আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লিটলম্যাগ নিয়ে দু’চার কথা

ফোঁটায় ফোঁটায় জহর আমি জমা করে রাখি তোর নাম করে বুড়ি জপি নতুন রুবাই ।

লিটলম্যাগ শব্দটির সাথে আরো একটি শব্দ জড়িত। সেই শব্দটি হলো আন্দোলন। কী সামাজিক আন্দোলন কী শিল্প-সাহিত্যের আন্দোলন। সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতও লিটলম্যাগ আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে।

কারণ সামাজিক আন্দোলনগুলোও কখনো কখনো সাহিত্যের স্রোত হিসেবে বিবেচিত হয়। স্পেনীয় গৃহযুদ্ধ তার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ (সেই অর্থে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিষ্ফলাই থেকে গেলো)। লিটলম্যাগ শব্দটির সাথে আন্দোলন শব্দটি কেন জরুরি? আগে এ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন। তারও আগে মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন লিটলম্যাগ বলতে আমরা কী বুঝি? লিটলম্যাগ যাকে আমরা বাঙলায় বলি ছোটকাগজ, সেই ছোটকাগজ কার প্রেক্ষিতে ছোট আর কিসের নিক্তিতে ছোট? আয়তনে নাকি বোধবুদ্ধিতে? নাকি ব্যঙ্গ করেই বলা হয়েছিল ছোটকাগজ? প্রশ্নগুলো নিয়ে একটু ভাবা দরকার। প্রতিটি শিল্প আন্দোলন উন্মেষকালে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছিল প্রচলিত মূল্যবোধ ও মতাদর্শে বিশ্বাসী লোকদের কাছে।

যেহেতু মিডিয়ার বড় ও বিশাল অঙ্গনটি তাদের দখলে ছিল এবং সেখানে নতুনদের সৃষ্টিকর্ম ও মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ ছিল না আর সৃষ্টিশীল মানুষেরা বরাবরই ছিল একটু খেয়ালি প্রকৃতির- রামকিঙ্কর বলতেন, খেয়াল সবই খেয়ালে আঁকা- ফলে তাদের কাছে বিশাল মিডিয়া তৈরি করার মতো অর্থকড়ি থাকতো না আর তাই তারা তাদের শিল্পকর্ম ও মতাদর্শ প্রচারের জন্য ছোট ছোট পত্রিকা বের করতেন। আকারে সেগুলো খুবই ছোট হতো কিন্তু চিন্তা ও চেতনায় বাঘা বাঘা মিডিয়াকেও পেছনে ফেলে দিত। কালক্রমে সেই পত্রিকাগুলোই লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজ নামে পরিচিতি পায়। লিটলম্যাগ আন্দোলন কেবল শিল্প সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেনি। সুররিয়ালিজম, এক্সপ্রেশেনিজম প্রভৃতি শিল্প আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেমন লিটলম্যাগ আন্দোলন গড়ে উঠেছে তেমনি মার্ক্সবাদকে কেন্দ্র করেও লিটলম্যাগ আন্দোলন গ্রো করেছে।

নয়া কৃষি আন্দোলনকে কেন্দ্র করেও ইদানিং লিটলম্যাগ আন্দোলন গড়ে উঠছে। সেই প্রেতি থেকে বিচার করলে আমাদের দেশে লিটলম্যাগ আন্দোলন তেমনভাবে গড়ে উঠেনি, গড়ে উঠার কোন যুৎসই হেতুও তৈরি হয় নি। বাংলা কবিতায় লিটলম্যাগের প্রসঙ্গ এলেই সর্বাগ্রে আমরা বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার কথা বলি, কিন্তু আমাদের একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কবিতা কখনোই লিটলম্যাগ ছিল না। একটা উৎকৃষ্টমানের কবিতাপত্রিকা ছিল বটে। কিন্তু লিটলম্যাগ যে সমস্ত কমিটমেন্ট দাবি করে তা তাতে ছিল না।

কয়েকজন তরুণ কবির কবিতা এতে স্থান পেয়েছে ঠিক, তাদের ভেতর অভিনবত্ব ছিল, ছিল নতুন চিন্তাও কিন্তু লিটলম্যাগ করার মতো পরিস্থিতি তখনো তারা তৈরি করতে পারেনি। তাদের কবিতা কবিতা পত্রিকা ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত কাগজেও স্থান পেয়েছে। এমনকী কবিতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতাও প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া তখনকার সাহিত্য অঙ্গনের অধিপতি রবীন্দ্রনাথও তাদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফলে তেমন কোন বাঁধার মুখে তারা পড়েনি।

সাহিত্যের পারস্পারিক ঈর্ষা বা কাব্যহিংসার যে জায়গাটি থাকে সে জায়গাটি থেকে নিজেদের উৎকর্ষ বিধানের জন্যই কবিতা পত্রিকার জন্ম হয়েছিল। কারণ আমরা দেখি কবিতায় বুদ্ধদেব বসুরা কোন নির্দিষ্ট শিল্প আন্দোলনকে ফলো করেনি এমনকি তারা কোন দর্শন অথবা মেনুফেস্টোও ঘোষণা করেনি। ছোটকাগজ প্রশ্নে কবিতার চেয়ে আমি বরং তত্ত্ববোধিনীকে এগিয়ে রাখতে চাই। ছোটকাগজ আন্দোলনে তত্ত্ববোধিনী আমাদের প্রথম ধাপ এবং এখনও পর্যন্ত এর চেয়ে ভাল কোন উদাহরণ আমরা তৈরি করতে পারিনি। তত্ত্ববোধিনী যে যাত্রার সূচনা করেছিলো তাকে আমরা এগিয়ে নিতে পারতাম, কবিতা সে সম্ভাবনাও তৈরি করেছিলো কিন্তু কেন জানি শেষ পর্যন্ত হয়নি।

কয়েক দশক পরে হাংরি জেনারেশন আবারও লিটলম্যাগের প্রেতি তৈরি করলো। কিন্তু হাংরিও অকালে দম ফুরিয়ে মাঝপথে হাটুভাঙা দ’র মতো পড়ে রইলো। বর্তমান সাহিত্যে লিটলম্যাগের এই দুরবস্থা শুধু বাঙলা সাহিত্যেই নয় বরং এই অবস্থা সামগ্রিক। লিটলম্যাগ আন্দোলন কবিতার প্রান্তর ছেড়ে নয়া কৃষি আন্দোলনে জায়গা করে নিলেও কবিতা লেখা তো আর বন্ধ হয়ে যায়নি। ফলে কবিতার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য লিটলম্যাগের স্থান দখল করে নিয়েছে কবিতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন পত্রিকা।

যেগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে। কবিতার উৎকর্ষ বিধান, নতুন কবির দাঁড়াবার জায়গা করতে আমাদের কবিতা পত্রিকাগুলো- যেগুলোকে কবিতার কাগজ বললে সুবিধা হয়- গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এই কবিতার কাগজগুলো ভিন্ন আঙ্গিক থেকে একই আদর্শ ধারণ করছে। বিভিন্নজনের ভিন্ন ভিন্ন কনসেপ্ট রয়েছে সত্যি কিন্তু সেই কনসেপ্টগুলো আবার একবিন্দুতে এসে মিলে যায়। সেই বিন্দুটি প্রগতিশীল চিন্তা এবং চেতনার।

এই প্রগতিশীল চিন্তা ও চেতনার উন্মেষের ধারক হিসেবে গত শতকের নব্বই দশকে বাঙলা সাহিত্য বিশেষত বাঙলা কবিতা নিয়ে প্রচুর কাগজ হয়েছে। নব্বই দশকের শুরুতে এই কাগজীরা একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে কাজ করেছে আর সেটি হলো প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, কেন্দ্রিকতা বিমুখ এবং তারুণ্য ও নতুন চিন্তার প্রসার। এর মাঝে তারুণ্য ও নতুন চিন্তার প্রসারের কাজটি সেই কবিতা থেকে শুরু করে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল হয়ে আহসান হাবীব সম্পাদিত দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতা এবং আবু হাসান শাহরিয়ার সম্পাদিত দৈনিকের সাহিত্য পাতা ও পরে সার্বভৌম সাহিত্য পত্রিকা খোলা জানালা হয়ে শামীম রেজা সম্পাদিত অধুনালুপ্ত আজকের কাগজ’র সাময়িকী সুবর্ণরেখার মতো দৈনিকের সাহিত্য পাতাগুলোও করছে। অপরদিকে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছিল নব্বইয়ের কবিদের এক ধরণের ফ্যাশান। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার নাম করে তারা মূলত দৈনিক বিরোধিতাই করেছে।

কিন্তু এর পেছনে তারা কোন যুৎসই হেতু আমাদের দেখাতে পারেনি। পরবর্তীতে তাদের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এই স্টান্ট তারা নিজেরাই ধরে রাখতে পারেনি। একে একে প্রায় সকলেই কোন না কোন ভাবে প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয়েছে। কারণ, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কেন? প্রশ্নটির সঠিক উত্তর তারা নিজের কাছ থেকেই বের করতে পারেনি। নব্বইয়ের কাগজীদের যে ভূমিকাটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তা হলো কেন্দ্রবিমুখতা।

অর্থাৎ কবিতাকে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নিয়ে যাওয়া। কবিতার ভৌগোলিক আভিজাত্যকে দু’পায়ে পিষ্ঠ করে রাজধানীর রাজকবির কবিতার পাশাপাশি প্রান্তিকের এক নাম না জানা কবির কবিতাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করা ও করার সুযোগ করে দেওয়া। এতে করে যে লাভটি হয়েছে তা হলো আমরা একঝাঁক নতুন কবিকে পাঠ করতে পেরেছি। নব্বই দশকে যে আমরা শতাধিক কবির কবিতা আস্বাদন করতে পেরেছি তার পেছনে মূল কারণটি ছিল এই। এ কারণেই নব্বই দশকের শুরু থেকেই আমরা দেখি কবিতার কাগজগুলো রাজধানী নয় বরং বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বের হতে থাকল।

কিন্তু এই প্রবণতা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি। কারণ এই কেন্দ্রবিমুখতা প্রবণতাটি নব্বইয়ের কাগজীরা যতটা না আদর্শ হিসেবে নিয়েছে তার চেয়ে বেশি নিয়েছে আবেগ হিসেবে। ফলে এক দশকেই তাদের অনেকেই ঝিমিয়ে পড়েছেন। নব্বইয়ের কাগজীরা কবিতার কাগজের মধ্য দিয়ে কবিকে ও কবিতাকে নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন ঠিকই। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা সফল হয়নি।

তাদের কাগজের মধ্য দিয়ে একঝাঁক কবি উঠে এসেছে ঠিকই কিন্তু অবিন্যস্ততা ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে কবিতার কাগজ সেভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে নি। কিছু টেকনিক্যাল বিষয়ে কাগজীরা পেশাদারিত্ব আনতে পারেনি। তার মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো কবিতার কাগজগুলো পাওয়া যায় এমন কোন একটি স্থান নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে ঢাকার আজিজ মার্কেটে শামীমুল হক শামীমের উদ্যোগে লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ নামে কবিতার কাগজ পাওয়া যায় এমন একটি কেন্দ্র হয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগটি জেলায় জেলায় হওয়া জরুরি ছিলো যা নব্বইয়ের কাগজীরা তাদের সময়ে করতে পারেনি, এখনো হয়নি।

কাগজ সম্পাদকদের বাড়িতে, ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় ও কিছু হাতে গোনা বইয়ের দোকানে কবিতার কাগজ পাওয়া যায় বটে কিন্তু সেগুলো একেবারেই অপ্রতুল। সময় এসেছে কবিতার কাগজীদের এরকম উদ্যোগ নেওয়ার। দ্বিতীয়তঃ কোন কাগজই তেমন উল্লেখযোগ্য কোন লেখকগোষ্ঠী তৈরি করতে পারেনি। কবিতার কাগজের জন্য যা ছিলো জরুরি। লেখক গোষ্ঠীর অভাবে সময় মতো কোন কাগজই পাঠকের হাতে পৌঁছতে পারে না।

কোন কাগজ যদি কোন গোষ্ঠী তৈরি করেও ফেলে তবে তা ব্যক্তিস্বার্থচরিতার্থতায় পর্যবসিত হয়। সেখানে কোন আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। এইসব সীমাবদ্ধতার কারণে এক দশকেই নব্বইয়ের কবিতার কাগজের অন্তসারশূন্য রূপটিও আমাদের দেখতে হলো। ফলে শঙ্খ ঘোষের ভাষায়- এক দশকেই সঙ্ঘ ভেঙে যায়। দশক যায় দশক আসে।

সঙ্ঘ ভাঙে সঙ্ঘ গড়ে। নব্বইয়ের এই অন্তসারশূন্যতার ভেতর দিয়েই শূন্য দশকে কবিতার কাগজের যাত্রা শুরু হয়। প্রথম যখন শুরু হয় তখন ছিল নিছক জানান দেওয়ার প্রবণতা। ফলে একটু বেশি হাউমাউ, চেচাঁমেচি হওয়াটাই স্বাভাবিক। হয়েছিলও তাই।

একটা নতুন উন্মাদনা, অপরিণত আবেগ ইত্যাকার বিষয় শূন্যের কাগজগুলোকে অবিন্যস্ত ও অপরিকল্পিকতভাবে গড়ে তুলেছে। কিন্তু আজ সাত/আট বছর পেরিয়েও আমরা একটি পরিকল্পিত রূপরেখা পাইনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- কাগজ কেন করছি? এ বিষয়ে নিজের কাছে সাফ-সুতরো হতে পারছি না। প্রথম দিকে নিজেদের জানান দেওয়ার জন্য দল ভারি করার যে প্রবণতা আমাদের ভেতর ছিলো তার পেছনে আমরা কোন আইডিয়লজিক্যাল ভিউ দাঁড় করাতে পারেনি। পরন্তু কাগজের মেদভূঁড়ি নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছি।

কাগজ মোটাতাজা করতে না পারার বেদনায় এখনি কেউ কেউ কাগজ করার চিন্তা বাদ দিয়েছি। নব্বইয়ের কেন্দ্রবিমুখতাকে আমরা জলাঞ্জলি দিয়ে বড় বেশি কি রাজধানীকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি না? যে কাজটি নব্বই করেছিল দশকের শেষে এসে আমরা সেই কাজটি শুরু করে দিয়েছি দশকের মাঝামাঝিতেই। আর এই সমস্ত কারণে নব্বই কবিতার কাগজের যে ন্যূনতম প্ল্যাটফর্মটি আমাদের জন্য তৈরি করেছিল তাও আমরা নষ্ট করতে বসেছি। অথচ নব্বইয়ের অন্তসারশূন্যতা আমাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছিলো শিা নেওয়ার। অবশ্য সময় পেরিয়ে যায়নি।

ঘুরে দাঁড়ালে এখনো সম্ভব আদর্শিক ভিত্তি থেকে গোষ্ঠী তৈরি করে কবিতার আন্দোলন তৈরি করা। তাতে করে কবিতার কাগজের স্টেজকে কবিতাকেন্দ্রিক লিটলম্যাগ আন্দোলনে পরিণত করা যাবে। জেলায় জেলায় লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ তৈরি করে লিটলম্যাগকে নিয়ে যেতে হবে অনাগতকালের কবিটির কাছে। কবিতাকে নষ্টামি ও নোংরামির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এটা এখন জরুরি।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.