একটা ভাব নিলাম তিনজন। জ্যাক আমাদের ‘হ্যাপি উইকএন্ড’ জানিয়ে বিদেয় নিল।
সে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেলে আমরা হৈচৈ শুরু করে দিলাম। এনামুলের কাছে জানতে পারলাম এবার আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের কেবলমাত্র চারজন ছাত্র পাশ করেছে কোয়ালিফাইয়িং এ। আমরা তিনজন ছাড়া আরেকজন হচ্ছে লুথার। ফ্যাকাল্টি মিটিংয়ে নিশ্চয়ই এটা নিয়ে আলাপ হয়েছে যে চারজনের মাঝে এবার তিনজনই বাংলাদেশি! আমরা এ ব্যাপারটিকে বেশ উপভোগ করছিলাম। ডিপার্টমেন্টে এখন বাংলাদেশের ছাত্রদের আলাদা চোখে দেখবে সবাই।
সতীর্থরা শুনলে নিশ্চয়ই ঈর্ষায় মারা যাবে। কিন্তু এর সাথে সাথে নতুন এক আশঙ্কাও ভর করল। রিটেনে পাশ করলেও ভাইভা এখনও বাকি। আমি ভাইভাতে সবসময়ই খারাপ। ভাইভার জন্য জ্যাকের কথা অনুযায়ী একসাথে প্রাকটিস করতে হবে।
এনামুলকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের হাতে সময় আছে কয়দিন। এনামুল হাসতে লাগল। ওর এই হাসিটা আমি চিনি। এর অর্থ, ‘খবর সুবিধার না’; বলল, নেক্সট ইউকেই নাকি ভাইভা। এক চিন্তা দূর হতেই নতুন এক দুশ্চিন্তার উদয় হওয়ায় একটু দমে গেলাম।
প্রথম পঁচিশ ঘন্টা তো কোনমতে পেরিয়ে গেছি। কিন্তু এখনও বাকি ভয়ঙ্কর পঞ্চাশ মিনিট। কী আছে কপালে কে জানে। আমার মনের কথাটা মুনির বেশ জোরে জোরেই বলতে লাগল, ‘কী দরকার এসব ভাইভার, খালিখালি, ধূর!’ ওর কথা ডিপার্টমেন্টের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। আমরা জানি, এই করিডোরে শত শত বছর ধরে অগনিত পিএইচডি প্রার্থী এই একই আক্ষেপ করে এসেছে।
হয়ত অনেকেই টিকতে না পেরে ঝরে গেছে। কিন্তু সেই শত বছরের পুরোনো রীতি এখনও টিকে আছে নিজস্ব দাপট নিয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।