হাউকাউ পার্টি
সিলেটের জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জৈন্তাপুরেই বাংলাদেশের এক মাত্র মেগালিথক ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
পৌরানিক ও তান্ত্রিক বিভিন্ন উপখ্যান থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালেও এই এলাকার নাম ছিল জৈন্তাপুর। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এই এলাকা দীর্ঘদিন কারো পরাধীন হয়নি। লিপিসাক্ষ্য থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ি আনুমানিক ৭ম/৮ম খ্রী এই অঞ্চল কামরূপের অধিনে চলে যায়, পরে পর্যায়ক্রমে চন্দ্র, বর্মন ও দেব রাজবংশ এখানে রাজত্ব করে।
দেব রাজা জয়ন্ত রায়ের কন্যা জয়ন্তির সাথে বিয়ে হয় স্থানীয় খাসিয়া প্রধানের ছেলের সাথে, যার ফলে পরবর্তি কালে ১৫০০ খ্রী: দিকে এই এলাকা খাসিয়াদের অধিনে চলে যায়।
বিভিন্ন স্থাপত্যকীর্ততে সমৃদ্ধ জৈন্তাপুরের যেটা আমার বেশি আকর্ষণ করে, তা হলো এখানকার মেগালিথিক সৌধ গুলো।
মেগালিথিক সৌধ গুলোকে সাধারণত স্মারক সৌধ কিংবা সমাধি সৌধ হিসেবে চিন্হিত করা হয়। এ ধরণের সৌধ এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বিভিন্ন অংশে দেখা যায়।
উত্তর-পূর্ব ভারত ও দক্ষিন ভারতে প্রাপ্ত মেনহির গুলোকে স্মারক সৌধ হিসেবে চিন্হিত করা গেছে, তবে দক্ষিন ভারতের বাইসন ভ্যালি, আল্পসারা, মুবারাদোদ্দির ও বিভরালার কিছু মেনহিরের নিচে সমাধি সৌধের সন্ধান পাওয়া গেছে।
নিওলিথিক-চ্যলকোলিথিক সময়ে অর্থাৎ খ্রী: তৃতীয় শতকের মাঝামাঝিতে মেগালিথিক সংস্কৃতির উদ্ভব হয়।
মেগালিথিক হলো বড় পাথরের খন্ড, এগুলো একক ভাবে অথবা কয়েকটি এক সাথে করে সমাধি স্থাপত্য নির্মান করা হত। এই স্থাপত্য কাঠামো তৈরিতে কোন মর্টার বা সংযোজক পদার্থ ব্যবহার করা হতো না, পাথর গুলো ইন্টারলকিং পদ্ধতিতে জোড়া লাগানো হতো।
মেগালোথিক সাধারণত দুই রকমের হয়। মেনহির আর ডলমেন।
সাধারণত লম্বা, খাড়া একটা পাথর খন্ড দিয়ে তৈরি হয় মেনহির।
এটা একটা পাথর অথবা অনেক গুলো দন্ডায়মান পাথরের সমস্টি হতে পারে। এগুলো সারি বদ্ধ, গোলাকার ভাবে সাজানো থাকতে পারে। মেনহির সাধারণত স্মারক সৌধ হিসেবে চিন্হত করা হয়েছে।
সার্বিয়ার মেনহির।
আর ডলমেন অনেকটা টেবিল আকৃতির।
দুই, তিন বা ততোধিক পাথর খন্ডের উপরে পাথরের স্লাব বসিয়ে তৈরি হয় ডলমেন। ডলমেনের ভিতরে এক বা একাধিক চেম্বার থাকতে পারে এবং এখানেই মৃতদেহ রাখা হতো।
এগুলো স্মারক ও সমাধি, এই দুই কাজে ব্যবহার করার নিদর্শন পাওয়া যায়। দক্ষিন ভারতের বেশির ভাগ ডলমেনের নীচেই সামাধির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
অয়ারল্যান্ডের Paulnabrone ডলমেন।
জৈন্তাপূরে এই দুই ধরণের মেগালিথিক স্থাপত্যই দেখা যায়। এখানে ২৫ টি ডলমেন আর ৩২টি মেনহির আছে।
জৈন্তাপুরের ডলমেন।
জৈন্তাপুরের মেনহির।
সিলেটর জাফলং মহাসড়কের পাশে জৈন্তেশ্বরী মন্দিরের পাশে আছে ৯টা মেনহির আর ১০টা ডলমেন।
এখানেই সবচেয়ে উচু মেগেলিথিকটার অবস্থান। এর উচ্চতা ৬.৫ মি আর প্রস্থ ৫.২ মি.।
এই মন্দির থেকে দেড় কি মি দক্ষিন পশ্চিমে নয়াগাঙ নদীর তীরে রয়েছে ৩টি মেনহির আর ৪টি ডলমেন। মজার ব্যপার হলো এখানকার একটা মেনহিরের মাথার দিকে ত্রিশুল খোদাই করা আছে।
এ ধরনের বিভিন্ন প্রতীক খোদাই করা মেনহির বিশ্বের অনান্য প্রান্তেও দেখা যায়।
তুরস্কের Gobekli এর একটি মেনহিরের টপে খোদাই চিত্র।
বাকি মেনহির আর ডলমেন গুলোর অবস্থান খাসিয়া পল্লী বা মধুবন আবাসিক এলাকায়। এখানকার দুটো মেনহিরের গায়ে রয়েছে পদ্ম, চক্র আর ত্রিশুলের চিন্হ।
জৈন্তাপুরের এই মেগেলিথিক সৌধ এলাকায় এখনও পর্যন্ত কোন পদ্ধতিগত প্রত্নতাত্বিক উৎখনন হয়নি, তাই এগুলো আসলেই মেগালিথিক সমাধি সৌধ না স্মারক সৌধ, সময়কাল কত ইত্যাদি বিষয় গুলো এখনও বিতর্কিত রয়ে গেছে। তবে অনেক গবেষক এগুলো রাজকীয় বিচার কাজের আসন, বানিজ্যক টোল আদায়ের কেন্দ্র ছিল, বিশ্রামের জায়গা ইত্যাদি হিসেবে ব্যাখা দিয়েছেন।
তবে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো স্থানীয় খাসীয়দের মধ্যে এখনও মৃতদেহ সমাহিত করার পর তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এধরনের পাথরের সৌধ নির্মানের রীতি প্রচলিত আছে।
জৈন্তাপুরের মেগালিথিক সম্পর্কে আরও জানতে চাইলে দেখতে পারেন নীচের বই গুলো........
C Land এর The "Maw-Shong Thait" Near Jaintiapur, Journal of the Asiatic Society of Pakistan, 5
VD S Alam রচিত Megalithic at Jaintapur: A Unique Cultural Evidence in Bangladesh, Sylhet:
Sarif Uddin Ahmed সম্পাদিত History and Heritage।
সুতরাং সিলেটের চা বাগান গুলোতে কখনো ঘুরতে গেলে অবশ্যই দেখে আসতে পারেন এই প্রায় ঐতিহাসিক (সম্ভবত) মেগালিথিক সৌধ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।