রঙ্গিলা বন্ধুরে....... i_mahmud2008@yahoo.com
দেশব্যাপী আলোচিত ফতোয়ার শিকার
নুরজাহান আত্মহননের ১৭ বছর
ইসমাইল মাহমুদ
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ছাতকছড়া গ্রামের নুরজাহানের কথা আপনাদের মনে আছে কি? আগামী ১০ জানুয়ারি দেশে ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে ওঠা কমলগঞ্জের ছাতকছড়ার সেই নুরজাহানের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৩ সালের এদিনে নুরজাহানের বিরুদ্ধে দেয়া একটি ফতোয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী নিভৃত পাহাড়ী গ্রাম ‘ছাতকছড়া’ দেশব্যাপী আলোচিত হয়ে উঠে। সংবাদপত্রের কল্যাণে ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার লাভ করলে এ ঘটনার প্রতিবাদে সারা দেশের বিবেকবান মানুষ রুখে দাড়ান। দেশের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলনের নেত্রী মালেকা বেগম, বেবী মওদুদ, এডভোকেট আয়েশা খানম, বুদ্ধিজীবি মহল, জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, কলামিষ্টরা ছুটে আসেন অখ্যাত নিভৃত পাহাড়ী এলাকা ছাতকছড়ায়।
ফিরে দেখা ১৭ বছর
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড়-টিলা বেষ্টিত সীমান্তবর্তী ছোট পাহাড়ী গ্রাম ‘ছাতকছড়া’।
এ গ্রামের দরিদ্র কৃষক আশ্রাব যুবতী কন্যা ছিল নুরজাহান বেগম (লক্ষি)। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কিশোরী নুরজাহানের বিয়ে হয় মৌলভীবাজারের সদর উপজেলার শেরপুর এলাকার আব্দুল মতিন নামের এক যুবকের সাথে। বিয়ের পর নুরজাহানকে নিয়ে তার স্বামীর ছিলো সুখের সংসার। হঠাৎ করে কাউকে কিছু না বলে আব্দুল মতিন উদাও হয়ে যায়। দীর্ঘদিন তার কোন খোঁজ না থাকায় আশ্রব উল্লা মেয়ে নুরজাহানকে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন।
ইত্যবসরে সুন্দরী নুরজাহানের উপর চোখ পড়ে ছাতকছড়া মসজিদের ইমাম আব্দুল মান্নানের। নুরজাহানকে ছলে-বলে-কৌশলে বিয়ে করার জন্য ভন্ড মান্নান মরিয়া হয়ে ওঠে। নুরজাহানকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠায় আশ্রব উল্লার কাছে।
নুরজাহানের বয়সের দ্বিগুনেরও বেশি বয়সি এবং ঘরে একাধিক স্ত্রী থাকায় সঙ্গত কারণেই আশ্রব উল্লা মাওলানা মান্নানের এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এতেও দমে না গিয়ে মাওলানা মান্নান নুরজাহানের পিছু লেগে থেকে অতিষ্ট করে তুলে আশ্রব উল্লার পুরো পরিবারকে।
ফলে বাধ্য হয়ে আশ্রব উল্লা তড়িগড়ি করে একই গ্রামের আব্দুল মোতালিবের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে দেন নুরজাহানের। আর এই বিয়েকে কেন্দ্র করেই ঘটে ইতিহাসের এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। নুরজাহানকে বিয়ে করতে না পেরে মাওলানা মান্নান চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শুরু করে নানা ছলচাতুরী। গ্রামের কিছু ভন্ড লোকের সহায়তায় আশ্রব উল্লার পরিবারকে একঘরে করে রাখার বিধান জারি করে।
এতেও শেষ হয়নি তার প্রতিশোধের নেশা। আব্দুল মোতালিবের সাথে নুরজাহানের বিয়ের ৪৫ দিনের মাথায় তাদের এ বিয়ে অবৈধ আখ্যায়িত করে গ্রাম্য শালিসের আয়োজন করে মাওলানা মান্নান ও তার সহযোগিরা। গ্রামের অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত মানুষকে ভুল বুঝিয়ে মান্নান ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি সকালে গ্রামের নিয়ামত উল্লার বাড়িতে গ্রাম্য শালিসের আয়োজন করে। সালিশে গ্রামের কথিত সর্দার দীন মোহাম্মদ, নিয়ামত উল্লা ও মাওলানা মান্নান আব্দুল মোতালিবের সাথে নুরজাহানের বিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে হয়েছে বলে রায় প্রদান করে আব্দুল মোতালিব ও নুরজাহানকে গলা পর্যন্ত মাটিতে পুতে ১০১টি পাথর নিক্ষেপ ও ১০১টি দোররা (লাঠির আঘাত) মারার ফতোয়া জারি করে। এছাড়া বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য নুরজাহান (লক্ষি)’র মা সায়েরা বানু ও বাবা আশ্রব উল্লাকে দোরার মারার ফতোয়া দেয়া হয়।
এছাড়া বিয়েতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাইকে কান ধরে উঠবস করতে হবে। শালিসে উপস্থিত আব্দুল মোতালিবের পিতা মতিউল্লা শালিসে ফতোয়ার শাস্তি লাগবের জন্য আবেদন করলে নুরজাহান ও মোতালিবকে লঘু দণ্ড অর্থাৎ কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুতে পাথর ছুড়ে মারা হয় এবং প্রত্যেককে ১০১টি দোররা মারার বদলে ৫১টি দোররা মারা হয়। শালিসের রায় তাৎক্ষনিক কার্যকর করার পরও থেমে থাকেনি মাওলানা মান্নানের অনুসারী গ্রাম্য মাতব্বরদের জিঘাংশা। শালিসে বসেই মনির মিয়া নুরজাহানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘এত কিছুর পর তর বেচে থাকা উচিত নয়, বিষ খেয়ে তর মরা উচিত’। বিচারের নামে প্রহসন এবং কথিত গ্রাম্য সর্দার মনির মিয়ার উক্তি সহ্য করতে না পেরে নুরজাহান (লক্ষি) রাগে-দুঃখে সাথে সাথেই বিষপান করে আত্মহত্যার পথ বেচে নেয়।
যেভাবে প্রতিবাদ শুরু হয় সারাদেশে
কমলগঞ্জের তরুন সাংবাদিক সাজিদুর রহমান ঘটনাটি সোর্স মারফত খবর পেয়ে ওইদিনই এলাকায় গমন করেন। সরজমিনে পরিদর্শন করে এ ব্যাপারে দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রথম সংবাদ প্রেরণ করেন। পরদিন প্রতিবেদনটি পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হলে সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রী মালেকা বেগম, বেবী মওদুদ, এডভোকেট আয়েশা খানম, বুদ্ধিজীবি মহল, জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, কলামিষ্টরা ছুটে আসেন অখ্যাত নিভৃত পাহাড়ী এলাকা ছাতকছড়ায়। সারাদেশে ‘ছাতকছড়া’ নামটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে।
ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে দেশের সকল বিবেকবান মানুষ। স্থাণীয় পুলিশ প্রশাসন প্রথম দিকে ঘটনাটি ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু বিবেকবান মানুষের ক্ষোভ বাড়তে থাকলে পুলিশও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফতোয়া দানকারী ইমাম আব্দুল মান্নান, আব্দুল মিয়া, দ্বীন মোহাম্মদ, সোনা মিয়া, বোরহান উদ্দিন, এছামত উল্লা, নিয়ামত উল্লাসহ ৯ জনকে আসামী করে ঘটনার ৪ মাস পর আদালতে চার্জশীট জমা দেয়। ১৯৯৪ সালের ২ ফেব্র“য়ারি বিজ্ঞ আদালত আত্মহত্যায় প্রলুব্ধ করার অপরাধে চার্জশীটভূক্ত ৯জন আসামীর প্রত্যেককে ৭ বছর করে সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন।
আশার বাণীই সম্বল গ্রামবাসীর
নুরজাহান (লক্ষি) অবৈধ বিচারের রায়ের প্রতিবাদে আত্মহননের পর সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিরা ছাতকছড়া সড়কের নাম নুরজাহান সড়ক করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কালভার্ট নির্মাণসহ নানাবিদ প্রতিশ্র“তি দেন। এছাড়া তৎকালীন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক যে টিলায় হতভাগী নুরজাহানকে কবরস্থ করা হয় সে টিলার নাম ‘নুরজাহান টিলা’ হিসেবে ঘোষনা দেন। মহিলা পরিষদ নুরজাহানের কবর পাকা করার ঘোষনা দেয়। কিন্তু যে টিলায় নুরজাহানকে কবর দেয়া হয়েছিল সে টিলা অন্য এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়ায় টিলাটির নতুন মালিক সেখানে রোপন করেছেন নানা জাতের বৃক্ষ। নুরজাহানের আত্মহননের পর বিভিন্ন মহল থেকে এরকম হাজারো আশার বাণী শুনানো হয়।
যার প্রতিফলন ঘটেনি। আশার বাণীই সম্বল গ্রামবাসীর। আশার বাণী শুনে শুনেই রোগাক্রান্ত হয়ে ২০০০ সালে মৃত্যুবরন করেন নুরজাহানের পিতা আশ্রব উল্লা।
বর্তমান চিত্র
নুরজাহানের নামে করা সড়ক দীর্ঘদিন যাবত সংস্কারবিহীন। ফলে দুর্গম পাহাড়ি এলাকার মানুষের যাতায়াতে চরম দূর্ভোগ পোহাতে হয়।
যে টিলায় নুরজাহানকে কবরস্থ করা হয়েছিল সে টিলাটি এখন ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কোন ধরনের সংস্কার কাজ হয়নি কবরস্তানের। নুরজাহানের কবর এখন খুঁজে পাওয়াই মুস্কিল। নুরজাহানের মৃত্যু দিবসে বিভিন্ন মহল ঢাকায় বসে স্মরণসভা করে দায় সারেন। তার পরিবারের খোঁজ-খবর নেবার দায় যেন বর্তমানে কারো নেই।
ইসমাইল মাহমুদ
মৌলভীবাজার
০১৭১৫১৭১৯৫০
০১১৯৬১২৮৫১৩
০১৬৭০৫৮৪২৭৫
১৭.১২.২০০৯ইং
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।