আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবদুল মালেক উকিলঃ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবদুল মালেক উকিল এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তিনি ছিলেন আস্থাভাজন। যে কারণে তিনি নোয়াখালী থেকে পাকিস্তান আমলে ৪ বার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও স্বাধীন বাংলাদেশে ৩ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে জাতির জনকের নিহত হওয়ার পর আবার মালেক উকিল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং দলকে পুনরুজ্জীবিত ও সংগঠিত করেন। আওয়ামী লীগের দুর্দিনে তিনি দলের কান্ডারী হয়ে দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯৭৮ সালে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। নোয়াখালী জেলার কৃতি সন্তান বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞ আইনজীবী আবদুল মালেক উকিলের জন্ম ১৯২৫ সালের ১ অক্টোবর। নোয়াখালী জেলার সুধারাম থানার রাজাপুর গ্রামে।

তাঁর পিতার নাম মরহুম মাওলানা মোহাম্মদ মুন্সী চান্দ মিয়া ও মায়ের নাম মরহুমা নুরুননেছা। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালা ও প্রাইমারী। প্রাইমারী পড়াশুনা শেষ করে তিনি ভর্তি হন সুধারাম থানার একটি হাইস্কুলে। ওই হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে মেট্রিক পাশ করেন।

তিনি ১৯৪৬ সালে আই এ পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র বিজ্ঞানে ভর্তি হন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে বি এ অনার্স ও ১৯৫১ সালে এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ভর্তি হন এল এল বি’তে। আই এ পড়াশুনাকালীন সময় থেকে তিনি তৎকালীন ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে বাংলা, বিহার ও আসামে প্রচারকার্যে অংশ নেন।

এই প্রচারকার্যে তিনি অসংখ্য ছাত্রদের যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে পূর্ববাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। তিনি পূর্ববাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আন্দোলনের কারণে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তাঁকে পাকিস্তান পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে আটকে রাখে। তিনি মহান ভাষা আন্দোলনের সাথে ছিলেন ঘনিষ্ঠ।

এ সময় তিনি মুসলিম ছাত্রলীগকে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তাঁকে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে আবার পাকিস্তান পুলিশ গ্রেফতার করে। এ সময় তাঁকে কিছু দিন কারা জীবন যাপন করতে হয়। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের পর জেল থেকে মুক্ত হয়ে তিনি নোয়াখালী বারে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ছাত্র আন্দোলনের নেতা পেশার পাশাপাশি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে সকল মহলে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হন।

তিনি ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এ সময় তিনি পেশার চেয়েও রাজনীতিতে বেশী করে সময় দিতে থাকেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের নোয়াখালী উপ-নির্বাচনে তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসেবে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে পূনরায় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে সর্বসম্মতিত্রুমে গণপরিষদে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে যোগ দেন। বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে তিনি ১৯৬৫ সালে তৃতীয়বারের মত প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। তিনি কমনওয়েলথ-এর সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৬ সালে পকিস্তানের লাহোর শহরে গুলবার্গে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক নিখিল পাকিস্তান জাতীয় সম্মেলনে মালেক উকিল সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি প্রথম উপস্থাপন করেন।

১৯৭০ এর নির্বাচনে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে আবদুল মালেক উকিল সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য আওয়ামী সংসদীয় দলের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের অনেক দেশ সফর করেন। He was also a member of the Relief and Rehabitation Committee of Mujibnagar Government during the Bangladesh Liberation War. স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মালেক উকিলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি ৭২’র সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন।

১৯৭৩সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত সদস্য হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীন দেশের প্রথম মন্ত্রীসভায় তিনি স্বাস্থ্য্ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের ১৪ জানুয়ারী সংসদ অধিবেশনে আব্দুল মালেক উকিলকে স্পীকার হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ২৪ জানুয়ারী সংসদ অধিবেশনে ‘হ্যা’ ভোটের মাধ্যমে জাতীয় রক্ষীবাহিনী আইন পাশ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৩ জানুয়ারী সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়।

একই দিন বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স জারি করা হয় এবং সংবিধানের কতিপয় ধারা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৬ জানুয়ারী ’৭৫ এক ঘোষণায় বলা হয় যে, সরকারি কর্মচারীরা সমবায় সমিতি ছাড়া অন্য কোন সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। এছাড়া ৪৮ ঘন্টার মধ্যে দেয়ালের সব পোষ্টার মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়। ২০ জানুয়ারী সংসদ অধিবেশন বসে।

এ অধিবেশনে বাকশাল গঠনের সিদান্ত হয়। ২৫ জানুয়ারী সংসদে কোন রকমের বির্তক ছাড়া পাশ হয় চতুর্থ সংশোধনী। সেই অধিবেশনে স্পীকার ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। ওই সংশোধনীর পক্ষে ২৯৪ জন সাংসদ ভোট দেন। কেউ বিরোধিতা করেননি।

সংসদের ২ঘন্টা ৫মিনিট স্থায়ী ওই অধিবেশনে স্পীকার ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। বিলের বিরোধিতা করে তিনজন বিরোধী ও একজন স্বতন্ত্র সদস্য ওয়াক আউট করেন। এরা হলেন জাসদের আবদুল্লাহ সরকার, আব্দুস সাত্তার ময়নুদ্দিন আহমেদ ও স্বতন্ত্র সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আতাউর রহমান খান আগেই সংসদ অধিবেশন থেকে বেরিয়ে আসেন। বাকশালের কার্যনির্বাহী পরিষদে থাকেন: (১) শেখ মুজিবর রহমান (২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম (৩) মনসুর আলী (৪) খন্দোকার মোশতাক আহমেদ (৫) আবু হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (৬) আব্দুল মালেক উকিল (৭) অধ্যাপক ইফসুফ আলী (৮) মনরঞ্জন ধর (৯) মহিউদ্দিন আহমেদ (১০) গাজী গোলাম মোস্তফা (১১) জিল্লুর রহমান (১২) শেখ ফজলুল হক মনি (১৩) আব্দুর রাজ্জাক।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় জাতীয় চার নেতার একজন সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেশের উপ-রাষ্ট্রপতি ও আব্দুল মালেক উকিল স্পিকার ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে পঁচাত্তরের ৩রা নভেম্বর অন্য তিন নেতার সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদের হাতে জাতির জনকের নিহত হওয়ার পর আবার মালেক উকিল আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং দলকে পুনরুজ্জীবিত ও সংগঠিত করেন। আওয়ামী লীগের দুর্দিনে তিনি দলের কান্ডারী হয়ে দলকে সুগঠিত করেন এবং ১৯৭৮ সালে তিনি দলের সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর প্রায় তিন বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসিত হয় অনির্বাচিত সরকার দ্বারা।

সে সময় দেশ পরিচালনা করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে অংশ নিয়ে মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত সদস্য হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালের ১৮ অক্টোবর তিনি মারা যান।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.