যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
কমন বায়োস্কোপঃ
কয়েকটি দুধের বাচ্চা কান্নাকাটি করছে। কিছু ভাঙ্গচোরা হাঁড়িপাতিল এলোমেলো ছড়ানো ছিটানো। কয়েকটা মাটির হাঁড়ি ভাঙ্গা। কিছু মালপত্র স্তুপ করে রাখা। একটি প্রমান সাইজ প্রফাইল ক্লোজড শটে দেখানো।
কাঁদছে। বাঁকাচোরা মুখের স্কেচ!
কালো কালো বাঁশের পোড়া খুঁটি। কোনটা অর্ধেক, কোনটা সিকি। পোড়া কাপড়-চোপড় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়ানো ছিটানো। লং শটে এসবের সাথ একটি ইনসেট।
তাতে দুহাত আকাশের দিকে তুলে এক বৃদ্ধা বা বৃদ্ধ চিৎকার করছে!
একটি পোড়া শিশুর লাশ। চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়ানো উৎসুক জনতা। লাশের মা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। ইনসেটে মায়ের ক্রন্ধনরত মুখ!
এই বায়েস্কোপগুলোর কমন পরিচিতি সংবাদ পত্রের পাতায় অনেকবার দেখেছি আমরা। দেখে দেখে অনেকটাই ক্লান্ত নাগরিকেরা।
সংবাদ পত্রের ভাষ্যমতে বায়োস্কোপগুলি বস্তি উচ্ছেদ, বস্তি পোড়া এবং আগুনে সর্বশান্ত হওয়া মানুষের মুখচ্ছবি। প্রচারের স্টাইল, ঘটনাস্থল, কারণ, উদ্দেশ্য এতটাই পরিচিত যে, এসব দেখে এখন আর আমাদের গা-করে না! বেশ গা-সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। নাগরিক জীবনপ্রবাহের কোথাও কোন ছেদ পড়ে না। কোথাও কোন কিছু সামান্য সময়ের জন্যেও থেমে যায় না। ঠিক এরকমই একটি বায়োস্কোপের প্রদর্শন হয়ে গেল রাজশাহী মহানগরীর উপশহর এলাকায়.......
সকালে শিরিনের পরীক্ষা ছিল।
মা সুন্দরা বেগম গিয়েছিলেন অন্যের বাড়িতে কাজ করতে। মাঝপথে দুজনকেই ফিরে আসতে হয়েছে, কারণ তারা যে জমিতে বাড়ি করে এতদিন বসবাস করছিলেন সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেছেন! এখন শিরিন আর তার মা খোলা আকাশের নিচে রাস্তায়। শিরিন কি আর পরীক্ষা দিতে পেরেছিল? বাংলাদেশের বাস্তবতা বলে-না।
রাজশাহী উপশহর এলাকার শিয়া মসজিদের পাশের জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছিল শিরিনের পরিবার। এখানেই ওর জন্ম।
বাবা রিকশাচালক কখনো আছেন, আবার নেই। তাই তার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে যা রোজগার করেন তাই দিয়েই শিরিনদের বেঁচে থাকা।
শিরিন সরকারী মডেল প্রাথমিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। ওই দিন তার পরীক্ষা ছিল, কিন্তু যখন শুনতে পেলো তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তখন আর তার পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। ছুটে আসতে হয়েছে বাড়িতে,অর্থাৎ খোলা আকাশের নিচে!
এই জায়গাটি জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে বরাদ্দ নিয়েছিল শিয়া মসজিদ কমিটি।
মসজিদ নির্মাণ শুরু না হওয়ায় ওখানে অনেকগুলি পরিবার ৩০ বছর ধরে বসবাস করে আসছিল। হঠাৎ শিয়া মসজিদ কমিটির হয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ দিয়ে ওই পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করেছে। ওরা বলছে ওদের কোন নোটিস দেওয়া হয়নি। আমরা জানি সব সময়ই সরকারের ম্যাজিস্ট্রেট আর পুলিশ নোটিস দেয়। সেই নোটিস যদিও কেউ দেখে না, কারণ তা এমন ভাবে দেওয়া হয় যাতে করে কেউ যেন না দেখে।
নোটিসের চেকনাই খেল আমরা শুধু যে এই সকল দরিদ্র মানুষের উচ্ছেদের বেলায় হিডেন ভাবে দেখি তা-ই নয়, এই ধরণের উচ্ছেদ নামক নিপীড়নের বেলায় এটা ফিল্মি ফ্যান্টাসিকেও হার মানায়। আর এই ফ্যান্টাসির জন্ম দেন আমাদের বিসিএস পাশ করা জাতির বিবেকেরা! যাদের প্রচলিত শব্দে ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়।
এই ম্যাজিস্ট্রেট সায়েবরা আগে ব্রীটিশ জমানায় সাদা চামড়ার ঘিয়ে হ্যাট পরা হতেন, এখন আপনার-আমার মত সৌম্যকান্তি অবয়বে ধোপদুরস্ত পোশাকের বাঙালি! তফাৎ কিছু নেই। শুধু এটুকুই পার্থক্য যে, আগে সায়েবরা ঘোড়ায় চড়ে আসতেন, এখন ম্যাজিস্ট্রেটরা গাড়ি হাঁকিয়ে আসেন। আবার গাড়ি হাঁকিয়েই ফিরে যান।
যাবার সময় বিরানভূমি আর মানুষের ভাঙ্গা মনের গলিপথ দিয়ে মানুষের কান্নার দাগের ওপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যান। চাকার ঘসায়ও সেই কান্নার দাগ মুছে যায় না।
শিয়া মসজিদের জমি! কি করে হয়? মসজিদ কি জমি উৎপাদন করে? না! তাহলে? জমি তো সরকারের, মানে সাধারণ মানুষের! সেই জমি সরকার তার নির্বাহী ক্ষমতবলে মসজিদকে ইজারা দিয়েছিল। মসজিদ হতে হয়নি। নিশ্চই নামাজ পড়ার আরো জায়গা ছিল বলেই শিয়া মসজিদ নির্মিত হয়নি।
এখন তাহলে কেন হঠাৎ করে মসজিদ নির্মাণ জরুরী হয়ে পড়ল? নাকি মসজিদের নামে জায়গাটা দখল করে কোন মার্কেট, কিংবা শপিংমল, অথবা বহুতল ভবন গড়ে উঠবে? হবে তো তা-ই। তাহলে কেন মসজিদের নাম ব্যবহার? কারণ এই নামটির ভেতর অনেক মাজেজা আছে। নামটিই কেমন পবিত্র পবিত্র! এই নামে দখল চালালে কোন চন্ডাল তার বিরোধীতা করবে না! আহা কি অপূর্ব দখলিস্বত্ত্ব! আল্লার ঘর বলে কথা! তোমরা শিরিন না কি ছাতার মাথা, তোমরা আল্লার ঘরের মহিমা কি করে বুঝবে? আল্লার ঘরের নিরাপদ হেফাজতকারীরা যে তোমাদের কতল করেনি তাই তো তামাদের সাত পুরুষের ভাগ্য!
মসজিদ নামক এই ভূমি দখলের টুলসটির ব্যবহার আজ থেকে নয়, যুগ যুগ ধরে এদেশের সংস্কৃতিতে চলে আসছে। বাংলাদেশে আনুমানিক ৪ লক্ষ মসজিদ আছে, যার সিংহভাগই হয় খাস জমি, না হয় সরকারী জমি, অথবা কাউকে উচ্ছেদ করে পূণ্যহাসিলের মহান ব্রত নিয়ে করা! এই ৪ লাখ মসজিদের গড়ে ৫ কাঠা করে জায়গা থাকলে সারা দেশে মোট মসজিদি জায়গার পরিমান ১ লাখ বিঘা! এই ১ লাখ বিঘা জমি ব্যবহার হচ্ছে "আল্লার ঘর" নামে। যা সারা বছর খালি পড়ে থাকে।
তার পাশে কিছু তালবেয়ালিম এবং হুজুররা থাকেন ঘর করে। অর্থাৎ সারা দেশের এই ভীষণ আবাসিক সংকটের ভেতর ১ লাখ বিঘা জমি আল্লার নামে দখল করে আল্লার গুণগানে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার নিট প্রাপ্তি অশেষ নেকি! বিস্তর ছোয়াব। "আল্লার ঘর" মসজিদ। এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কি পরিমান টাকা কালেকশন হয় সে হিসোবে মাথা ঘুরে ওঠে।
থাক সে হিসেব। তো আল্লার ঘর মানে আল্লা যে ঘরে থাকেন! আল্লা কি সাকার, যে ঘরে থাকবেন? এই ধরণের বেয়াড়া প্রশ্ন কোন কালেই সাধারণ মানুষেরা করতে পারে না। পারবে না। আর এই না-পারাটাই আল্লার ঘরের খাদেম বান্দাদের ব্রম্মাস্ত্র!
শিরিন, তুমি কাঁদো। ডুকরে ডুকরে কাঁদো।
শিশুর কান্নায় নাকি আল্লার আরশ কেঁপে ওঠে! আরশ কাঠের না লোহার আমরা জানিনা। তাই কেঁপে উঠলে কি হয় তাও জানিনা। আরশ কেঁপে ওঠার পর সেই কাঁপা দেখে আল্লা কি করেন তাও জানিনা। শুধু জানি- তুমি শিরিন আর কোথাও ঠাঁই পাবে না। ছিন্নমূল হয়ে কচুরিপানার মত ভাসতে একসময় আরো বড় হবে।
তার পর কোন একদিন বড় হয়েছ কিনা সেটার বাস্তব প্রমাণের জন্য তোমার শরিরের উপর এক বা একাধিক মানুষ উঠবস করবে, ঘেমে উঠবে, প্যান্টের জিপার টেনে চলে যাবে। তুমি শিরিন ব্যাথায় কাতর পড়ে থাকবে আরো অনেকদিন আমাদের প্রথাগত গ্লানি বয়ে বেড়ানোর স্বাক্ষী হিসেবে....কাঁদো শিরিন.....কাঁদো...
খবরটি ছাপা হয়েছে ২১ এপ্রিল দৈনিক সমকাল এ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।