আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তি, স্বপ্ন, জাদুবাস্তবতা ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস

আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি

তরুণ বয়সটা খুবই খতরনাক্- মাথার ভেতরের দুনিয়াটা ভেঙেচুরে উলটপালট করে দেয়। বাইরের জিনিসগুলো তখনও আস্ত থাকে বলে মনে হয় সেগুলোর সবকিছু চুরমার করে ফেলি। মানুষ শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিশীল বলে নতুন করে গড়ার ইচ্ছেটা ভাঙার সাথে সাথেই প্রবলতর হয়ে উঠে। মানুষের জন্মের সময় মস্তিষ্কে সাম্য-অসাম্যের কোনো উপাদান থাকে কিনা জানি না, তবে শৈশবকালে অসাম্যের দিকগুলো খুব একটা ধরা দেয় না। আস্তে আস্তে বড় হওয়ার সাথে সাথে মানুষ প্রবলভাবে আবিষ্কার করে এই দুনিয়া কতোই না অসাম্যে ভরা! তখন সে বিস্মিত হয়, চিন্তিত হয়, ক্রোধান্বিত হয়, বিক্ষুব্ধ হয়।

এই নানা ধরনের ‘হওয়া’র পাশাপাশি মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থগুলোতে জন্ম নিতে থাকে আরও দুটি উপাদান— আশা ও স্বপ্ন। বিশেষ করে অসাম্যের পাইপলাইনে যাদের নিত্য-বসবাস, তাদের একটি বিরাট অংশের পুঁজিই থাকে মাত্র দুটো জিনিস— স্বপ্ন আর আশা। পূর্বসূরিদের স্বপ্নের ধারাবাহিকতা ভর করে উত্তরপুরুষদের মাঝে। কৈশোরকালের কথা মনে পড়ে— আস্তে আস্তে তরুণ বয়সের দিকে এগিয়ে চলেছি— টুকটাক দু’একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে কুটকুট করা শুরু করেছে। পাশের বাড়ির ওরা এতো কিছু খায়, আমি কেন একটা বড় ইলিশের টুকরা পাই না? তরুণ বয়সে নিজের খাওয়াটা গৌণ হতে থাকে।

বাস্তবতার জগতে যখনই মাত্র ঘুম থেকে উঠা— তখনই দেখি অসাম্য শুধু খাওয়াতে সীমাবদ্ধ নেই! আস্তে আস্তে আবিষ্কৃত হতে লাগলো— পুরো পৃথিবীটাই নানান জাতের অসাম্যে ভরা। ‘ছোটদের অর্থনীতি’ কিংবা ‘ছোটদের রাজনীতি’ এসময় হাতে ধরিয়ে দিলেন কিছু বড়-তরুণ। ছোট ছোট ধাপগুলো পেরিয়ে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, মাও, চে কিংবা ক্যাস্ত্রোদের জগত থেকে আবিষ্কৃত হতে থাকলো কার্য ও কারণের অবিচ্ছিন্ন সূত্রগুলো। এরই মধ্যে উদীচীর এক অনুষ্ঠানের কিছু গান জানিয়ে দিলো হেমাঙ্গ বিশ্বাস নামের আরেক তরুণতর এই অসাম্যের বিষয়গুলো নিয়েই গান করেন— খেটেখাওয়া মানুষ যার বলিষ্ঠ কণ্ঠের যোগানদাতা। প্রবল উৎসাহে নিউ মার্কেট থেকে কিনে আনি তাঁর গাওয়া গানের ক্যাসেট।

ধার করা ওয়াকম্যানে দিনের পর দিন শুনতে থাকি সুরেলা কথায় অসাম্যের নানা কাহিনী, কথা, চিন্তা, বাস্তবতা কিংবা (হয়তো) জাদুবাস্তবতার কথা। মিছিলের প্রতিটি স্লোগানের মতোই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের সুর মগজে মাদকতা ছড়ায়, বিটগুলো ছন্দোবদ্ধ লয়ে অনুরণিত হতে থাকে— হতেই থাকে। একটা সময় পর দূরত্ব বাড়তে থাকে— মিছিলের ময়দান ক্রমশই দূরবর্তী তেপান্তরের মাঠ হয়ে যায়। প্রোফাইলে লেখা আছে আমার— সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, অপছন্দ সমাজের তান্ত্রিকদের। তান্ত্রিকদের ওই অবোধ্য নানা মন্ত্র আস্তে আস্তে দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিতে থাকে।

তর্ক-বিতর্কের ময়দানে একসময় দেখি চেষ্টা চলে আবেগ দ্বারা বশীভূত করার, ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইলের। অনেককিছু মেলে না, আর অনেককিছু মিলাই না। আপন নিজেকে রেখে পর নিজেকে নিয়ে সরে আসি সেখান থেকে। ...কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস কখনোই আমাকে ছাড়েন না। আমিও ছাড়ি না হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে।

দু’বন্ধুর এই জগতে আজও কোনো গভীর রাতে মোবাইলের মিউজিক প্লেয়ার কানে কানে বলে যায়— গাও ইন্টারন্যাশনাল, মিলাও এ মানবজাত! সত্যিই কি মানবজাত মিলবে! মধ্যবিত্তীয় দোদুল্যমানতায় হেমাঙ্গ আবারও দৃঢ়তর হন— আমরা করবো জয়, নিশ্চয়ই! এই অফুরান আত্মবিশ্বাসের উৎস কী? ধন্ধে পড়ে যাই, ভাবতে থাকি। ছোট্ট মাথায় সারা বিশ্বের ভাবনা আসে না। এই বাংলাদেশের কথাটুকুই শুধু ভাবি— হেমাঙ্গ বিশ্বাস নানাভাবে নানাসুরে ভাবনা খোরাক দিয়ে যান, ভাবনা দূর করে যান। আর যাওয়ার সময় বলে যান রবসনের কথা। নিগ্রো ভাই আমার পল রোবসন! আমাদের আশেপাশে কতো রোবসন! কখনো ওদের দিকে তাকাই, কখনো উপেক্ষা করি, অবহেলা করি।

ওদের শক্তি কিংবা উদ্যমতা হয়তো এই ছোট্ট মস্তিষ্ক কখনোই ধারণ করতে পারবে না— কিন্তু মুক্তির দিকে তাকানোর স্বপ্নটাকে মাঝে মাঝে নাড়িয়ে দেওয়া এই রোবসন-হেমাঙ্গদের হঠাৎ করেই কুর্নিশ করতে ইচ্ছে করলো! (এই লেখার সাথে ইন্টারন্যাশনাল, আমরা করবো জয় আর রোবসন গান তিনটি জুড়ে দিয়েছিলাম- ইস্নিপসের লিঙ্ক হিসেবে। কিন্তু কাজ করছে না। গানগুলো হয়তো অনেকের ভালো লাগতো। )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.