আমি সত্য জানতে চাই
বাংলাদেশের অন্যতম কবি অসীম সাহার জন্মদিন এবং বরেণ্য ছড়াকার ও দেশ খ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের মুত্যুবার্ষিকী আজ। জন্ম ও মৃত্যুদিনে এই দুই গুনীজনকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়
(অসীম সাহা)
বাংলাভাষায় যাঁরা শুদ্ধ কবিতার চর্চা করেছেন অসীম সাহা তাঁদের অন্যতম। কবি অসীম সাহার আজ জন্মদিন। ১৯৪৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণ করেন। কবির জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা
(সাহিত্যিক আহমদ ছফার সাথে কবি অসীম সাহা)
বাংলাদেশে যে-কজন কবি ছন্দ জানেন, তাঁদের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়।
বলাই বাহুল্য, অসীম সাহা তাঁদের অন্যতম। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন সংস্কৃতিপ্রেমী ও ভাবুক প্রকৃতির । কাব্যচর্চাও শুরু হয়েছিল কৈশোরে । তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘পূর্ব পৃথিবীর অস্থির জ্যোস্নায়, ভালোবাসার কবিতা, কালো পালকের নিচে, পুনরুদ্ধার অন্যতম। ‘পুনরুদ্ধার’ কাব্যে তিনি দেখিয়েছেন তাঁর ছন্দের কুশলতা।
তিন ছন্দের যত রকমের চাল সৃষ্টি হতে পারে, তার সকল রকমের প্রয়োগ রয়েছে ওই কাব্যে। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ এই কবি অল্পপ্রজ এবং স্বল্পালোচিত হলেও ধীমান পাঠকের কাছে শ্রদ্ধেয় এবং গ্রাহ্য হয়ে উঠেছেন ষাটের দশকের শেষ পাদ থেকেই।
(নেকাব্বরের মহাপ্রয়ান চলচ্চিত্রের একটির দৃশ্য)
সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এবং কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ অবলম্বনে তরুণ পরিচালক মাসুদ পথিক পরিচালিত ছায়াছবিতে ক্ষেতমজুর সমিতির নেতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করলেন কবি অসীম সাহা। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন ১৫ জন কবি। এঁরা হলেন—নির্মলেন্দু গুণ, অসীম সাহা, অমিতাভ পাল, সৌমিত্র দেব, বদরুল হায়দার, সনজিব পুরোহিত, মাঈন মজুমদার, সিরাজ এহসান, তারেক মাহমুদ, আনজির লিটন, প্রানেশ চৌধুরী, দিলদার হোসেন, জহির বাপী, ফয়সাল শাহ, জাহেদ সারওয়ার।
কবি নির্মলেন্দু গুণের নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ অবলম্বনে ছবিটি পরিচালনা করছেন মাসুদ পথিক। বর্তমানের শারীরিক অসুস্থতাকে জয় করে তিনি লিখে চলেছেন কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ও গল্প। বেদনার সঙ্গে বলতে হয় যে, ভুল ছন্দে কবিতা লিখেও অনেকে স্বীকৃতি-পুরস্কার বাগিয়ে নেন, কিন্তু অসীম সাহার মতো শুদ্ধস্বরে কবিতাচর্চা করেন, যারা শিল্পের সাধনা করেন, তাঁরা থেকে যান প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি তালিকার বাইরে। একজন শিল্পসফল কবির পক্ষে পাঠকের ভালোবাসাই পরম আরাধ্য, কবি অসীম সাহা পেয়েছেন মনোযোগী পাঠকের আন্তরিক ভালোবাসা। সেখানে তাঁর শিল্পযাত্রা অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।
ছন্দোস্বাচ্ছন্দ্যের স্বীকৃতি তাঁর প্রাপ্য। বড়দের পাশা পাশি তিনি ছোটদের জন্য একসময় প্রচুর ছড়া-কবিতা লিখেন। তাঁর সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশকিছু সম্মাননা লাভ করেন তিনি। আজ কবির জন্মদিন। জন্মদিনে কবিকে জানাই অফুরাণ শুভেচ্ছা ও ভালবাসা।
(ফয়েজ আহমদ)
ফয়েজ আহমদ বাংলাদেশের প্রথম সারির সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ২ মে ব্রিটিশ ভারতে ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বাসাইলভোগ গ্রামে এক সামন্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামটি বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্ভূত। তাঁর পিতার নাম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী এবং মাতা আরজুদা বানু।
(ফয়েজ আহমদের পিতা গোলাম মোস্তফা চৌধুরী)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে পলায়নমুখী পশ্চাদগামী ব্রিটিশ সৈন্যরা যখন বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায় ক্যাম্প স্থাপন করেছিল, তখন ঢাকা নগরীর বনানীস্থ একটি ক্যাম্পে তরুণ প্রকৌশলী তথা পাইলট হিসেবে শিক্ষানবিসের কাজ করেছিলেন ফয়েজ আহমেদ।
১৯৪৭-এ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
সাংবাদিক ফয়েজ আহ্মদের জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। ১৯৪৮ সাল থেকে সাংবাদিক জীবনের শুরু। ১৯৪৮ সাল থেকে ৩৫ বছর তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত মুক্ত চিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল লেখকদের সংগঠন পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের প্রথম সম্পাদক ছিলেন।
তিনি ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও পরবর্তীতে পূর্বদেশে চীফ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক ইনসাফ ও ইনসান পত্রিকায় রিপোর্টিং করেছেন। ১৯৫০ সালে 'হুল্লোড়' এবং ১৯৭১ সালে 'স্বরাজ' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষার প্রোগ্রাম চালু করার জন্য ১৯৬৬ ও ’৬৭ এ দু বছর কাজ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলনে এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান প্রবর্তন করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান শুরু করার জন্যে তিনবছর মেয়াদে নিযুক্ত হন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম আর নেতৃত্বের ফলে অল্প সময়েই পিকিং রেডিওতে (বর্তমানে রেডিও বেইজিং) বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। সে সময় চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয়। এছাড়া তিনি ঢাকা রেডিওতে ১৯৫২-৫৪ সালে 'সবুজ মেলা' নামের ছোটদের বিভাগটি পরিচালনা করতেন।
বাংলাদেশে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবহিনী গণহত্যা শুরু করলে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাব ভবনে আশ্রয় নেন। সেখানেই তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন। রাত ১১টায় আশ্রয় নেয়ার পর ভোর রাতে ট্যাংক দিয়ে শত্রুবাহিনী প্রেসক্লাবে তাঁর আশ্রয় কক্ষে দোতলায় গোলাবর্ষণ করে । তিনি বাঁ ঊরুতে আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকেন।
২৬ মার্চ ভোরে জ্ঞান ফিরে পান। পরে নিকটস্থ বাংলাদেশ সচিবালয়ে আশ্রয় নিনিয়ে জীবন বাঁচান। পরে ২৭ মার্চ সকাল প্রায় ১০টায় কারফিউ ওঠার পর তিনি চিকিৎসার জন্য বেরিয়ে যান। ঢাকা থেকে তিনি আগরতলা চলে যান। আগরতলায় চিকিৎসার পর তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় কলকাতায় যান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বি.এস.এস.) প্রথম প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ফয়েজ আহ্মদ আশির দশকে গঠিত জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রথম পাঁচ বছর আহ্বায়ক ছিলেন।
সাংবাদিকতা করার সময় থেকে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
তিনি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ৮০'র দশকে ফয়েজ আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর সিণ্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রথম পাঁচ বছর আহ্বায়ক ছিলেন। এছাড়া ১৯৮২ তে বাংলা একাডেমীর কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পরে এরশাদের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।
বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামী ঐতিহ্যের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক কারণেই ১৯৮২-৮৩ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের জন্ম । তাঁর নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যেমন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিল তেমনি ১৯৮৮ সালের মহা প্লাবন, ১৯৯০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে দাঁড়িয়েছিল।
আধুনিক বাংলা ছড়ার নন্দিত সৃষ্টিজন কবি ফয়েজ আহমেদ। তাঁর ছড়ার জগত বৈচিত্রময়। দেশকাল, মুক্তিযুদ্ধ, দৈনন্দিন সমাজ ভাবনা, জনসংগ্রাম থেকে একেবারে শিশুতোষ ভাবনার বর্ণিল প্রকাশ তার ছড়ার উপজীব্য হয়েছে।
ঝিলিমিলি, তা তা থৈ থৈ, ছোট ছেলে মামানের, জোনাকীসহ অসংখ্য ছড়াগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর এই 'মজার পড়া ১০০ ছড়া'য় প্রকাশিত ছড়াগুলি আমাদের শিশু-কিশোর পাঠকদের জন্য একটি বড় উপহার বলে মনে করতে পারি। তিনি প্রধানত শিশু-কিশোরদের জন্য ছড়া ও কবিতা লিখেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় একশ। ফয়েজ আহমদের বইগুলোর মধ্যে 'মধ্যরাতের অশ্বারোহী' সবচেয়ে বিখ্যাত।
ছড়ার বইয়ের মধ্যে-'হে কিশোর', 'কামরুল হাসানের চিত্রশালায়', 'গুচ্ছ ছড়া', 'রিমঝিম', 'বোঁ বোঁ কাট্টা', 'পুতলি' 'টুং', 'জোনাকী', 'জুড়ি নেই', 'ত্রিয়ং', 'তুলির সাথে লড়াই', 'টিউটিউ', 'একালের ছড়া', 'ছড়ায় ছড়ায় ২০০' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি চীনসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচটি বই অনুবাদ করেছেন। এর মধ্যে হোচিমিনের জেলের কবিতা উল্লেখযোগ্য। ফায়েজ আহমেদ ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার প্রাচীন ও সুবৃহৎ আর্ট গ্যালারী 'শিল্পাঙ্গণ'। তিনি প্রগতিশীল পাঠাগার 'সমাজতান্ত্রিক আর্কাইভ' এর প্রতিষ্ঠাতা।
সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, শিশু একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত বরেণ্য ছড়াকার, দেশখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ গত বছরের এই দিনে মৃত্যুবরণ করনে। বাংলা ভাষার শিশুতোষ সাহিত্যিক খ্যাতিমান কবি ফয়েজ আহমেদের মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।