পরিবর্তনের জন্য লেখালেখি
প্রথম পর্ব
প্রথম পর্ব থেকে দুইটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ।
১। কর্পোরেট পুঁজিবাদ চালিত হয় একমাত্র লাভ বা প্রফিটের দ্বারা , এইখানে নিয়ম নীতি , উচিত -অনুচিত , এথিকাল - নন এথিকালের বালাই নাই
২। এই মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেট গুলো অর্থনীতির লিগাল, ইলিগাল, সোসাল - সব কয়টা হাত কিনে নিয়ে নিয়ন্ত্রন করছে ।
অর্থাৎ , যেই কোম্পানি মানুষের পয়সা চুষে খেয়ে ফুলে ফেপে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে , সেই আবার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে সোসাল ওয়ার্ক করে বেড়াচ্ছে ।
মানে , ধরুন আপনার কাছে একটা গরু আছে । ঐটা দিয়ে আপনি দুধ উৎপাদন করতেন , নিজে খাইতেন , পরিবারকে খাওয়াইতেন আর বাড়তিটুকু বিক্রি করে সংসার চালাইতেন। এখন আমি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আপনার কাছ থেকে অনেক টাকায় গরুটা কিনে নিলাম । এবং দুধ আপনার কাছে বিক্রি করা শুরু করলাম , আপনিও কিনতে বাধ্য কারন আপনার নিজের আর গরু নাই। আপনি টাকার লোভে গরু বিক্রি করে দিলেও কিছু দিন পরেই ভুলটা বুঝলেন, টাকা তো চিরদিন থাকে না, খরচ হয়ে যাচ্ছে , কিন্তু তখন আর কিছু করার নাই ।
আপনার পয়সা ফুরায় গেলে আমার কাছেই হাত পাতলেন । আমি আপনাকে আমার মালিকানাধীন গরু যেইটা আগে আপনার ছিলো সেইটা দেখা শোনার দায়িত্ব দিলাম এমন বেতনে যেইটা দিয়ে বাচ্চা কাচ্চা দূরে থাক , আপনার নিজেরই এক গ্লাস দুধ জুটে না । এইবার আমি আমার কর্পোরেট সোসাল রেস্পন্সিবিলিটির নামে আপনারে দুধ কিনার ঋণ দিলাম। সেইটা দিয়ে আপনি নিজের বাচ্চার জন্য দুধ কেনা শুরু করলেন। আপনাকে বিক্রির কমিশন দেওয়ার লোভ দেখালাম ও ক্রেতা বাড়াতে বললাম।
অচিরেই আপনি বুঝতে পারলেন , আয় না বাড়ালে ঋণ শোধ করা যাচ্ছে না । বাচ্চার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে । আর আশে পাশের বাড়িতে যতদিন দুধ আলা গাভী থাকবে , আপনার বিক্রি বাড়বে না । আমাকে আর কিছু করতে হইলো না । বাঁচার তাগিদে আপনি আশে পাশে লোকজনকে গাভী বিক্রির জন্য মূলামূলি শুরু করলেন।
ইতমধ্যে আমার লাভের টাকা দিয়ে আমি একটি স্কুল খুললাম । আমার কাছ থেকে স্বল্পসুদে ঋণ নিয়ে সেইখানে বাচ্চা কাচ্চারে পড়াতে শুরু করলেন। সেইখানে আমি তাদের আমার সুবিধা মত উচিত, অনুচিত, ভ্যালু শিক্ষা দিলাম । কিন্তু দিনে দিনে খরচ বেড়েই চলেছে , শেষে ভিটা মাটি বন্ধক পড়লো আমার কাছে । স্বভাবতই , আমি মহান ।
তাই আপনার বউকে নিয়ে এলাম , ট্রেনিং দিলাম ও একটা মিষ্টির কারখানা বানিয়ে তাতে কাজে লাগালাম। আগে ২২ টাকা লিটারের দুধ আমি নিতাম ২০ টাকা । আপনার বেতন ছিল ২ টাকা । মিষ্টির কারখানায় দুধ বেচে এখন পান ৪ টাকা (কমিশন সহ) । বউ এর বেতন ২ টাকা ( যেহেতু মেয়ে) ।
মিষ্টির কেজি ১৪০ টাকার ১৩৬ টাকা আমার । ভুলে যাবেন না , আপনার ৬ টাকা থেকে আমাকে কিস্তি দিতে হয় কিন্তু । ধরে নেই , কিস্তি ২ টাকা । সেখান থেকে আমি রাখি ১ টাকা । বাকি ১ টাকা দেই আপনার ছেলেকে যে মাসে মাসে কিস্তির টাকা আমাকে এনে দেওয়ার কাজ নিয়েছে আমি যেই নতুন ব্যাংকটা খুলেছি সেইখানে।
ইতমধ্যে আপনার মেয়ে স্কুল পাশ দিয়েছে । আমি তাকে ট্রেনিং দিয়ে পোল্ট্রির কাজে লাগিয়েছি যেইটা আপনার আগের ভিটায়/ বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত । শিক্ষিত বলে তার বেতন আড়াই টাকা । চাইলে অবশ্য সে ঋণ নিয়ে আমার পোল্ট্রির মুরগীগুলাকে বেচার ব্যবসা করতেই পারে। এই রকম ভয়ানক পরিশ্রমের ফলে অসুখ বিসুখ হইতেই পারে ।
তাই আমি একটা হাসপাতাল দিয়েছি । সংস্থার কর্মী হিসেবে ঐখানে আপনি ৩০% ডিস্কাউন্টে চিকিৎসা পান। এর ভিতরে এলাকায় ইলেক্ট্রিসিটি নিয়ে এসেছি। আমার নতুন গার্মেন্টস আর বিড়ি সিগারেটের কারখানাইয় আপনার আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শীরা কাজ করে , যাদের গরু গুলোকে আপনিই তাদের প্রলব্ধ করেছিলেন আমার কাছে বেঁচে দিতে । এরাই আবার আমার মিষ্টি, কাপড় , বিড়ি, শিক্ষা , চিকিৎসা ইত্যাদির ক্রেতাও ।
এই গল্পটা থেকে ৩টা জিনিস শিখবেন ।
১। আপনার বেতন যতই বাড়ুক, আপনি কোনদিনই আমার মতন বড়লোক হইতে পারবেন না , আর ১৪ জেনারেশন ধরে চেষ্টা করেও পুরাপুরি ঋণ মুক্ত হইতে পারবেন না । শুভংকরের ফাঁকিটা ঐখানেই ।
২।
আপনার বেতন আমি তখনই বাড়াব যখন আমার উৎপাদিত পণ্যের ক্রেতা বাড়ানোর জন্য একটা নির্দিষ্ট ক্রয় ক্ষমতা সম্পন্ন কনজিউমার বাজার লাগবে ।
৩। আগে আপনি ও আপনার আশে পাশের সবাই গরু নামক একটি উৎপাদক যন্ত্রের মালিক ছিলো । আজকে আমি হইলাম মালিক আর আপনারা সবাই আমার ইচ্ছার অধীন , উচ্চ বেতন সম্পন্ন , মাল্টিন্যাশনালে কর্মরত গর্বিত কর্মী । পাশাপাশি আমার ক্রেতা।
আপনে যতই উপরে উঠেন, আমি মালিক, আপনি আমার চাকুরে/চাকর
এর নাম কর্পোরেট বাণিজ্য । আমি আপনাকে প্রতি পদে পদে ঠকাচ্ছি , ঠকিয়ে নিজে লাভ করছি । প্রথমে ঠকাচ্ছি বেশি দামে গরু বিক্রির লোভ দেখিয়ে ( অনেক বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন) , তারপর বেতনে , তারপর ঋণে , তারপর সুদে , তারপর ডিস্কাউন্ট দেওয়ার নামে উৎপাদিত পণ্যের বান্ধা কাস্টমার বানিয়ে , এবং পরিশেষে আপনাকে চিরদিনের জন্য ঋণে বেধে ফেলে ।
আপনার গরু , আপনার গরুর দুধ এখন একবার দুয়ানোর জন্য শ্রম দিবেন, তারপর কেনার জন্য শ্রম দেবেন , তারপর বেঁচার জন্য শ্রম দিবেন । সুতরাং, কইয়ের তেলে কইই শুধু ভাঁজছি না আমি , একটা মাত্র উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাঝে আমি আপনাকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শোষন ও করছি ।
শুরুতে এই কর্পোরেট নামক শোষক যন্ত্রটি ছোটই থাকে । আস্তে আস্তে এরা গ্রাস করে নেয় খাদ্য , বস্ত্র, বাসস্থান , শিক্ষা , চিকিৎসা, বিনোদনের মত মৌল চাহিদা মেটানোর সব কয়টা উৎপাদনের উপকরণ ।
এখন এই গ্রাস তারা কেমনে সম্ভব করে? কিছু দিন আগেও প্রধান তরিকা ছিলো যুদ্ধের মাধ্যমে দখল ও সরাসরি শোষণ। যেমন, বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত শাসন। কিন্তু এতে দেখা গেলো দুই দিন পর পর, খালি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে দেয় ফাউল পোলাপাইন ।
এইবার নতুন তরিকা । সেই ম্যাট্রিক্স ছবিটার মতন সবাইরে ঘুম পাড়ায় রাখো । তুমি মনে করবা তুমি স্বাধীন , বাস্তবে স্বাধীন না । ঠিক এই কাজটাই এখনকার মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস ওয়ার্ল্ড করে থাকে যার নাম মার্কেটিং ( আসলে ব্রেইন ওয়াশিং) । তা মার্কেটিং কাকে বলে ?
মার্কেটিং হলো সেই প্রক্রিয়া যা আপনাকে কিনতে বাধ্য করবে এমন একটা বস্তু যা আপনার কোন কালেই দরকার ছিলো না এবং অবশ্যই উৎপাদনের দশগুণ দামে ।
এখন এই মার্কেটিং এর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হইলো মিডিয়া । ২৪ ঘন্টা যেই মিডিয়া আমাদেরকে কিছু ভ্যালু বা মূল্যবোধ শিক্ষা দেয় । আপনারা হয়ত ভাবতে পারেন আপনার উপরে মিডিয়ার কোন প্রভাব নেই । কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে খুব সূক্ষ ভাবে চিন্তা করলেই দেখবেন , আজকের মিডিয়া আমাদেরকে কি দেয়? তথ্য ? বিনোদন ? নাকি শিক্ষা ?
কোনটাই না ।
মিডিয়া আমাদেরকে দেয় অর্থ বা মিনিং ।
প্রতিটা মানুষেরই মূল তিনটা প্রশ্ন থাকে , আমি কে , আমি কি এবং আমি কেন ? আমরা বেশির ভাগই হন্যে হয়ে এই প্রশ্ন গুলার উত্তর খুঁজে বেড়াই আর মাল্টি কর্পোরেশনের মার্কেটিং বিভাগ ঠিক এই উত্তর গুলাই তাদের সুবিধামত আমাদের সামনে হাজির করে । লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা এই কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের বাণিজ্যের সাথে এই ভাবেই জড়িত । তারা প্রতিনিয়ত ঠিক করে দিচ্ছে , বাংলাদেশের একজন নারী কে? কি এবং কেন ?
লাক্সের বিজ্ঞাপন অনুযায়ী ,
কে? - আমি একজন সুপারস্টার
কি? - অন্যদের চেয়ে অনেক অনেক উপরে, অনেক বেটার
কেন? - কারন আমি বিশেষ একটি ইমেজ যাপন করি
লক্ষ্য করে দেখুন, একটা মানুষের আত্মপরিচয়, অস্তিত্বের মাপ কাঠি এবং জীবন যাপনের উদ্দেশ্য বিধেয় লাক্স ঠিক করে দিচ্ছে । লাক্স আমাদের ব্রেইন ওয়াশ করে এইটা প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে একটি নির্দিষ্ট চেহারা , নির্দিষ্ট কিছু স্কিল (নাচ, ক্যাট ওয়াক, শপিং , দেহের মাপ ধরে রাখা ইত্যাদি) আমাদেরকে মানুষ হিসেবে অন্যদের চেয়ে বেশি দামী করে তুলবে । এবং আমরা তখন সুপারস্টার হয়ে যাব ।
আর সুপার স্টার হলেই আমরা মানুষের ভালোবাসা , সম্মান, প্রতিষ্ঠা , সাফল্য পাব। সেই সাফল্যের সংজ্ঞা , সেই ভালোবাসা পাওয়ার তরিকা বাতলে দিতে পারে কেবল লাক্স আর চ্যানেল আই।
আমাদের , বাংলাদেশের ২০০০ বছরের সংস্কৃতি , প্রাচ্যের দর্শন , জীবন বোধ কি বলে? আমরা কি সাফল্যের এই সংজ্ঞায় অভ্যস্ত? আমাদের হাজার বছরের জীবন ভাবনা আমাদের এতদিন শিখিয়েছে ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। মাত্র দুটি কাপড়েই জীবন ভালো ভাবে চলে যেতে পারে। অল্প খাও কিন্তু খাঁটি খাও ।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও বেশি শুকনা মেয়েদের বিয়ের সমস্যা হইত কারন আমরা একটু স্বাস্থ্যবতী বউ পছন্দ করতাম। সৌন্দর্য্যের মাপ ছিল সাদামাটা টানা টানা কাজল কালো চোখ আর খোঁপায় বেলী ফুলের মালা। টিভি মিডিয়ার বদৌলতে আমরাও শুকনা ভালোবাসতে শিখেছি । এখন ক্যাট্রিনা হইলো আদর্শ । আমাদের ভ্যালু বদলাচ্ছে ।
আমরা চাই আর না-ই চাই , আমাদের আদর্শ বদলে যাচ্ছে । শুধু বাংলাদেশ না, সারা বিশ্বের মানুষের মাথায় হাতুড়ি পিটা করে শিখানো হচ্ছে , ক্যাটরিনা মানে সাফল্য , ক্যাটরিনা মানে আদর্শ । যার সব টুকুই মিথ্যা আর ভয়াবহ রকমের প্রেজুডিসড, রেসিস্ট , পাশবিক।
এখন প্রশ্ন হইলো সারাজীবন মাল্টিন্যাশনালে চাকরী করে আমরা সবাই কি মাল্টিন্যাশনালের মালিক হইতে পারবো ?
সারা জীবন লাক্স , চ্যানেল আই এর সাথে গা ঘষাঘষি করলেই কি আমরা সবাই সুপারস্টার হইতে পারবো?
এখন এই -গ্ল্যামারই জীবনের সাফল্যের মাপকাঠি- ধরনের ব্রেইন ওয়াশে দর্শকের দেহকামনা , ধর্ষকামী ভূতের আছর আসলো কেন? এদের ভূমিকাই বা কি?
পড়ুন ৩য় পর্ব ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।