লড়াই করে জিততে চাই
নাসিরউদ্দিন হোজ্জা নিজের মতো করেই পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাত দেখলেন পথের পাশেই একদল ছেলে জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। নাসিরউদ্দিন হোজ্জা ছেলেদের দলটার আরো একটু কাছাকাছি আসতেই ছেলেরা তাকে হাত উচিঁয়ে ডাক দিলো। তাদের কাছে যাওয়ার অনুরোধ করলো। হোজ্জা সাহেব পন্ডিত ব্যক্তি হিসাবে সবার কাছেই পরিচিত।
তাই ছেলেগুলোও হোজ্জা সাহেবের সহায়তা নিতে চাইলো।
নাসিরউদ্দিন হোজ্জা ছেলেগুলোর কাছে গেলেন। ছেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করলেন, কি সমস্যা তোমাদের? আমাকে ডাকলে কেন?
ছেলেরা তাদের রুটিগুলো দেখালো। বললো, তারা গ্রামের এক লোককে সবাই মিলে কাজে সাহায্য করেছে। লোকটা খুশি হয়ে তাদের কিছু পয়সা দিয়েছে।
সেই পয়সা দিয়ে তারা দোকান থেকে রুটি কিনে নিয়ে এসেছে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রুটি ভাগকরা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েছে তারা। লোকের চেয়ে রুটির পরিমাণ কম। লোক আট জন অথচ রুটি ৭টি। সবাইকে খুশি করে কিভাবে রুটি ভাগ করা যায় তা তারা বুঝতে পারছে না।
এই কঠিন কাজটাই তারা নাসিরউদ্দিন হোজ্জাকে করতে অনুরোধ করলো।
নাসিরউদ্দিন হোজ্জা বেশ খুশিই হলেন ছেলেদের কথা শুনে। বললেন, এ তো খুব সোজা কাজ। ৭টি রুটি ৮ জনে ভাগ করে খাবে। সমস্যা কোথায়?
ছেলেরা বললো, না! ভাগটা আপনিই করেন।
তাহলে আর কারো কোন আপত্তি থাকবে না। আমরা সবাই শ্রম দিয়েছি, তাই এই ইনামও সবারই প্রাপ্য।
নাসিরউদ্দিন একটু চিন্তা করলেন! তারপর বললেন, আচ্ছা! ভাগ করার দু’টি নিয়ম প্রচলিত আছে। একটা আল্লার নিয়ম! অন্যটা মানুষের নিয়ম। তোমাদের রুটি আমি কি আল্লার নিয়মে ভাগ করবো? না মানুষের নিয়মে?
ছেলেরা উত্তর দিতে একটু ইতস্তত বোধ করলো! এ ওর দিকে একটু মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো! এর মধ্যে একজন বলে উঠলো আল্লার নিয়মে ভাগ করাই তো ভালো।
তারপর সবাই একসাথে বললো- হ্যা হোজ্জা সাহেব আপনি আল্লার নিয়মেই রুটিগুলো ভাগ করেন!
হোজ্জা ৭টি রুটি নিজের হাতে নিয়ে নিলো। তারপর প্রথমে যে ছেলেটা আল্লার নিয়মে ভাগ করার পক্ষে কথা বলেছিলো তাকে আস্তো তিনটা রুটি দিয়ে দিলো। ছেলেটার চোখ তো ছানাবড়া। সে যদি তিনটা পায় অন্যরা কি পাবে!
তারপর হোজ্জা অন্য একটি ছেলেকে দুইটা রুটি দিলো। আর এক জনকে দিলো একটা রুটি।
অবশিষ্ট একটি রুটির অর্ধেকটা দিয়ে দিলো আর একজনকে। বাকী অর্ধেক ছিড়ে ছিড়ে পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম ছেলের হাতে ধরিয়ে দিলো। অষ্টম ছেলেটা পেলো খুবই ছোট একটি টুকরো।
ছেলেরা সবাই খুবই বিমর্ষ হয়ে গেলো। আরে! হোজ্জা সাহেব এটা কি করলেন? জ্ঞানী মানুষ বলে দেশে-বিদেশে নাসিরউদ্দিন হোজ্জার বেশ নামডাক আছে।
কিন্তু তাই বলে আল্লার নিয়মে রুটি ভাগ করার কথা বলে এরকম করলো হোজ্জা! ছেলেরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না।
তিনটা রুটি পাওয়া ছেলেটাই কথা শুরু করলো। সেই মূলত অঘোষিত নেতা এদের মধ্যে। বললো- হোজ্জা সাহেব! আপনি এ কেমন রুটি ভাগ করলেন। আমি তিনটা রুটি পেয়েও তো খুশি হতে পারি নি।
নাসিরউদ্দিন হোজ্জা খুব নরম সুরে বললেন, তোমরাই তো সবাই মিলে বললে আল্লার নিয়মে ভাগ করতে??
সবাই উত্তর দিল, হ্যা! আমরা তো তাই বলেছি! কিন্তু এ কিরকম আল্লার নিয়মে রুটি ভাগ??
হোজ্জা আবারও খুব ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিলেন, তোমাদের বয়স কম! কিন্তু তারপরেও তো আল্লার নিয়মের ভাগ-বাটোয়ারার মধ্যেই তোমরা বড় হচ্ছো। আচ্ছা বলতো এই গ্রামে বড়লোকের সংখ্যা কতজন?
সবাই বললো- ঐতো! চৌধুরীরাই তো শুধু বড়লোক এই গ্রামে!
নাসিরউদ্দিন আবার বললেন, হ্যা! এই গ্রামের মতো সারা দেশের অবস্থাও একই। বড়লোকের সংখ্যা হাতে গোনা, মধ্য বিত্তের সংখ্যা তার চেয়ে একটু বেশি, গরীবের সংখ্যা সেখানে অগণিত। আল্লার নিয়মে তাই গরীবরা খেতে পায়না আর বড়লোকরা খাবার নষ্ট করে। আমিও তোমাদের সেই আল্লার নিয়মেই ভাগ করে দিয়েছি।
বড়লোক, মধ্যবিত্ত, নিন্মমধ্যবিত্ত, আর বাকীসব গরীব ও নিস্ব। আল্লার করা শ্রেণীবিভাগই অনুসরণ করতে চেয়েছি।
ছেলেরা আবার বিরক্তির সুরেই জিজ্ঞাসা করলো, আচ্ছা মানুষের নিয়মটা কি?
নাসিরউদ্দিন হোজ্জা বললেন, মানুষের নিয়মটাই অনেক বেশি মানবিক নিয়ম! সবাই সমান ভাগ পাওয়াটাই মানুষের নিয়ম।
ছেলেদের মুখে এবার হাসির রেখা দেখা গেলো। বললো- আমাদের আল্লার নিয়মের দরকার নাই।
আপনি মানুষের নিয়মেই আমাদের রুটি ভাগ করে দেন। বলেই সবাই নিজ নিজ হাতের রুটি আবার হোজ্জার হাতে তুলে দিলো।
হোজ্জা রুটিগুলো নিয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লো। নিজের কাঁধের চাদরখানা ঘাসের উপর বিছিনে নিলো। তারপর রুটিগুলো ছোট ছোট টুকরো করে যতদুর সম্ভব সমান আট ভাগে ভাগ করে চাঁদরের উপর রাখলো।
আর বললো- যার যে ভাগ পছন্দ নিয়ে নাও! মানুষের নিয়মে ভাগে কোন সমস্যা নাই।
ছেলেরা তখন মহাখুশি!!
নাসিরউদ্দিন হোজ্জা মিষ্টি সুরে আবার বললেন, তুমি না বললে, তিনটা রুটি পেয়েও তুমি খুশি হতে পারো নি! খুবই মানুষের মতো ভাবনা! আর ঐ বড়লোকগুলো দেখো! এত পেয়েছে! তারপরও আরো পেতে চায়! আরো পেতে চায়! আর গরীবরা না খেয়ে মরে! আল্লার নিয়মে ভাগ-বাটোয়ারা!!
(বেশ আগে পড়া নাসিরউদ্দিন হোজ্জার গল্প অবলম্বনে লেখা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।