মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একজন বিজ্ঞানী। সফল বিজ্ঞানী। বাঙালির গৌরব তিনি। তিনি নানা বিষয়ে গবেষণা করেছেন।
তবে তাঁর গবেষণার প্রধান দিক ছিল উদ্ভিদ ও তড়িৎ চৌম্বক। তার আবিষ্কারের মধ্যে উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ ও উদ্ভিদের দেহের উত্তেজনার বেগ নিরুপক সমতল তরুলিপি যন্ত্র রিজোনাষ্ট রেকর্ডার অন্যতম। গাছের প্রাণ সম্পর্কে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ ধারণা দিতে পারেননি। জগদীশ চন্দ্র বসুই পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, উদ্ভিদের প্রাণ আছে। উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
জগদীশ চন্দ্র কাজ করেছিলেন অতিক্ষুদ্র তথা মাওক্রো বেতার তরঙ্গ নিয়ে। যার প্রয়োগ ঘটেছে আধুনিক টেলিভিশন এবং রাডার যোগাযোগের ক্ষেত্রে। আর মার্কনি আধুনিক ছোট বা শর্ট তরঙ্গ মাপের বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে দূরে বেতার সংকেত পাঠাতে সফল হয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতি হল রেডিও। জগদীশ চন্দ্র বসুর আশ্চর্য আবিষ্কার দেখে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেন, জগদীশ চন্দ্র বসুর প্রত্যেকটি আবিষ্কার বিজ্ঞান জগতে একটি বিজয়স্তম্ভ।
জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরে। ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। তার পৈতৃক বাসস্থান ছিল বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। বাবা ভগবান চন্দ্র বসু। তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।
এর আগে তিনি ১৮৫৩-৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন।
জগদীশ চন্দ্রের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর প্রাইমারী। এরপর ভর্তি হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে।
গ্রামের বাংলা স্কুলের পড়া শেষে ইংরেজী শিক্ষা অর্জনের জন্য তাঁকে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি করা হয়। জগদীশ বসু ১৬ বছর বয়সে ১৮৭৪ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে প্রবেশ করেন। এই কলেজ থেকে ১৮৭৮ সালে এফ এ এবং ১৮৮০ সালে বিজ্ঞান শাখায় বি এ পাশ করেন। তারপর ডাক্তারী পড়ার জন্য বিলেত যান। এক বছর ডাক্তারী পড়ার পর অধ্যাপকের পরামর্শে ডাক্তারী পড়াশুনা বাদ দেন।
১৮৮১ সালে তিনি লন্ডন ত্যাগ করে ক্যামব্রিজ যান। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। কিছু দিন পরে লন্ডন থেকে বি এস সি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৮৮৫ সালে দেশে ফিরে এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অস্থায়ী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। এ সময় একই পদে একজন ইংরেজ অধ্যাপক যে বেতন পেতেন ভারতীয়রা পেতেন তার চেয়ে তিন ভাগের দুই ভাগ।
তাছাড়া তিনি অস্থায়ী ভাবে চাকরী করছেন বলে তার বেতন কেটে নেয়া হয় বলে জানা যায়। এই রাগে তিনি আর বেতন গ্রহণ করেননি। দীর্ঘ তিন বছর বেতন না নিয়ে তিনি তার কর্তব্য পালন করেন। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার তার কাছে নতি স্বীকার করেন।
তাঁর গবেষণার সূত্রপাতও এখান থেকেই।
তাঁর মহান বৈজ্ঞানিক গবেষণাসমূহের সূতিকাগার এই কলেজেই। এখান থেকেই জগদীশ চন্দ্র ‘বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুতে’ রূপান্তরিত হন। ১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা অবলার বিবাহ হয়। তিনি ছিলেন একজন ডাক্তার। তিনি একজন সমাজকর্মী ছিলেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ চন্দ্র বসু যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর জন্য লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাঁকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে। তাঁর এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাকে ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এছাড়াও তিনি রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে বক্তৃতা দেন। বক্তৃতা শেষে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক দেশে ফিরে আসেন।
জগদীশ চন্দ্র বসু আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য বিষয় ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোনো তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানী হের্ৎস প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরী করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ।
আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।
ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্স’। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা পরীক্ষণগুলোর ওপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন। যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চেতনা চমকে দেয়।
এই বিষয়ের উপর সাময়িকী ‘টাইম্স-এ একটি রিপোর্টে বলা হয়, এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা। ১৮৯৬ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্য ইউরোপ যান। তার বক্তৃতার বিষয় বস্তু ছিল অদৃশ্য আলোক। তার পাণ্ডিত্য পূর্ণ বক্তৃতা শুনে বৈজ্ঞানিক অলিভার লজ , লর্ড কেলভিন বিলেতেই অধ্যাপনা করার জন্য তাকে আমন্ত্রন জানায়। কিন্তু দেশ ছেড়ে তিনি বিদেশে থাকতে চাননি।
তাই দেশে ফিরে আসেন।
১৮৯৮ সালের ১৯ জানুয়ারিতে তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস’ তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতার সফলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানী লর্ড রয়্যাল তাঁর বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে বলেছিলেন, ‘এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি- এ যেন মায়াজাল’। বিজ্ঞানী জেম্স ডিউয়ার পত্রিকায় লিখেছিলেন; ‘একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন- এ দৃশ্য অভিনব’।
এই বক্তৃতার পর তিনি ফ্রান্স এবং জার্মানিতে বক্তৃতা দেন। এ সময় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হয়ে যায় এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি Societe de Physeque-এর সদস্য মনোনীত হন।
জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণাকাল তিন পর্যায়ে বিভক্ত: প্রথম পর্যায় ১৮৯৫-৯৯ সাল, দ্বিতীয় পর্যায় : ১৯০০-১৯০২ সাল এবং তৃতীয় পর্যায় : ১৯০৩-৩২ সাল। তার পর্যায়ভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্র ছিল : বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ, জৈব ও অজৈব পদার্থের উত্তেজনার প্রতি সাড়া প্রদানের ক্ষমতা এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীর পেশির তুলনামূলক শারীরবৃত্ত। ১৯১৬ সালে তিনি অধ্যাপনার কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
তারপর দু’বছরের মধ্যে (১৯১৭ সালের ৩০ নভেম্বর) তিনি ‘জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞানমন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেই বিজ্ঞানমন্দিরে গবেষণা পরিচালনা করেন। বিজ্ঞান শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে জগদীশ চন্দ্রের সফলতার কথা সর্বজন স্বীকৃত। জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে।
জগদীশচন্দ্র বসু বেশ কিছু নবতর গবেষণা পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।
এগুলোর মধ্যে উদ্ভিদের বৃদ্ধি রেকর্ড করার জন্য ‘ক্রেস্কোগ্রাফ’ আবিষ্কার এবং অতি সীমিত মাত্রায় নড়াচড়াকে এক কোটি গুণ বিবর্ধন করে দেখানো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি ঘুম, বাতাস, খাদ্য ও ওষুধ প্রভৃতির প্রভাব প্রদর্শনের জন্য যন্ত্রপাতিও উদ্ভাবন করেন। ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর জগদীশচন্দ্র বসু গিরিডিতে মারা যান।
জগদীশচন্দ্র বসুই প্রথম ভারতীয় যিনি ১৯০২ সালে রয়াল সোসাইটির সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯১৫ সালে ভারত সরকার তাকে নাইট উপাধি দেন।
১৯২০ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সালে নির্বাচিত হন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি। ১৯২৮ সালে ভিয়েনার এক একাডেমি অব সাইন্সের বৈদেশিক সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৫ সালে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি এস সি ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।