সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
যেভাবে জন্ম হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরঃ
ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে এক সফরে পূর্ববাংলা ও আসামে আসেন। তিনি সে সময় ঢাকার এক প্রতিনিধি দলের কাছে ঘোষণা করেন বিগত কয়েক বছরে পূর্ববঙ্গ শিক্ষা-দীক্ষায় যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তার ধারাবাহিকতায় ইংরেজ সরকার খুশি হয়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে ইচ্ছুক। কিন্তু এতে নাখোশ হয় কলকাতার শিক্ষিত শ্রেণী। তারা মনে করে, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কমে যাবে। ড. রাশবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে তাদের একটি প্রতিনিধি দল দেখা করেন লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে।
হার্ডিঞ্জ তাদের এই বলে আশ্বস্ত করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো মুসলিম বিশ্ববদ্যালয় হবে না বরং এটা হবে সাধারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ রোধের আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় করবার।
সেজন্য ১৯০৯-১০ সনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য সে সময়কার প্রাদেশিক সরকার একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিই ১৯১২ সালে ২৭ মে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানকে সভাপতি করে ১৪ সদস্যের কমিটি করেন। সেটির নাম ছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি কমিটি।
নাথান কমিটি আরো ২৫টি সাব-কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট পেশ করে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ৫৩ লাখ টাকা আর বাৎসরিক খরচ বাবদ ১২ লাখ টাকা। এই কমিটি আরো প্রস্তাব করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার পরিচালিত একটি স্টেট ইউনিভার্সিটি করতে। আর এতে প্রকৌশল, আইন, চিকিৎসা, ইসলামিক স্টাডিজ, কলা, বিজ্ঞানে স্নাতোকত্তর ডিগ্রীর ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণের জন্য রমনা অঞ্চলের ৪৫০ একর জমি অধিগ্রহণের সুপারিশ করে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য যে ৪৫০ একর (প্রায় ১৪০০ বিঘা) জমি অধিগ্রহন করা হয়েছিল-সেই সব জমির মালিক ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নাথান কমিটির রিপোর্ট সেক্রেটারি অব স্টেট দ্বারা অনুমোদিত হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুরু হচ্ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইংরেজ সরকারের আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিল না। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের বাজেট ৫৩ লাখ থেকে কমিয়ে ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হয়। কিন্তু সেটাও বাস্তবায়ন হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ইংরেজ সরকারের তেমন একটা আগ্রহ না দেখে পূর্ববঙ্গের মানুষদের মনে সন্দেহ দেখা দেয় আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে কিনা। ১৯১৭ সালের পর পূর্ববঙ্গের মুসলমানের দাবির মুখে আবার একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতার ফলে সময়ক্ষেপণ হতে থাকে। ওই সময়ে ঢাবি প্রতিষ্ঠার বুরুদ্ধে আরো যারা আন্দোলন করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, বরিশালের অশ্বীনি কুমার দত্ত সহ দুই বাংলার বেশীর ভাগ হিন্দু জমিদার। এবিষয়ে আমি আর একটা পোস্ট দেবো আশা করি।
সকলের বিরোধীতার পরেও ঢাবি স্থাপনে স্যার সলিমুল্লাহ অবদান অনশ্বীকার্য্য। অবশেষে বেশকিছু বিষয় রদবদল করে ১৯২০ সালে ভারতীয় আইন সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন রূপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন বিষয়টি গৃহীত হয় এবং গভর্নর জেনারেল ১৯২০ সালে চূড়ান্তভাবে তাতে সম্মতি দেন। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্ট্রার ফিলিপ হার্টগ। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথমদিকে তিনটি হল: মুসলিম হল, ঢাকা হল এবং জগন্নাথ হল নিয়ে যাত্রা শুরু করে।
১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক জরিপে দেখা যায় মুসলিম হল, ঢাকা হল এবং জগন্নাথ হলে ছাত্র ছিল যথাক্রমে ১৭৮ জন, ৩৮৬ এবং ৩১৩ জন অর্থাৎ মোট ৮৭৭ জন ছাত্র ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনার দীর্ঘসূত্রতায় পেছনে সাম্প্রদায়িক কারণ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর সেই সাম্প্রদায়িক আগুন বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রাস করতে পারেনি। এর জন্য মূল উদ্যোগটা নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। যদিও এই শিক্ষকদের মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের লোকজন ছিলেন। কিন্তু তাদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ছাত্রদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে।
বিশেষ করে প্রথম দিককার এ এফ রহমান, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, জ্ঞানঘোষ, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, নরেশ সেনগুপ্তরা তাদের ঔদার্য্য ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে এই অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্ব অর্জন করে। এতে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পনের ষোল বছরের মধ্যে সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে আদর্শ বিদ্যাপীঠস্থান হিসেবে স্থান করে নেয়। ফলে এটি আখ্যায়িত হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে। শুধু শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে নয় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে উঠতে থাকে।
বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন শুরু হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এ সময়কার বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে মুসলিম সাহিত্য সমাজের কথা। এতে যুক্ত হয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক আবুল হোসেন, আব্দুল কাদির, অধ্যাপক কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী আনোয়ারুল কাদির, শামসুল হুদা, অধ্যাপক মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল প্রমুখ, যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্র ছিলেন।
চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা যায়। বিশেষ করে অধিকাংশ মুসলমান ছাত্র-শিক্ষকদের সমর্থন ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি।
তবে পাকিস্তান আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন। এ সময়কার মূল ইস্যু হয়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম সরকারি সফরে ঢাকায় এসেছে ১৯৪৮ সালে ১৯ মার্চ রমনার রেসকোর্সে ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এতে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এবং পূর্ববঙ্গের জনগণ জোড়ালোভাবে এটার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বলা যায় এর মাধ্যমেই রোপিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের বীজটি।
এই আন্দোলন আরো ডালপালা মেলে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। সেই দিনের আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরের প্রত্যেকটি যুগান্তকারী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই ৫২ থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৭৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। এমনকি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও রাজনৈতিক বিভিন্ন আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সোচ্চার।
১৯৮২ সাল থেকে ৯০-এর স্বৈরাচারী এরশাদের সরকার বিরোধী আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি অনুষদ, ৯টি ইনষ্টিটিউট, ৫৪টি বিভাগ, ৩৪টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ১৮টি আবাসিক হল, ৫৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ৩ টি অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়রনত ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা প্রায় ২৮,৪৯৮ জন। আর এদের শিক্ষাদানে এবং গবেষণায় আছেন ১৫৬৫ জন শিক্ষক।
তথ্যসূত্র: ঢাকা কথা- রফিকুল ইসলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।