আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রো লো গ লেখক : আহমদ মিনহাজ

_________________সেলাই গাছের কারখানা _______________________________________

প্রো লো গ লেখক : আহমদ মিনহাজ ১ম কিস্তির পর Click This Link প্রিয় ফ্রাউলিন, সুদূর পূর্ব বাংলা থেকে গেরহার্ড তোমায় এই সংকেত বার্তা পাঠাচ্ছে,-শোফেনস্খিল হইতে সাবধান! এই পুরুষাঙ্গ জীবনে কোনো নারীর জন্য উত্থিত হয় নাই। তুমি কি জানো, সে কীসে উত্থিত হয়? শোফেনস্খিল উত্থিত হয় বুখেনওয়াল্ডে। নিউজ চেম্বারে বসে তার টেকো মাথা সে উত্থিত করে পূর্ব বাংলায়। প্রিয়তমা ফ্রাউলিন, আমি তোমায় এই বলে সম্বোধন করি,-উত্থিত হওয়া এক দারুণ ব্যাপার; তোমায় ভেবে গেরহার্ড অহরহ উত্থিত হয় এবং শুধু তোমার কারণে সে-উত্থানের রঙ একান্তই গণতান্ত্রিক। সংকেতটি আবার পাঠালাম।

শোফেনস্খিলের পুরুষাঙ্গের রঙ মনে করার চেষ্টা করো। ওভার ...! ... অনেক হলো ফ্রাউলিন। গেরহার্ডের এখন ঘুম পাচ্ছে। এই ছোট শহরে আজ রাতে বিমান হামলা হওয়ার কথা ছিল। হয়নি।

ঈশ্বর আরেকটি রাত আমায় করুণা করলেন। মোজেসকে ধন্যবাদ। তূর পাহাড়ের জ্যোতি এখনো তোমার দিকে মুখ করে রেখেছে আমায়। তোমার সঙ্গে কথা বলছি ফ্রাউলিন। এলোমেলো পারম্পর্যহীন অসংলগ্ন কথামালা! তুমি কি ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছো? আমার কানের পাশ দিয়ে বৃহৎ এক নদী প্রবাহিত হচ্ছে এখন।

রাত যতো গভীর হয়, পূর্ব বাংলার নদীরা রজস্বলা হতে থাকে। রজস্বলা একটি পুরুষত্ব প্রতিরোধী শব্দ। স্ত্রী লিঙ্গবাচক। রজস্বলা দিয়ে তুমি প্রতিরোধ করো অবৈধ অনুপ্রবেশ। ফ্রাউলিন, তুমি কি রজস্বলা এখন? তোমার ছোট বোনের খবর কী বলো।

তার বান্ধবী মার্গারিটের খবর কী? সে কি রজস্বলা? লিপজিগ থেকে তার সংবাদ যদি পাও,-জানিও। মার্গারিট কি বিয়ে করেছে? সুদর্শন পুরুষটির নাম পাঠিও। আমি তাকে অভিনন্দিত করবো। এই দেশে বিয়ে এক পবিত্র অঙ্গীকার, এক সম্পর্ক প্রতিরোধক দেয়াল। পরকীয়াকে এটি প্রতিরোধ করে এবং সন্তানের দিকে দুটি মানুষকে জাগ্রত রাখে।

শহরে আসার পর দুটি নব-বিবাহিত মেয়েকে আমি দেখেছি। প্রথমটি বাংলার মাটির মতো শ্যামল। দ্বিতীয়টি চকোলেট রঙের। অবিকল মার্গারিটের মতো। আমি তাকে লিপজিগ শহরের গল্প করেছি।

ভাঙা বাঙলায়। তার স্বামী আমায় জানালো জার্মানিকে সে কল্পনা করতে পারে এবং ভাইমারের চেয়ে বুখেনওয়াল্ড সম্পর্কে অধিক ধারণা রাখে। আমি তাকে জার্মানিতে নিমন্ত্রণ করবো ভেবেছি। কিন্তু যুদ্ধ লাগার ভয়ে নব দম্পতি শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। কী মনে হয় তোমার? গ্রামে যাবার পথে চকোলেট রঙের মেয়েটি কি নিজেকে বাঁচাতে পারবে? পূর্ব বাংলার ছোট এই শহরে আঠাশজন রাজাকার রয়েছে।

আমি গুনে দেখেছি। রাজাকার একটি মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধী ও পাক সেনা সহযোগী শব্দ। এটি কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনী নয়। স্থানীয় বাঙালিদের মধ্য থেকে এর উদ্ভব হয়েছে। রাজাকাররা পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপযোগিতায় বিশ্বাস করে।

মুক্তিবাহিনী খতম করার মিশনে পাক সেনার চর হিসাবে তারা কাজ করে এখানে। শহরে ঢোকার পর তিনজন রাজাকারের সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তারা আমায় পাকিস্তানের মাহাত্ম্য বুঝিয়ে বলেছে। রাজাকারদের একজন নিজেকে আল্লার পথের ফকির দাবি করলো। পাকিস্তানকে স্বপ্নে পাওয়া নিয়ামত উল্লেখ করে সে আমায় জানালো প্রেরিত পুরুষ মোহাম্মদের ইসলাম পাকিস্তানের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে রক্ষিত হচ্ছে।

সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, যাতে হিন্দু-ইহুদি ও খ্রিস্টান চক্র পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে বিপন্ন না করে। আরেকজন জানালো সে পাকিস্তানের প্রতি বিশ্বস্ত এবং এই বিশ্বাস মক্কা ও সৌদি আরাবিয়া থেকে আসে। সৌদি আরবের ওহাবি আন্দোলনের প্রবাহটি পাকিস্তানে শক্তিশালী, এবং রাজাকাররা অনেকে জামায়েতে ইসলামী’র সক্রিয় সদস্য। দলটির জনক মওদুদীকে আল্লামা উপাধিতে সম্মানিত করা হয়। আল্লামা একটি জ্ঞানবাচক বিশেষ্য, যার অর্থ হলো এই ব্যক্তি ইসলামে সুশিক্ষিত এবং ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে গভীর ধারণা রাখেন।

মওদুদীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তথ্য অস্পষ্ট। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে শুরুতে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির বিরোধিতাকারী ছিলেন। ভারত ভাগ হওয়ার পর মওদুদী তাঁর মত পাল্টে পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবশালী সংগঠক হিসাবে মওদুদী নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারেননি। টিক্কা খানের জায়গায় জেনারেল নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর মওদুদী-পন্থি সংগঠনগুলো আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

টিক্কা খান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। তিনি একজন জেনারেল। পূর্ব পাকিস্তানের বিশৃঙ্খলা দমনের দায়িত্বটি তাকে দেয়া হয়। কিন্তু ২৫ মার্চের গণহত্যার কারণে নিন্দিত হওয়ায় শাসকগোষ্ঠী তাকে সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর টিক্কাকে বাঙালিরা কসাই নাম দিয়েছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা-মৌচাক উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণ-কে ঘিরে আবর্তিত হয়। উচ্চাকাক্সক্ষা হলো আপেক্ষিক বিবৃতি। পাকিস্তানে এটি গণতন্ত্র-প্রতিরোধী ও স্বৈরাচার-সহযোগী শব্দ। জেনারেল টিক্কা বা রাও ফরমান আলী এর প্রতিনিধি। টিক্কার জায়গায় জেনারেল নিয়াজি যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বটি নিয়েছেন।

রণাঙ্গনে বীরত্বের কারণে তাকে টাইগার নিয়াজি উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। টাইগার নিয়াজি পশ্চিম পাকিস্তানের যোদ্ধা উপজাতি নিয়াজির বংশধর। নিয়াজিরা পাঠান গোত্রের অংশ। ভারতীয় উপমহাদেশে সাহসিকতা বা বীরত্ব হলো পাঠান ও রাজপুতের অলংকার। নিয়াজি নিজেকে সাহসী পাঠান মনে করেন এবং তাঁর বীরত্বকে সাড়ম্বরে ঘোষণা দিতে ভালোবাসেন।

উপত্যকা আচ্ছাদিত পাকিস্তানে উপজাতিরা বীরত্ব জাহির করতে পছন্দ করে। নিয়াজিকে আমার তাই মনে হলো। ঢাকা ত্যাগ করার আগে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কে আমি তাঁকে প্রশ্ন করি। তিনি মন্তব্য করেন,-‘পাকিস্তানী সেনারা পরাজিত হওয়ার জন্য লড়াই করে না। আর সেটা যদি ভারত রাষ্ট্রের বিপক্ষে হয়, তবে আপনি নিশ্চিত থাকুন,-আমরাই জয়ী হবো।

আমাদের রয়েছে দক্ষ পদাতিক ও বিমানবাহিনী। রয়েছে রাজাকার ও আল-বদর স্কোয়াড। এরা সবাই ইসলাম ধর্মের ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়বে। জয় আমাদের হবেই। ’ প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ড তোমায় অনুরোধ করছে লিপজিগের মার্গারিটকে এই সংবাদটি যেন পৌঁছে দেওয়া হয়,-আমি এখন ভারতের নিকটবর্তী একটি দেশে রয়েছি।

দেশটি পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী ও অনুচর শক্তিরা ঘেরাও করে রেখেছে। অধিবাসী বাঙালিরা স্বাধীনতা লাভ করার জন্য শক্তিশালী শত্রুর বিপক্ষে লড়াই করছে। এই দেশের সদ্য বিবাহিত একটি মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। তার গায়ের রঙ চকোলেটের মতো। সে যখন হাসে তাকে মার্গারিটের যমজ বোন বলে মনে হয়।

সেই মেয়েটি তার স্বামীর হাত ধরে গ্রামের পথে রওয়ানা দিয়েছিল। মেয়েটির পেছনে জেনারেল নিয়াজি তার প্রশিক্ষিত সেনা ও অনুগত রাজাকার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে। গেরহার্ডের ধারণা মেয়েটির স্বামী তাকে বাঁচাতে পারবে না। গ্রামে পৌঁছবার আগেই রাজাকাররা তাকে ধরে ফেলবে ও সেনা ক্যাম্পে নিয়ে তুলবে। ঠিক যেভাবে মার্গারিট নামের মেয়েটির মা’কে নাজিবাহিনী ভাইমার থেকে বুখেনওয়াল্ডে তুলে নিয়েছিল।

ওখানে তার মা একটি মেয়ের জন্ম সম্ভব করেন। মেয়েটির পিতার নাম অনিশ্চিত। তার গায়ের রঙ ছিল চকোলেটের মতো এবং তার নাম রাখা হয় মার্গারিট। সে এখন লিপজিগে বসবাস করে। প্রিয় মার্গারিট, ফ্রাউলিনের মাধ্যমে গেরহার্ড তোমায় এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে,-চকোলেট রঙের মেয়েটি তোমার যমজ বোন।

যদি পারো জেসাসের কাছে তার জন্যে প্রার্থনা করো। তোমার মতো নববিবাহের সুখে মেয়েটি যেন অভিনন্দিত হতে পারে। তোমার সুদর্শন স্বামীটিকে বলো,-গেরহার্ড বলেছে অভিনন্দন একটি আন্তর-মৌলিক উচ্চারণ, যেটি মানুষকে জীবনের দিকে আলোকিত করে। প্রিয় মার্গারিট, তোমায় অভিনন্দিত করে ফ্রাউলিনকে আলোকিত করেছি আমি। ওকে এই বাক্যটি বলা প্রয়োজন,-অন্ধকার কক্ষে বসে গেরহার্ড আলোকিত শব্দটিকে চুইংগামের মতো নিজের জিভে জড়িত করেছে।

তুমি কি এতে সন্তুষ্ট হবে,-প্রিয়তমার স্কার্টের রঙ ও রজস্বলা ত্রিভূজে সিক্ত অন্তর্বাস মনে করার চেয়ে আলোকিত-কে জিহ্বায় জড়িত করা গেরহার্ডের জন্য অনেক কঠিন ছিল? অন্তর্বাস এক সংগোপন যৌনতা, যা গেরহার্ড ও ফ্রাউলিনের মধ্যে চুপিসারে চলাফেরা করে। কিন্তু এখানে তা নয়। যুদ্ধ স্কার্ট ও অন্তর্বাসের ফারাক বোঝে না। যুদ্ধ হলো হতচ্ছাড়া স্ববিরোধ; ফাঁপা বুলি ও জাঁকালো মিথ্যের এক কদাকার প্রহসন। শোফেনস্খিলের টেকো মাথা ও ঘিনঘিনে বিছার মতো পুরুষাঙ্গ গেরহার্ডের মগজে গিয়ে ঢুকেছে এবং তাকে দিয়ে সাংবাদিক প্রতিবেদন উৎপাদন করাচ্ছে br /> ‘পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি ক্রমশ গোলযোগপূর্ণ হয়ে উঠছে।

গতকাল এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত বলেছেন পূর্ব পাকিস্তানের গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির দায়-দায়িত্ব শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে বহন করতে হবে। এই ঝটিকা সফরে প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত ঢাকা শহর ঘুরে যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করেন। রাজধানী সম্পূর্ণরূপে সেনা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেখে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করে বলেন,-‘পরিস্থিতি ক্রমে স্বভাবিক হয়ে উঠছে। লোকজন তাদের বাড়ি-ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। সরকারি অফিস-আদালতে কর্মী উপস্থিতির হার সন্তোষজনক।

এটা প্রমাণ করে পূর্ব পাকিস্তান শান্ত হয়ে আসছে। ’ আওয়ামী লীগের কর্মীদের নাশকতা সৃষ্টিকারী উল্লেখ করে বিশেষ দূত তাঁর বিবৃতিতে আরো বলেন,-‘নাশকতা সৃষ্টিকারী ও পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ মুক্তিবাহিনীকে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ’ জেনারেল নিয়াজিকে এ-ব্যাপারে তিনি জিরো টলারেন্স অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করেন। প্রিয় ফ্রাউলিন, শোফেনস্খিলকে জিজ্ঞেস করো,-সরকারি বিবৃতি ও সাংবাদিক প্রতিবেদনের মধ্যে পার্থক্য কী? ফিরতি বার্তায় উত্তরটি জানিও। আমি অপেক্ষা করছি।

আমার পক্ষ থেকে ওকে বলো,-গেরহার্ড বলেছে সরকারি বিবৃতি সচিবরা মুসাবিদা করে, আর অন্যটি করে সংবাদকর্মীর পুরুষাঙ্গ। প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূতের বিবৃতি এভাবে সত্য হতে পারে, গেরহার্ড যদি এটি বিশ্বাস করে যে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা আত্মগোপন করেছে। গেরহার্ড,-ফ্রাউলিনের মাধ্যমে বিশেষ দূতকে চটজলদি জানাও,-ঢাকার জনসংখ্যা নিজেকে স্থানান্তর করেছে গ্রামে ও সীমান্তে। স্থানান্তর একটি জৈবিক প্রয়োজন। জঠরের ক্ষুধা মানুষকে স্থানান্তর করে; মৃত্যুর আতংক পারে তাকে স্থানান্তর করে দিতে।

বাঙালিরা মৃত্যুর মৌলিক প্রয়োজনে স্থানান্তরিত। তাদের এই স্থানান্তরের নাম হোক,-পলায়ন। গেরহার্ড, বিশেষ দূতের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে এই বার্তাটি পাঠিও,-পূর্ব বাংলার শ্যামল মাটিতে সবুজ রঙের দুর্বা ও মুথা ঘাস ফলে। ঘাসগুলো এরিমধ্যে বাদামি হতে শুরু করেছে। বাদামি ঘাসের নিচে একটি জনসংখ্যা আত্মগোপন করে আছে; তার নাম-বাঙালি।

মাননীয় প্রেসিডেন্টের জানা প্রয়োজন, বাঙালি জনসংখ্যা এখন ঘাসের সঙ্গে মিশে বাদামি হয়ে উঠেছে। ঘাসের শরীরে তারা পলায়ন ও আত্মগোপন করেছে। বাদামি ঘাস অচিরেই ধূসরবর্ণ হবে। ধূসরবর্ণ সেই ঘাসে মুক্তিরা ওত পেতে রয়েছে। খোলস ছেড়ে তারা যেদিন বের হবে, প্রেসিডেন্ট এই কথাটি যেন স্মরণ করেন,-‘পলায়ন ও আত্মগোপন কখনো অনন্ত হয় না! অনন্ত এক আপেক্ষিক ধারণা এবং সময় হলে তা পাল্টাবে’।

বিশেষ দূতের মাধ্যমে গেরহার্ড মাননীয় প্রেসিডেন্টের কাছে এই সতর্ক সংকেত পৌঁছাচ্ছে,-আপনার জেনারেলদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হতে মানা করুন। তাদের আত্মবিশ্বাস যাচাই করার জন্য সে তেরোটি শহর ও এগারোটি গ্রাম ঘুরেছে। রজঃস্বলা নদী ও পাইনবনের মতো ঘন বসতি পেরিয়ে এসেছে। সবখানে একটি দৃশ্যই চোখে পড়েছে তার,-মুক্তিসেনার গেরিলা পোশাকে বাদামি ঘাসের মতো বাঙালিরা আত্মগোপন করে আছে। ঘাস যেদিন ধূসরবর্ণ হবে,-আপনার সেনারা যেন একটি মরণপণ বিষকামড়ের জন্য প্রস্তুত থাকে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, প্রেসিডেন্ট কিংবা শোফেনস্খিলের জন্যে নয়, এই সংবাদটি কেবল তোমার জন্য গচ্ছিত যে পূর্ব বাংলার নদীরা এখন গর্ভবতী। নদীগুলো অতিক্রম করার কালে টাইগার নিয়াজির সেনাদের পরিশ্রান্ত মনে হলো। অথচ ঘাস ও নদীর তীরে গোপনে ওত পেতে থাকা মুক্তিদের উজ্জীবিত দেখলাম। এটি কীসের ইঙ্গিত বলে মনে হয় তোমার? নিয়াজির সেনারা ক্লান্ত। তাদের ইউনিফর্মে বাসি দুধের গন্ধ; পায়ের ক্ষতে এরিমধ্যে পচন ধরেছে; মুক্তি ও ভারতীয় সেনা-আক্রমণ প্রতিহত করার ক্লান্তি তাদের চোখে-মুখে।

চোখের গর্তে প্রশ্নচিহ্ন। তারা যেন কিছু বলে উঠতে চাইছে। কিন্তু জেনারেলের চোখ-রাঙানির ভয়ে চুপ করে রয়েছে। জেনারেলের প্যারা মিলিশিয়া বাহিনীর অত্যাচার দেখে মনে হচ্ছে গেস্টাপোরা কবর থেকে পূর্ব বাংলায় উঠে এসেছে। ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মহড়ায় তারা ভুলে গেছে স্থানীয় জনসংখ্যার সদয় মনোভাব ছাড়া কোনো যুদ্ধ জেতা যায় না।

এসব কীসের ইঙ্গিত বহন করে ফ্রাউলিন? কে জিতবে বলে মনে হয় তোমার? টাইগার নিয়াজি কি পারবে নিজের সুনাম ধরে রাখতে? নাকি অপেশাদার মুক্তিরা নিশ্চিত করবে বিজয়? যে জিতুক, এই সংবাদ শুধু তোমার জন্য পাঠালাম,-ভাইমারের কথা ভেবে গেরহার্ডের মনোবলের পারদ খালি নিচের দিকে নামছে। শোফেনস্খিলকে জানিয়ে দিও,-দেশে ফেরার এই ছেলেমানুষী আকুলতার জন্য সে সত্যিই লজ্জিত। তাকে বলো,-গেরহার্ড এক জঘন্য ইহুদি; যার পিতৃপুরুষ ভাইমারের ছোট্ট কুটিরে এক বেজন্মা ইহুদিকে প্রসব করবে বলে জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত হয়। প্রিয় শোফেনস্খিল,-ছেলেমানুষীর জন্য আমি লজ্জিত। মাঝেমধ্যে গেরহার্ড ভুলে যায় বাংলার মেঠো ঘাসের মতো বাদামি হতে পারলেও ইহুদির স্বীকৃত কোনো মাতৃভূমি নেই; সর্বজনস্বীকৃত কোনো মাটি নেই।

মাঝেমধ্যে সে ভুলে যায় ইহুদি এক স্থানান্তরিত ঘাস। জেরুজালেমের শক্ত মাটিতে তার পত্তন হয়েছে। কিন্তু তার স্থানান্তর ঘটেছে ভাইমারে। তারপর সে স্থানান্তরিত হবে বুখেনওয়াল্ড, আউশভিৎসে,-ইহুদির আত্মাচেরা সব মৃত্যুকূপে। ফ্রাউলিন, যদি পারো শোফেনস্খিলকে অবগত করো,-গেরহার্ড এক সাচ্চা ইহুদি।

পূর্ব বাংলার মৃত্যুকূপে বসে রাগী পশুর মতো গর্জন ছাড়ছে সে। এই গর্জনের নাম দিতে পারো,-উদ্বাস্তু! ফ্রাউলিন, পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুর হয়ে গেরহার্ড এই সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছে,-শব্দটিকে তুমি মোলায়েমভাবে চুম্বন করো। কেননা উদ্বাস্তু এক বিপজ্জনক পশু; এক জন্মভূখা হাভাতে। হাভাতেকে চুম্বনের ক্ষণে তোমার ওষ্ঠে ঝরে পড়–ক করুণাধারা। বিব্রত ঠোঁট ফাক করে উদ্বাস্তুকে চুম্বন দিও না।

উদ্বাস্তুর জন্য চুম্বন হলো এক বিপজ্জনক সহানুভূতি। সে এতে লজ্জিত হয়, অতঃপর সহানুভূতির জ্বালায় খেপে ওঠে। তাকে জেসাসের মতো ভালোবাসা দিও। তার ওষ্ঠ দিয়ে মোজেসকে চুমু খেতে দিও। মোজেস তূর পাহাড়ে ঈশ্বরের দ্যুতিতে দীর্ঘায়ু পায়।

আর, ইহুদিরা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘায়ু উদ্বাস্তু! মরিয়ম পুত্র ঈসা ও আব্দুল্লার পুত্র মোহাম্মদকে বলি,-ইহুদি গেরহার্ড এক বেজন্মা উদ্বাস্তু। সে এখন সুদূর পূর্ব বাংলার বাদামি ঘাসে একটি জনসংখ্যার পলায়ন ও স্থানান্তরের প্রতিবেদন লিখছে। জনসংখ্যার নাম বাঙালি। জনসংখ্যাটিকে তার প্রতিবেশীর ঘাসে আত্মগোপন করতে বাধ্য করা হয়। নিজ বসতি থেকে তাকে উৎখাত করা হয়েছে।

সারা বিশ্বের চুম্বন ও সহানুভূতি সত্ত্বেও উদ্বাস্তু হওয়ার এই যন্ত্রণা সে আর সইতে পারছে না। দীর্ঘকাল ঈশ্বরের দ্যুতি কামনা করেছে সে; ততোধিক দীর্ঘকাল বসতি-উৎখাতের উৎকণ্ঠা সয়েছে। এটি জেনে রাখা প্রয়োজন,-ধৈর্য এক অ-নির্ভরযোগ্য বিশেষণ। পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা তাদের ধৈর্য্যরে শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। এখন তারা মর্মান্তিক গর্জন ছাড়ার জন্যে আহত পশুর মতো ধুঁকছে।

প্রিয় ফ্রাউলিন, মরিয়ম পুত্র ঈসা ও আব্দুল্লার পুত্র মোহাম্মদের নিকটে গেরহার্ডের এই আবেদনটি যেন পৌঁছায়,-বাঙালি জনসংখ্যার গর্জনটিকে উদ্বাস্তুর ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ নামে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। ফ্রাউলিন ও ভাইমারের শরীরে গেরহার্ডের চুম্বন যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, হামেলের সুর বাজানোর কালে জেরুজালেমকে স্মরণ করে বৃদ্ধ ইহুদির আর্দ্র চোখ যদি ন্যায়সঙ্গত স্বীকার করা হয়,-ন্যায়সঙ্গতার সেই আবেগ মিশিয়ে গেরহার্ড দাবি করে,-পূর্ব বাংলার জনসংখ্যাকে তাদের মাটি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। কেননা ঈশ্বর এক মহান সুবিচারক, আর প্রেরিত পুরুষরা হলেন তার জ্যোতি। ওভার! ... প্রিয়তমা ফ্রাউলিন, ন্যায়সঙ্গত এই আবেদনের পর কিছু কি বলার থাকে গেরহার্ডের! হোটেলের অন্ধকার কক্ষটি এরিমধ্যে আলোকিত হতে শুরু করেছে। একটু পরে ভোরের আলো ফুটবে।

মোজেস একটি রাতের জন্য করুণা করেছে আমায়। তুমি কি আরেকটি দিবালোক ভিক্ষা চাইবে তার কাছে? ভোর পেরিয়ে সকাল হবে একটু পর, সেই পরটুকু বেঁচে থাকার প্রার্থনা করো ফ্রাউলিন। এই অনুভূতিটি শুধু তোমার জন্য গচ্ছিত যে গেরহার্ড ছিল এক সাচ্চা ইহুদি। সে তার ফ্রাউলিনকে চুম্বন করেছে। মৃদু ভোরে প্রাণপণে ফ্রাউলিনের স্কার্টের রঙ মনে করার চেষ্টা করেছে।

ফ্রাউলিনের স্কার্টের নিচে একটি ত্রিভূজ শুয়ে থাকে। প্রিয় ফ্রাউলিন, অ্যাপোলিনেখের কাছে গেরহার্ডের হয়ে এই বার্তাটি পৌঁছে যাক,-বিশুদ্ধ ত্রিভূজ এক নারীবাচক জন্মভূমি, আর জন্মভূমি একটি সংগোপন যৌন-অস্তিত্ব। গেরহার্ডের জন্মভূমি ভাইমার সেই অস্তিত্ববাহক যৌন-প্রিয়তা। ফ্রাউলিনের হয়ে ভাইমারের সবাই এটি জেনে যাক,-যৌন-প্রিয়তা এক সংবেদনশীল অম্লজান, পৃথিবীকে যেটি জীবনের দিকে পরিশ্রুত করে। প্রিয়তমা ফ্রাউলিন, তুমি উজ্জ্বল হবে জেনে,-বিগত দিনগুলোয় গেরহার্ড কিছু ওয়াদা করে।

ওয়াদা সম্ভবত একটি আরবিউচ্চারণ। অঙ্গীকারবাচক শপথ। আর আমরা অঙ্গীকার করি তা না-রাখার জন্য। ওয়াদা-কে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়,-‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’। গেরহার্ড এই সংবাদটি ফ্রাউলিনের কাছে পৌঁছাতে চাইবে যে, ওয়াদা শব্দের চাপ সে নিতে পারছে না! এটি তাকে ভীত করে তোলেছে।

ওয়াদা-র পরিবর্তে ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ বাক্যটি বেছে নিতে ইচ্ছুক সে। ওয়াদার সমার্থক হলেও ‘আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম’ সম্ভবত কম ভীতিকর। এর ভিতরে সেই আশা জেগে রয়,-প্রতিশ্রুতি কোনো একদিন পালিত হবে। প্রিয় ফ্রাউলিন, নিচের প্রতিশ্রুতিগুলো গেরহার্ডের পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা জানিও। তোমার সোনালি চুল ও নীল চোখের কথা ভেবে গেরহার্ড তার প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করেছে ... ___________________________________চলবে


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.