কিছুটা কালোয়, কিছুটা সাদায়
জোছনা, তারা, সবুজের বুকে এক চিলতে জল, নিশুতি রাতে বাঁশঝাড়ে জোনাকির গান- ইদানীং বেশ ভালো লাগে বিষয়গুলো। আজ জোছনারাত। ছাদে বসে বসে আকাশের গান গাইছি- 'আকাশের ঐ মিটিমিটি তারার সাথে...'।
একদিন এভাবে গান গাওয়ার সময় পেছন থেকে তপু এসে বলেছিল, 'হেলেনা, এ-ই হেলেনা'।
'তোমার না আরো আগে আসার কথা ছিল।
'
'ছিল; তবু আসিনি। '
'কেন!'
'তোমার গান শুনতে ভালো লাগে বলে। '
'তুমি না এলে যে গান ভালো হয় না!'
তপু কথা দিয়ে আসে না। কথা না দিয়েও আসে। তপু আসুক, না আসুক, আমি প্রায় প্রতিরাত ছাদের কোণায় তপুর জন্য অপেক্ষা করি।
জোছনা হলে প্রতিরাত গভীর রাত অবধি আমাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়। পড়ার টেবিলে বসলে মনে হয়, বেচারা চুরি করে ছাদে ওঠে আমাকে না পেয়ে চলে যাবে।
আজ ধবধবে জোছনা। তারাগুলো জোছনাময় আকাশ থেকে প্রেমাচ্ছন্ন পৃথিবীতে খসে খসে পড়ছে। তপু বলত, প্রেমই পৃথিবী সৃষ্টির মূলকথা।
পৃথিবী জুড়ে যতো প্রেম, সবই স্বর্গের প্রতিধ্বনি! সত্যি বলতে কী, আজ তপু এলে পৃথিবীটা নিরেট স্বর্গীয় হয়ে ওঠবে।
তপু বলেছে, আজ নিশ্চয়ই আসবে। তবু তপু বলে কথা! অনিশ্চয়তার দোলাচলে চড়ছি আর শরীরটা ভারি হয়ে যাচ্ছে। এখনই তপু আসবে- ভাবতেই শরীরের এপার-ওপার একটা শিহরণ এসে খেলা করছে।
তপুদের বাসার সামনের রাস্তাটাকে সামনে নিয়ে ছাদের এক কোণায় বসে আছি।
অন্ধকার ভেদ করে আসা সবাইকে তপু মনে হচ্ছে। সে আসে অন্যভাবে। চোখকে ফাঁকি দিয়ে পেছন থেকে কখন চোখ দু'টো চেপে ধরে। আসলে, তপু দুষ্টু একটা ছেলে! মাঝে মাঝে রাগ করলে বলে কী- 'হেলেনা, তোমাকে আজ মেয়েলোকের মতো দেখাচ্ছে'।
আজ আমি প্রশ্ন করব, 'তপু, তারাগুলোকে তোমার কেমন মনে হয়?'
তপু বলবে, 'ঠিক তোমার মতো।
'
আমি বলব, 'হাস্নাহেনাকে?'
তপু বলবে, 'তোমার মুখ থেকে আসা কথাগুলোর অচেনা সুবাসের মতো। '
আমি বলব, 'জোছনাময় এক-একটি রজনীকে?'
তপু বলবে, 'আমাদের ভালোবাসার মতো, সীমাহীন, নিশ্ছিদ্র, প্রেমময়। '
কল্পনার একটা সাগর আছে; সে সাগরে ভাসা যায়- আগে জানতাম না। তপু প্রেমে প্রেমে সেটা আমাকে শিখিয়েছে! বসে বসে জোছনাময় রাতে একটি ছাদের কোণায় আমি আর তপুর ভালোবাসার একটি ছবি আঁকছি। সেই ছবিতে তপু হাসছে; হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে; আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে; আমি বলছি, 'না'।
রাত বাড়ছে। এরচেয়ে গভীর রাতে তপু এসেছে।
একখানা মেঘ এসে আমার গানের তারাগুলোকে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে; মনে হচ্ছে, মায়াচ্ছন্ন একটি দেহে কেউ এসে তার শীতল হাতটা এখনই বুলিয়ে দিয়ে যাবে।
হাস্নাহেনার ভুরভুরে গন্ধ আসছে গোলাঘরের পাশ থেকে; মনে হচ্ছে, অল্পক্ষণ পর অবিশ্রান্ত কোনো ঘর্মাক্ত দেহের সুঘ্রানে নেচে নেচে ওঠবে অপেক্ষমাণ কোনো মানবী।
চাঁদটা হাসছে ফালি ফালি; মনে হচ্ছে, এখনই কেউ পেছন থেকে চোখ চেপে ধরে বলবে, 'বলতো আমি কে?'; আমি বলব, 'তপু'; তপু হাসতে হাসতে বলবে, 'গাধী, আমি তপু নই, চাঁদ, আকাশের চাঁদ'।
বাঁশবাগান থেকে একগুচ্ছ জোনাকি ধেয়ে আসছে আমার দিকে; মনে হচ্ছে, আমাদের সবকিছুই দেখে ফেলবে ওরা, আর সব কথা লাগিয়ে দেবে ছাদের নিচের মানুষগুলোকে।
একঝটকা ঠাণ্ডা দখিনা বাতাসে শিরশিরিয়ে উঠেছি; মনে হচ্ছে, অল্পক্ষণ পর খেলা শেষের বেলা হবে; কান্ত আমি আর তপু গান গাইতে গাইতে বাকি রাতটা কাটাব- 'আকাশের ঐ মিটিমিটি তারার সাথে...'।
রাত বাড়ছে। তারাগুলো আগের জায়গায় নেই। আজ তপু তাহলে আসবে না! আমি সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে স্বপ্নাচ্ছন্ন হয়ে যাব; সেখানে তপুর দেখা হবে; তপুকে একটা কথা বলে দেব- সে যদি এভাবে আমাকে নিয়ে খেলা করে আমি আর এই পৃথিবীতে থাকব না।
আকাশের তারা দেখে দেখে তাকেও গান গাইতে হবে; পরজন্মে কাউকে পাওয়ার প্রতীক্ষার গান।
তপু আসছে না। তপু সম্ভবত আমার সঙ্গে রাগ করেছে। কিচ্ছু বোঝে না ছেলেটা! এটা চায়, ওটা চায়, সবই চায়। এর মধ্যে যে কোনো কোনোটা না দেয়ার থাকে, তপু সেটা বুঝতে চায় না।
এখন আমার তপুকে সবই দিয়ে দেয়ার ইচ্ছে জেগেছে। আকাশের তারাগুলোকেও আমার ইচ্ছের কথা জানিয়ে দিয়েছি! ওরা গিয়ে তপুকে কথাটা জানিয়ে দেবে। আর এখনই পাগলের মতো আমার কাছে ছুটে আসবে সে।
না, আমার মনের কথাটা তারারা তপুকে জানায়নি। অসংখ্য রাতের মতো আজ আমি বিমর্ষ বেডরুমটাকে সামনে নিয়ে গাইছি- 'আকাশের ঐ মিটিমিটি তারার সাথে...'।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।