কেবল সমুদ্র পারে শুষে নিতে সব, যা কিছু বিপ্রতীপ, ভেসে আসে নিদারুণ কষ্টের নীলজলে..
প্রথমবার দেখার সময় পুরো বিষয়টি আপনার কাছে আশ্চর্য্যজনকই মনে হবে। আমার হাতে নোকিয়ার S60 সিরিজের একটি মোবাইল ফোন। এ ফোনের উপরের দিকের একটি বাটন আমি চেপে ধরলাম। একটি ছোট্ট বিপ শব্দ হলো। সাথে সাথে আমি বলে উঠলাম-‘শ্রীকান্ত আচার্য্য, আমার সারাটা দিন’।
ব্যস, মাত্র ৫ সেকেন্ডের মধ্যে মোবাইলটিতে শুরু হয়ে গেল শ্রীকান্ত আচার্য্যের বাংলা গান -‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ...বৃষ্টি তোমাকে দিলাম...’।
এরপর একটু পরেই এ গান বন্ধ করে দিয়ে আবার সেই একই বাটনে হাত রাখলাম। আবার বিপ শব্দ। এবার বলে উঠলাম-‘মান্না দে-কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’। সাথে সাথে আবার শুরু হয়ে গেল মান্না দে-র সেই বিখ্যাত গান- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...’।
হ্যা, অবিশ্বাস্য মনে হলেও Nokia-র “Say & Play” ফাংশন সমৃদ্ধ 5320 মডেলের এক্সপ্রেস মিউজিক মোবাইল ফোন দিয়ে আজ এ অসাধারণ আনন্দের বিষয়টিই সম্ভব হয়েছে। আমার এ ফোনে এ পর্যন্ত দশ জন শিল্পীর গাওয়া প্রায় চারশ MP3 বাংলা গান ভরেছি। এই চারশ গানের মধ্য থেকে যখন যে গান শুনতে ইচ্ছে করে, আমি তা শুনতে পাচ্ছি শুধুমাত্র শিল্পীর নাম আর গানের প্রথম লাইন উচ্চারণ করেই। .....এ গান চালু করার জন্য মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকানো বা গানের তালিকা স্ক্রল করার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু মোবাইলের উপরের দিকে সামান্য উঁচু হয়ে থাকা একটি গোলাকার বাটন চেপে ধরে (যা কীনা অন্ধকার ঘরেও শুধু হাত দিয়ে অনুভব করে চেপে ধরা সম্ভব) তারপর মোবাইলের কাছে মুখ নিয়ে শিল্পীর নাম এবং গানের প্রথম লাইন উচ্চারণ করলেই চলে ।
এভাবে শুধু মুখে উচ্চারণ করে Nokia ফোনে যখন যেমন ইচ্ছে যে কোন গান শোনার কাজে সাহায্যকারী এ গোলাকার বাটনটির নামও দেওয়া হয়েছে Say & Play Button.।
আমার কাছে নোকিয়া ফোনের গান সার্চ করার এই “স্পীচ রিকগনিশন” নির্ভর ফাংশনটি এ যাবৎ উদ্ভাবিত নোকিয়া ফোনের অন্য সকলপ্রকার ফাংশনের তুলনায় ‘সেরা ও চমকপ্রদ’ মনে হয়েছে। আমার মনে পড়ে, একসময় বিভিন্ন অডিও ক্যাসেট থেকে বেছে বেছে পছন্দের সেরা গানগুলো শুনতে গিয়ে আমাদের টেবিলে ক্যাসেটের পাহাড় জমে যেত। পছন্দের প্রিয় গানটি প্লে করার জন্য ক্যাসেট বারবার Rewind অথবা Forward করতে হত। এতে করে অনেকসময় ক্যাসেটের ফিতা-ও ছিঁড়ে যেত।
...
এরপর এলো সিডি ডিভিডির যুগ। সেখানে যদিও কম্পিউটারের স্ক্রীনে চোখ রেখে গানের তালিকা ব্যবহার করে শুধু মাউস ক্লীকের মাধ্যমেই পছন্দের গানটি প্লে করার সুযোগ এলো, কিন্তু সেখানেও বিভিন্ন শিল্পীর দশ বারোটির বেশী পছন্দের গান শোনার জন্য হয়তো কভার/বক্স খুলে সিডি বের করতে হয় বিশ পঁচিশটি...। গান শোনা শেষ হলে নির্দিষ্ট কভার বা বক্সের ভেতর নির্দিষ্ট সিডিগুলো আবার ঠিকঠাক সাজিয়ে রাখতেও সময় লেগে যায় প্রচুর। ...
হয়তোবা গান শোনার ক্ষেত্রে এইসব নানাধরনের অহেতুক ঝামেলার বিষয়গুলো এক নিমিষে দূর করতেই এসেছে নোকিয়ার Say & Play ফাংশান। যখন যেখানে ইচ্ছে- যে কোন প্রিয় গান শুধু শিল্পীর নাম আর গানের একটি লাইন উচ্চারণ করেই আপনি শুনতে পারবেন এখন।
যদি কোন প্রচন্ড সঙ্গীত প্রিয় লোক এ বিষয়টি জানতে পেরে আনন্দ-আবেগে বিস্মিত হয়ে বলে ওঠেন- “আরে ! এটাইতো ছিল আমার সারা জীবনের একটি স্বপ্ন...!”, তবে তার উদ্দেশ্যে বলছি, আপনার সারাজীবন ধরে নীরবে নিঃশব্দে দেখা সেই স্বপ্নটিই আজ আনন্দময় বাস্তব। একেবারেই হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিয়েছে সেই স্বপ্ন আজ। ...
তবে আমার এ লেখা পড়েই চট করে কেউ Nokia 5320 কিনতে মার্কেটে চলে যাবেন না...। এই ফোনের এই Say & Play ফাংশান যথাযথভাবে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে আপনার আরো যা যা জানা প্রয়োজন তা হচ্ছে-
(১) বাংলা গানের ক্ষেত্রে Say & Play ফাংশন যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য আপনাকে সংশ্লিষ্ট গানগুলোর MP3 ট্যাগ এডিট করতে হবে। MP3 ট্যাগ এডিট করার সময় কম্পিউটারে বসে বাংলা গানগুলোর শিল্পীর নাম ও গানের প্রথম লাইন সঠিক বাংলা উচ্চারণ অনুযায়ী ‘ইংরেজী বর্ণমালা’য় লিখে তারপর নতুন করে Save করে নিতে হবে এবং ডাটা ক্যাবল বা কার্ড রীডার এর সাহায্যে পরিবর্তিত ট্যাগ যুক্ত গানগুলো কম্পিউটার থেকে মোবাইলে ভরতে হবে।
(বাংলা গান ছাড়া শুধু ইংরেজী গানের ক্ষেত্রে Say & Play ফাংশান ব্যবহার করতে গেলে অবশ্য ট্যাগ এডিট এর ঝামেলায় তুলনামূলকভাবে কম যেতে হবে, কেননা অনেক MP3 ইংরেজী গানের ট্যাগেই শিল্পীর নাম বা গানের প্রথম লাইন সঠিকভাবেই লেখা দেখতে পাওয়া যায়। )
(২) MP3 ট্যাগ এডিট করার সময় একই শিল্পীর গানের ক্ষেত্রে একই ধরনের উচ্চারণ রীতি অনুসারে একই ধরনের বানান অনুসরণ করতে হবে। যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানের ক্ষেত্রে শিল্পীর নাম হিসাবে একবার Hemanto Mukhopaddhay আরেকবার Hemanto Mukharjee লেখা যাবেনা। যে কোন একটি নামের ধরণ/বানান বেছে নিতে হবে। এতে করে আরো একটি সুবিধা পাওয়া যাবে।
আপনি যখন ফোনের Say & Play বাটন চেপে ধরে কোন গানের প্রথম লাইন উচ্চারণ না করে শুধু শিল্পীর নাম হিসাবে Hemanto Mukhopaddhay উচ্চারণ করবেন তখন আপনার ফোনের মেমরী কার্ডে থাকা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সবগুলো গান অটোম্যাটিক্যালী সর্ট (Sort) হয়ে গিয়ে একের পর এক ফোনটিতে বাজতে থাকবে।
গানগুলোর MP3 ট্যাগ এডিট করার সময় আপনি ইচ্ছে করলে একজন শিল্পীর কয়েকটি নির্দিষ্ট গানের জন্য আপনার ইচ্ছে অনুসারে একটি অ্যালবাম-নাম সংযোজন করতে পারেন। পরে প্রয়োজনের সময় Say & Play বাটন চেপে সেই অ্যালবাম-এর নাম উচ্চারণ করেও সেই কয়েকটি নির্দিষ্ট গানকে (অ্যালবাম-এর নাম অনুসারে) সর্ট (Sort) করে একের পর এক শুনতে পারেন।
(৩) এছাড়াও গানগুলোর MP3 ট্যাগ এডিট করার সময় আপনি ইচ্ছে করলে Windows Media Player-11 ব্যবহার করে গানগুলোর অ্যালবামের ছবি হিসেবে সংশ্লিষ্ট শিল্পীর একটি ছবি (আপনার সংগ্রহ থেকে বা ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে) Windows Media Player-11 -এর “Album Art” সংযোজনের নিয়মানুসারে সংযোজন করতে পারেন। এর ফলে গানগুলো মোবাইল ফোনে প্লে হবার সময় গানের সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পীর একটি ছবিও মোবাইল ফোনের পর্দায় ভেসে থাকবে।
(৪) এতো কিছুর পরেও আপনার ফোনে বাংলা গানের ক্ষেত্রে Say & Play ফাংশন শতকরা ১০০ ভাগ কার্যকর না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনাকে আপনার ফোনের আভ্যন্তরীণ সেটিংস পরিবর্তন করে Speech Recognition Sensitivity-র মাত্রা Adjust করে নিতে হতে পারে।
আমার জানামতে, নোকিয়া এপর্যন্ত তাদের রিলিজ করা কেবলমাত্র দু-তিনটি মডেলের মোবাইল ফোনে এই Say & Play ফাংশন সংযোজন করেছে। নোকিয়ার Say & Play ফাংশন সংযোজিত প্রথম মোবাইল ফোনটি খুব সম্ভবত Nokia-5320 Xpress Music. এ ফোনটি সর্বোচ্চ চার গিগাবাইটের Micro SD Card সাপোর্ট করে। তাই কম করে হলেও প্রায় ১০০০ বাংলা MP3 গান এতে ভরা যায় অনায়াসেই।
এছাড়াও ফোনটি নোকিয়ার S60 সিরিজের সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেম সমৃদ্ধ ফোন বলেই এতে অন্যান্য সফটওয়্যার ভরে আরো নানারকম কাজ করা যায় (ভবিষ্যতে এসব বিষয়ে আরো লেখার ইচ্ছে রাখছি) ।
বিনীতভাবে জানাই, আমি নিজে দীর্ঘদিনের চেষ্টায় প্রায় চারশ বাংলা গানের MP3 ট্যাগ এডিট করে (অর্থাৎ বাংলা উচ্চারণ অনুসারে সঠিক বানানে ইংরেজীতে শিল্পীর নাম ও গানের প্রথম লাইন লিখে) এগুলোকে স্পীচ রিকগনিশন-যোগ্য বানিয়েছি বা Say & Play ফাংশানের উপযোগী বানিয়েছি। আমি এ গানগুলোর ট্যাগে Windows Media Player-11 ব্যবহার করে Album Art হিসেবে শিল্পীর ছবিও সংযোজন করেছি। ফলে গানগুলো Nokia-5320 সেটে প্লে হবার সময় সংশ্লিষ্ট শিল্পীর ছবিও ভেসে থাকছে মোবাইলের স্ক্রীনে। ...
পরিশেষে ঈদের একদিন পরের কথা বলি।
সকাল থেকেই আকাশ কেমন যেন মেঘলা মেঘলা। এদিকে আমার পায়ে হঠাৎ করেই অজানা কোন কারণে ব্যথা শুরু হয়েছে। পায়ের ব্যথায় কাতর হয়ে আমি বিছানায় শুয়ে আছি। কিছুই ভালো লাগছে না, কিছুই করার নেই। ... কী করবো, কীভাবে সময় কাটাবো ভাবছি।
... এমন সময় আমার মোবাইলের Say & Play ফাংশনের কথা মনে পড়ল। ... বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে বালিশের কাছে পড়ে থাকা মোবাইলটাকে নিয়ে এলাম মুখের কাছে। চোখ বন্ধ করেই Say & Play ফাংশনের বাটনটাকে চেপে ধরে ফিসফিস করে শুধু বললাম-“সন্ধ্যা মুখার্জী, খোলা আকাশ কী এতো ভালো লাগতো”। ব্যস, শুরু হয়ে গেল সন্ধ্যার গাওয়া সেই অসাধারণ গান-
খোলা আকাশ কী এতো ভালো লাগতো ?
যদি কিছু কিছু মেঘ না-ই ঢাকতো !
বলো জীবন কী সুন্দর হতো এমন?
যদি একটুও ব্যথা না-ই থাকতো!
গানের যাদুমাখা কথার মধ্যে ডুবে যেতে যেতে ভাবছিলাম-আসলেই মাঝে মধ্যে এরকম কিছু কষ্টের মধ্যে থাকা ভালো। এরপর যেদিন সুস্থ হয়ে আবার হাঁটতে পারবো, এরপর যেদিন আবার সুস্থ দুই পায়ে ভর করে বাইরে বের হতে পারবো, সেদিন দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিনের চিরচেনা এই পৃথিবীকে নিশ্চয়ই একটু অন্যরকম আরো বেশী ‘ভালো লাগাময়’ মনে হবে !
আধাঁর আছে বলেই তো আলোর এতো কদর! বেদনা আর বিচ্ছেদ আছে বলেই জীবনের সুখটাকে উপলব্ধি করা যায় আরো গভীরভাবে! এসব কথা যখন ভাবছি, মোবাইলে তখন ভেসে আসছে সন্ধ্যার গানের পরবর্তী অংশ-
যদি সারাক্ষণ থাকতাম সামনেই -
আমি দেখতাম আর আমার দাম নেই..
জেনো মাঝে মাঝে আড়ালে না হারালে..
ওই মন কী আমায় মনে রাখতো?....
....................................................................
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।