_________________সেলাই গাছের কারখানা _______________________________________
প্রো লো গ
লেখক : আহমদ মিনহাজ
১৯৭১-এ পোড়া মাটি নীতি গ্রহণ করার সময় জেনারেল টিক্কা খান তাঁর সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন,-‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়’। আর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন,-‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি রক্ত দিয়ে লাল করে দেয়া হবে’। জেনারেলদের সংকল্পটি সফল হবার দিনগুলোয় সুদূর ইউরোপ মহাদেশের জনৈক সংবাদকর্মী চরকির মতো সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশীদের চলাচলের ওপর সরকারি নজরদারী ও বিধিনিষেধ থাকলেও সংবাদকর্মীর মনের জোর ছিল অজেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি রণাঙ্গনে ঘুরে বেড়াতেন।
যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন পাঠাতেন। পরিস্থিতি দিন-দিন জটিল ও সংঘাতমুখর হয়ে উঠছিল। প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে সারা বিশ্ব জেনে গিয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলে একটি ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা বা গৃহযুদ্ধ দমনের নাম করে পাক সেনারা নিরীহ মানুষ হত্যা করছে সেখানে। পাকিস্তানের প্রতি বৈরী ও পূর্বাঞ্চলের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় অনেকে ধারণা করছিলেন আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ বোধহয় আসন্ন হতে যাচ্ছে।
অন্যদিকে পাকিস্তানী শাসকচক্র ভারতকে পূর্বাঞ্চলে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে পাকিস্তানের সীমানালগ্ন ভারতীয় এলাকাগুলো অরক্ষিত করার ফন্দি আঁটছিলো। সংকটপূর্ণ সেই পরিবেশের মধ্যে বিদেশী এই সাংবাদিক রক্তক্ষয়ী একাত্তরকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার দায়িত্বটি পালন করছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি তার মনকে গভীরভাবে বিচলিত করে তোলে। পেশাগত দায়িত্বের বাইরে এক গভীর ও ব্যক্তিগত অনুভব লিখে ওঠার তাগিদ বোধ করেন তিনি। রক্তঝরা রণাঙ্গন ঘুরতে-ঘুরতে সংবাদকর্মী ছোট এক শহরে হাজির হন।
টিক্কার সংকল্প মোতাবেক শহরটি তখনো রক্তে লাল হয়ে ওঠেনি। নদী বেষ্টিত এই শহরটি সংবাদকর্মীর ভালো লেগে গেলো। খবর সংগ্রহের তাগিদে একের-পর-এক রণাঙ্গনে ঘুরতে হয় তাকে। তিনি দেখেছেন যুদ্ধ কীভাবে মানুষকে মূল্যহীন করে তোলে; সন্দেহ-অবিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে গতিশীল হয় সেখানে; আর হত্যা-ধর্ষণ ও সেনা ক্যাম্পে নির্মম অত্যাচারের বলি হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিরীহ মানুষ কীভাবে রাতের অন্ধকারে অজানার উদ্দেশে পলায়ন করে।
হত্যা ও পলায়নের এইসব দৃশ্য তাকে ক্লান্ত করে থাকবে হয়তো-বা।
হতে পারে, খবর সংগ্রহের যান্ত্রিক চাপটি তিনি আর নিতে পারছিলেন না। কারণ যাই হোক, সংবাদকর্মীর মনে হলো শহরটি মন্দ নয়। যুদ্ধের লেলিহান শিখা থেকে সে এখনো বেশ দূরে অবস্থান করছে। মানুষ উদ্বিগ্ন হলেও পলায়নের জন্য ব্যতিব্যস্ত নয় এখানে। পাকিস্তানী সেনা ও মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি তখনো সীমিত ছিল সেখানে।
সংবাদকর্মী দেখলেন পাক সেনাদের ছোটখাটো প্লাটুন ও সহযোগী রাজাকার বাহিনীরা শহর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর কোনো তৎপরতা চোখে পড়লো না তার। শহরকে বেষ্টনকারী নদীর আশপাশে মুক্তিবাহিনীর এক গোপন মৌচাকের খবর পেলেন তিনি; তবে হামলা চালাবার জন্য তাদেরকে খুব একাগ্র মনে হলো না। মুক্তিরা সম্ভবত নাটকীয় কোনো মুহূর্তের জন্য অটল হয়ে প্রতিক্ষা করছিল।
সংবাদকর্মী টহলদার সেনাবাহিনীর সাথে দেখা করলেন এবং শহরের একমাত্র হোটেলে গিয়ে উঠলেন।
স্থানীয় লোকজনের অনেকের সঙ্গে তার খাতির জমে গেলো। ভিনদেশী এই সাংবাদিকের কাছে সবাই রণাঙ্গনের খবর শুনতে চাইতেন। মাঝেমধ্যে পাকিস্তানী সেনাক্যাম্পে তার ডাক পড়তো। সেনা ক্যাম্পের কমান্ডার বিদেশীকে কৌশলে জেরা করতেন। বিদেশী আসলে কী ধরনের খবর পাঠান সে-বিষয়ে অবগত থাকা ছিল কৌশলের মূল লক্ষ্য।
যুদ্ধকালে প্রেস সেন্সরের অভিজ্ঞতা কোনো লেখক বা সংবাদকর্মীর জন্য নতুন কিছু নয়। সংবাদকর্মী এতে অভ্যস্ত ছিলেন বিধায় পাক কমান্ডারকে সামাল দেয়া তার পক্ষে কঠিন মনে হলো না। দায়িত্ব পালনের সেই দিনগুলোয় সংবাদকর্মী অনুভব করলেন নিজের অভিজ্ঞতা বয়ান করার মতো অবসর তার হয়েছে। হোটেলের প্রায়ান্ধকার একটি কক্ষে বসে সেই বিবরণ তিনি লিখতে বসে গেলেন ...
...
‘আমি রিচার্ড। রিচার্ড গেরহার্ড কোনেল।
জার্মানির নাগরিক। ভাইমার নগরে আমার জন্ম,-এক ইহুদি পরিবারে। পেশায় আমি একজন সাংবাদিক। ভাইমার থেকে অনেক দূরে ভারতের নিকটবর্তী একটি শহরে বসে লিখছি। ভারতের নিকটবর্তী হলেও ছোট এই শহরটি পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্গত।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এই শহরের দূরত্ব প্রায় তিন হাজার মাইল, হতে পারে আরো বেশি! পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠীরা বসবাস করে। বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলটি পূর্ব বাংলা নামে অধিক পরিচিত। বাঙালিদের আরো একটি ভূখণ্ড রয়েছে। এই ভূখণ্ডটিকে পশ্চিম বাংলা নামে অভিহিত করা হয়। পশ্চিম বাংলা এখন ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত।
সে যাই হোক, আমার লেখার বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতি। এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করার জন্য আমায় এখানে পাঠানো হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া আমার কাছে নতুন কোনো ঘটনা নয়। এর আগেও এলাকাটি আমি সফর করেছি। দক্ষিণ এশিয়ায় কাজের অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ আমার উপর আস্থা রেখেছে।
আস্থার প্রতিদান আমি দিতে পারবো কিনা সেটি এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অতীতের সফরগুলোর তুলনায় এবারের সফরটি অনেক কঠিন। পরিবেশের কারণে অন্যবারের চেয়ে আলাদা। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে। বিগত ছয় মাস মাস ধরে এই যুদ্ধ-উপকূলটি আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি।
আজ নিয়ে দশ দিন হলো ছোট্ট এই শহরে এসে উঠেছি আমি। টেবিলে একটি মোমবাতি আলো দিচ্ছে এখন। সন্ধ্যার পর সব বাতি এখানে নিভে যায়। যুদ্ধের ভাষায় একে ব্ল্যাকআউট বলা হয়। ব্ল্যাাকআউট শুরু হলে লোকজন ঘরে ঢুকে পড়ে।
পরস্পরের সঙ্গে তারা ফিসফিস করে কথা বলে। অনেকে নিচু স্বরে ‘বিবিসি’ বা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ শুনে। এটি একটি রেডিও স্টেশন। স্টেশনটি মুক্তিবাহিনীর খবর প্রচার করে থাকে। এই মুহূর্তে মুক্তিবাহিনী বাঙালি জনগোষ্ঠীর একমাত্র আশা-ভরসা।
পাকিস্তানের দক্ষ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিরা প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। ‘স্বাধীন বাংলা বেতার’ থেকে চরমপত্র নামে একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি বেশ জনপ্রিয়। এটি প্রচারিত হওয়ার সময় বাঙালিদের চোখ-মুখ অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে দেখেছি আমি। তারা বিশ্বাস করে ৭ মার্চের জনসভায় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে হুঁশিয়ার করে শেখ মুজিব যে চরমপত্রটি ঘোষণা করেছিলেন সেটি ব্যর্থ হতে পারে না।
পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে মুজিবকে এরিমধ্যে গ্রেফতার করেছে। তিনি এখন কোথায় রয়েছেন সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তাঁর পরিবারের লোকজনকে ঢাকার একটি ছোট বাড়িতে আটক করে রাখা হয়েছে। সম্ভবত তাদেরকে হত্যা করা হবে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কোলকাতায় অবস্থান করছেন।
কুষ্টিয়ায় গঠিত মুজিবনগর সরকার কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় রয়েছেন, তবে সার্বিক যুদ্ধ-পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হয়। দৃশ্যপটে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি বাঙালির যুদ্ধ জয়ের মনোবলকে খানিক দিকভ্রান্ত করলেও মুক্তিবাহিনী মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। ভারতে প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী সংখ্যায় লাখের কোটা অতিক্রম করেছে। একটি শক্তিশালী ও পেশাদার সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অপেশাদার মুক্তিবাহিনীর এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এখন সেপ্টেম্বর মাস।
টেবিলে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে আমি লিখছি। কিছুক্ষণ আগে হোটেল বয় বলে গেলো আজ রাতে শেলিং হতে পারে। বিমান হামলাকে বাঙালিরা শেলিং বলে। এই শহরে এখনো বড়ো ধরনের কোনো বিমান হামলা হয়নি। হয়তো আজ হবে।
লোকজন খাটের নিচে ঢুকে বিমান হামলা থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে। আমি ঠিক কী করবো জানি না। মৃত্যুর দেবতা এখনো আমায় করুণা করছেন। তার এই করুণা আর কত দিন বজায় থাকবে কে জানে! হতে পারে, আজকের রাত আমার জীবনের শেষ রাত হবে! রণাঙ্গনে সব কিছু অনিশ্চিত। যেহেতু আমি একজন সংবাদকর্মী অনিশ্চয়তার এই ঝুঁকিটি আমায় নিতে হয়েছে।
হতে পারে, আর একটু পরে, কিংবা এই লেখাটি শেষ করার মুহূর্তে আমি মারা যাবো! ঈশ্বর, তা যেন না হয়। লেখাটি শেষ করার সুযোগ যেন পাই। আর, ফ্রাউলিন, তোমায় বলছি,-‘আমার জন্য শোক করো না; আমরা সবাই ভাইমারের সবুজ পাইনবন থেকে এসেছি এবং অন্তিমে সেখানে ফিরে যাবো। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো,-লিখতে বসার আগে ডিনার সেরে নিতে আমি ভুল করিনি। অবশ্য ক্যান্ডেল নাইট ডিনার।
ভাইমারের কথা খুব মনে পড়ে। ভাইমারে এমন কোনো রোববারের কথা মনে করা কষ্টের, যে-রোববারে আমরা দুজন ক্যান্ডেল নাইট ডিনার করি না। ব্যাপারটি চমৎকার। বিজলি বাতির কারণে রাত্রির অন্ধকার সেখানে উপলব্ধি করা কঠিন। আলোর বন্যার মাঝে ক্যান্ডল নাইটের আধো-অন্ধকারে তোমার হাতের রঙ আমি সবচেয়ে ভালোভাবে স্পর্শ করতে পারি।
আজ সেটা ঘটেছে। আলো এখানে দুর্লভ ঘটনা হলেও ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে আমি যখন মোমবাতি জ্বালাই, মনে হলো ভাইমারের আকাশ পথ ভুল করে পূর্ব বাংলার ছোট্ট এই শহরে চলে এসেছে। তোমার সাদা রঙের স্কার্ট ও চোখে উজ্জ্বলতার আভাস পেলাম যেন। আভাসটি স্মরণ করিয়ে দিলো,-একদা আমরা পরস্পরকে খুব ভালোবাসতাম। তোমার স্কার্টের রঙ ও গায়ের গন্ধে জার্মান সসেজের ভাপ টের পেয়ে খেপে উঠতাম আমি।
যৌনতা জার্মানদের অতি প্রিয় একটি শব্দ এবং তোমাকে আমি যৌনতার মতো ভালোবাসি। যৌনতা হচ্ছে সংবেদনশীল সবুজ; যাকে অনুভব করলে ভাইমার ও তোমার মুখ মনে পড়ে। কিন্তু এই দেশে পা’ রাখার দিন থেকে দেখছি যৌনতা প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! আমি আর এসব ভাবতে চাই না...
ভয় পেয়ো না ফ্রাউলিন, গত রাতে নিজেকে পরীক্ষা করেছি;-প্রাণপণে চোখ বুজে তোমার স্কার্টের রঙ মনে করার চেষ্টা করে! এটি জেনে তুমি সুখী হবে যে তোমার মুখ আমি মনে করতে পারি এবং আমার পুরুষাঙ্গটি ভাইমারের দিনগুলোর মতো দৃঢ় ও উচ্ছ্রিত হয়। এই সক্ষমতা আমায় পাইনবনের সুখ দিয়েছে। ভাইমারের ঘাসগুলোর খবর আমায় শোনাতো পারো।
এই সেপ্টেম্বরে ওরা নিশ্চয় বেশ সবুজ হয়ে উঠেছে। আর আমার বন্ধুদের খবর কী বলো? মাথামোটা রাইকার্ড নিশ্চয় রোজ তোমায় এই বলে প্রশংসা করে,-‘গেরহার্ডের সঙ্গে ফ্রাউলিনের ভালোবাসা হের হিটলারের এমপিফিটামিন নেয়ার মতো একটি উদ্ভট ঘটনা। কেননা হিটলার এমপিফিটামিন নেয়, যা তার স্নায়ুকে চনমনে রাখে। মিত্র শক্তি বার্লিনে ঢোকার ক্ষণে এমপিফিটামিন তার কার্যকারিতা হারায়, এবং হের হিটলার প্রিয়তমা ইভা ব্রাউনকে নিয়ে বাঙ্কারের গর্তে নিখোঁজ হয়। নাৎসিবাদ একটি এমপিফিটামিন, আর হের হিটলার এখনো জীবিত।
’ বেচারা রাইকার্ড। আমার হয়ে ওর গালে চুমু পাঠিয়ে দিও। ওকে জানিয়ে দিতে ভুলো না,-এমপিফিটামিনের চেয়ে ওর মোটাসোটা গালে চুমু খাওয়া অনেকবেশি কামদায়ী, এবং গেরহার্ড তার ফ্রাউলিনকে সেই অনুমতি দিয়েছে। তবে খোদার কসম,-রাইকার্ডের গালে যখন চুমু খাও, ওর পালস্টা মেপে নিও প্লিজ। ওকে বলো যুদ্ধ আমায় উদার করে দিয়েছে, আর হের হিটলার এখনো জীবিত! প্রিয় ফ্রাউলিন, নাৎসিবাদ একটি এমপিফিটামিন এবং সব যুদ্ধে সমান কার্যকর।
যাকগে, ক্যাথির খবর কী বলো। সব্জি-রঙ মিষ্টি মেয়েটি কেমন আছে? সে কি আগের মতো খাটো স্কার্ট ও সরু হাইহিল পরে? বাতাস লেগে যা বেলুনের মতো ফুলে ওঠে তার টকটকে লাল প্যান্টিকে দৃশ্যমান করবে বলে? প্যান্টি একটি গোপনীয় অন্তর্বাস। যৌনতাকে এটি উত্তেজিত করে। উত্তেজিত হওয়া মানে তোমায় ভালেবাসা, ভাইমারের মুখ মন পড়া। এই শহরে আসার পথে তোমার প্যান্টির মিষ্টি ছাটের কথা মনে করে উত্তেজিত হতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু প্রবল গোলাগুলি শুরু হলো,-আমার চোখ প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! এসব আর ভাবতে চাই না...
আমাদের বাড়ির খবর কি বলো? মা-বাবা কেমন আছে? বুড়ো-বুড়ি কি আমায় আলাপ করে? কতো বয়স হলো দু’জনার? বৃদ্ধ দম্পতিকে এই খবরটি পৌঁছে দিও,-তাদের শুকনো গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, দৃৃশ্যটি বড়ো বেমানান হবে আমার জন্যে।
গত ছয় মাস ধরে এতো মানুষকে কাঁদতে দেখেছি, এবার একটু হাসতে চাই। মা কি এখনো পিয়ানো বাজায়? আর বুড়ো? পিয়ানো সম্পর্কে তার মনোভাব কি বদলেছে? নাকি সে এখনো মনে করে মোজার্টের সিম্ফনিগুলো পিয়ানোর চেয়ে ভায়োলিনে জমে ভালো; এবং মোজার্টের শিষ্য হিসাবে হামেল খানিকটা কুঁড়ে ও অলস! বুড়োকে জানিয়ে দিও, মা আসলে খুব ভালো পিয়ানো বাজায়, বিশেষ করে বাখ ও ওয়াগনার। এই দেশে অনেকে ভালো হারমোনিয়াম বাজাতে পারে। ভারত উপমহাদেশে হারমোনিয়াম একটি জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র। যন্ত্রটিকে তুমি পিয়ানোর ক্ষুদ্র সংস্করণ ভাবতে পারো, তবে এর আওয়াজ পিয়ানোর মতো অতোটা সুরেলা ও বিস্তৃত নয়।
এখানে বাঁশি ও ভায়োলিনের চল আছে এবং অনেকেই ভালো বংশীবাদক। ভায়োলিন এমন এক বাদ্যযন্ত্র যেটি ভাইমারকে মনে করায়। জন্মভূমিকে জাগানোর জন্য পৃথিবীর সবখানে সুর তোলে সে। গেলবার এক ভায়োলিনবাদকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। গ্রাম্য কোনো সুর বাজাচ্ছিলো সে।
মৃত্যুর বিষাদ ও জীবনের আস্বাদে যে আর্তি ধরা থাকে, ভায়োলিনবাদক সেই আর্তিকে তার আঙুলে জমা করেছিল। এবার তাকে খুঁজে পেলাম সবুজ কলাবাগানে;-পুকুরের ধারে কালো গর্ত ভরা দু’চোখ নিয়ে বসে আছে। ভায়োলিন বাজানোর অপরাধে সেনারা তার চোখ উপড়ে দিয়েছে। আমি তার কাঁধ স্পর্শ করলে লোকটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। মৃত্যুর ভয় জমা ছিল সেখানে।
ফ্রাউলিন, পূর্ব বাংলায় মৃত্যুর হাতে জখম হওয়ার ভয়ে মানুষ এখন কাঁদে। একটি ভয়-উপদ্রুত উপকূলে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি। একদা যেমন ছিল আউশভিৎস। যদি পারো আমার প্রিয়তম বুড়িকে জানিয়ে দিও,-গেরহার্ড কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। মানুষকে আলিঙ্গন করতে ভয় পাচ্ছে।
প্রতিটি আলিঙ্গন একেকটি মৃত্যুফাঁদ;-ভয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাস সেখানে ওত পেতে রয়েছে! ঝগড়াটে বুড়োর কানে এই খবরটি যেন পৌঁছায়,-গত ছয় মাসে গেরহার্ডের চুল-দাড়ি অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে। তাকে দেখতে জেসাসের মতো লাগে। কিন্তু অন্ধকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে কিংবা মৃত কোনো ল্যাজারাসকে পুনর্জীবিত করতে সে অক্ষম। বুড়োকে আরো জানাও,-এই দেশে প্রচুর বুড়ো লোকজন বসবাস করে, যাদের বয়সের কোনো গাছ-পাথর নেই। অশীতিপর এক বৃদ্ধ সেদিন গেরহার্ডকে তার আক্ষেপের কথা শুনিয়েছে।
পাকিস্তানী সেনারা বৃদ্ধকে হত্যা না-করে তার নাতিকে হত্যা ও নাত-বৌ’কে ধরে নিয়ে গেছে। রক্তের প্রবাহকে এভাবে হারানোর যন্ত্রণা বৃদ্ধকে মাঝেমধ্যে পাগল করে তোলে। কিন্তু সে আত্মহত্যা করতে পারছে না। বৃদ্ধ এখনো আশা করে,-যা ঘটেছে তা একটি দুঃস্বপ্ন এবং তার নাতি ও নাত-বৌ অচিরেই তার কাছে ফিরে আসবে!
এই বৃদ্ধের আহাজারি গেরহার্ডকে তার ইহুদি জনকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। প্রিয় ফ্রাউলিন, গেরহার্ড তার বাবার কাছে এই খবরটি পৌঁছে দিতে তোমায় অনুরোধ করছে,-ইহুদি নিধনের মিশন আপাতত শেষ করেছে কেউ।
বৌদ্ধ হত্যার মিশন ভিয়েতনামের কলা বাগানগুলোকে এখনো সবুজ করতে পারেনি। আর এখানে শুরু হয়েছে হিন্দু হত্যার মিশন। তারপর? অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয় মুসলমান হত্যার মিশনে নামবে কেউ? প্রিয় বাবা, ফ্রাউলিনের মাধ্যমে তোমায় অবগত করি,-ধর্ম একটি মারাত্মক এমপিফিটামিন। হের হিটলার এমপিফিটামিন ভালোবাসতেন। জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীরা এটি ভালোবাসে।
এখন তারা ঘরে ও ধানখেতে সমানে মানুষ হত্যা করছে। পূর্ব বাংলার ধানখেত ও ভিয়েতনামের ধানখেতের মধ্যে প্রচুর মিল রয়েছে। ধানখেত প্রথমে কচি সবুজ হয়, কচি সবুজ থেকে কালচে সবুজ, অতঃপর সোনালি হয়। তবে এই দেশে একটি নতুন ধানখেত আবিষ্কার করেছে গেরহার্ড। ধানখেত প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! এসব আর ভাবতে চাই না।
ফ্রাউলিন, আমার বয়স্ক বাবার কানে খবরটি পৌঁছে দিও,-মোজেস ছাড়া স্বর্গের সিঁড়ি বোধহয় আজো কেউ নাগাল পায়নি। পৃথিবী থেকে শুধু নরক দেখা যায়। বাবাকে বলো,-আউশভিৎস ও গ্যাস চেম্বার এখনো সক্রিয়। যেমন সক্রিয় বেয়নেট ও যুদ্ধ বিমান!
ফ্রাউলিন, আরো কিছু খবর পাঠাও আমায়। অবশ্যই ভাইমারের।
বিনিময়ে তোমায় আমি টেগোরের কবিতা ও গান শুনাবো। গ্যেটেকে ভাইমারের আত্মা বলে সম্বোধন করা হয়। টেগোরকে তুমি বাঙালির আত্মা নামে সম্বোধন করতে পারো। টেগোর এক বহুবর্ণিল মানুষ। বাঙালিরা টেগোরকে তাদের রক্তে ও পরিপাকে বহন করে; জার্মানি যেমন বহন করে গ্যেটে ও শিলারকে।
আমি নিশ্চিত টেগোরের গান তোমার ভালো লাগবে। কারণ তার গান সহজ অম্লজানের মতো রক্তের ভিতরে ঢুকে ছন্দ তোলে। বাঙালিরা এই গানের বিষয়বস্তুকে বড়ো ভালোবাসে। তবে আমার ভালো লাগে গানের ভিতরে প্রবাহিত সুরধারা। টেগোর একজন উৎকৃষ্ট কম্পোজার।
তাঁর গানে নিঃশব্দ-কে পড়া যায়। আমি পড়া শব্দটি ব্যবহার করছি। কারণ, টেগোরকে বাখ বা বেথোভেনের মতো অনুভব করতে হলে তোমাকে তার গানের সুরধারা খেয়াল করে উঠতে হবে। এখানে এসে কিছুটা বাঙলা শিখেছি আমি। তবে টেগোর বা অন্য বাঙালি কবিদের উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট বাঙলা আমি জানি না।
এটি একদিক দিয়ে আমায় রক্ষা করেছে। বাঙালির মতো বাঙলা জানা থাকলে আমি হয়তো টেগোরের গানের ভাববস্তুকে বেশি গুরুত্ব দিতাম এবং তার সুরপ্রবাহ আমায় সেভাবে আকৃষ্ট করতো না। বাঙলায় খর্ব হওয়ার কারণে টেগোরের সুর শুনে আমি ভাইমারকে অনুভব করি। বিষয়টি আমায় আনন্দ দিয়েছে। তোমার জানা উচিত,-টেগোরকে আমি পছন্দ করি তার গ্যেটেসুলভ মহৎ কাণ্ডকীর্তির জন্য নয়; আমি তাকে পছন্দ করেছি, কারণ, তাঁর গান আমায় ফ্রাউলিন ও ভাইমারের মুখ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
যাকগে, টেগোর সম্পর্কে আরো গল্প করার ইচ্ছে থাকলেও এই মুহূর্তে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু ঈশ্বর আমায় করুণা করছেন এবং আমি তোমার শুষ্ক ঠোঁটের উদ্দেশে এখনো চুম্বন পাঠাতে পারছি। আমি মনে করি ভাইমার ত্যাগ করার সময় গ্যেটে তার বান্ধবীর শুষ্ক ঠোঁটে এইরকম চুম্বন করতেন। পবিত্রতা নামের নতুন এক রঙ দিয়ে আমি এটি অনুভবের ইচ্ছা করি। আমার কাছে চুম্বন হচ্ছে যুদ্ধ-প্রতিরোধী শব্দ।
যদিও এখানে তা নয়। ঢাকা থেকে চিটাগাং যাওয়ার পথে শত্রুরা একটি কলোনিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের লেলিহান শিখার অদূরে দাঁড়িয়ে দেখেছি দাড়িওয়ালা এক লোক একটি কিশোরীকে প্রাণপণ চুম্বনে বিধ্বস্ত করছে। মরণপণ সেই চুম্বনে কিশোরীর অনিচ্ছা আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম। সে ছটফট করছিল।
আগুনের শিখার মতো উজ্জ্বল সেই কিশোরীর ঠোঁটের রঙ প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! এই দৃশ্যটি আমি আর ভাবতে চাই না! পরিবর্তে তোমায় এই বাক্যটি স্মরণ করতে বলি,- চুম্বন এক মৃত্যু-প্রতিরোধী যুবক, যে তার দয়িতাকে জীবনের দিকে আগলে রাখে। তবে এখানে তা নয়। রণাঙ্গনে চুম্বন মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে পারে না।
ওসব থাক! ভাইমারের আরো খবর পাঠাও আমায়। জন্মভূমির জন্য আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি।
এই তৃষ্ণা তোমার অন্তর্বাসের দিকে আমায় উৎকর্ণ করেছে। তুমি যখন ঘুমাও, টের পাও কি,-অন্তর্বাসরা শব্দ করে? ফ্রাউলিন, এই বাক্যটি তোমায় শিহরিত করার জন্য যথেষ্ট হবে,-অন্তর্বাস হচ্ছে এক সংগোপন যৌন-অস্তিত্ব, যেটি জন্মভূমির সঙ্গে মানুষকে মিলিত করে। আমি মিলিত হতে চাই। আজকের এই রাত বাস্তবিক মিলনের রাত হয়ে এসেছে;-তোমার সঙ্গে, এবং অদেখা জন্মভূমির সঙ্গে।
হোটেল বয় সতর্ক সংকেত দিয়ে গেলো আজ রাতে যুদ্ধ বিমান হামলা করতে পারে।
মুক্তিবাহিনী নাকি শহরে ঢুকে পড়েছে। মুক্তিবাহিনী এক সংগোপন যৌন-অন্তর্বাস। হোটেলে বসে তাদের নড়াচড়া স্পষ্ট টের পাচ্ছি; তাদের কাদাভেজা অন্তর্বাসের খসখসানি শুনতে পাচ্ছি। গেরিলা রণাঙ্গনে অন্তর্বাস ঘুমন্ত কোনো নারীর মতো। তাকে স্পর্শ করার আগে সে কোনো শব্দ করে না।
নৈঃশব্দ্য আমায় ভাইমারের দিকে মনোযোগী করছে এখন। আমার ছোট্ট শহর, বালকবেলার প্রথম যৌনতা,-তোমায় মনে করে গেরহার্ডের চোখ ভিজে উঠছে। তুমি তাকে আলিঙ্গন করো, তাকে নিজের ভেতরে জড়িত করো। গেরহার্ড তোমায় বলছে,-এই ছয় মাসে তার চুল জেসাসের মতো লম্বা হয়েছে এবং সে বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছুক। প্রিয় ভাইমার, ফ্রাউলিনের মাধ্যমে তোমায় এ-বার্তাটি পৌঁছে দিচ্ছি,-গেরহার্ড একজন ইহুদি, আর ইহুদির কোনো স্বীকৃত জন্মভূমি নেই।
তবু গেরহার্ড ভাইমারকে ভালোবাসে, যেমন ঈশ্বর ভালোবাসতেন মোজেসকে। তুমি কি একবার স্মরণ করবে,-আমরা সবাই আব্রাহামের বংশধর ছিলাম! আব্রাহাম আসে মিশর থেকে, অতঃপর সে ছড়িয়ে পড়ে সিরিয়া, কিনান, বেথেলহাম ও সৌদি আরবে। মরিয়ম পুত্র ঈসাকে বলো,-গেরহার্ড ভাইমারের সন্তান এবং মোজেসের অংশ। সে জন্ম নেয় ভাইমারে এবং তার জন্ম হয়েছে কিনান বা জেরুজালেমে। যেমনটি বাঙালিরা, তারা জন্ম নেয় পূর্ব বাংলায় এবং তাদের জন্ম হয়েছে মোহাম্মদের প্রবাহে।
মরিয়ম-পুত্রের কাছে গেরহার্ডের জিজ্ঞাসা,-তুমি কি জানো রক্তের রঙ কেমন হয়? রক্ত হয় প্রথমে লাল, তারপর কালচে সবুজ, তারপর...! নাহ! এসব আর ভাবতে চাই না...!
কিছু মনে করো না ফ্রাউলিন। এই ছয় মাস আমায় উন্মাদ করে দিয়েছে। মানুষকে ভেবে-ভেবে নিজেকে ভাবার শক্তি হারিয়ে ফেলছি আমি। এবার তোমায় ভাবতে চাই। ভাইমারকে ভাবতে চাই।
সাচ্চা এক ইহুদির পেশাগত আত্মবিশ্বাস জখম হয়েছে। এর জন্য ভাইমার কি তাকে উপহাস করবে। আশা করি তা ঘটবে না। জার্মান একটি মহান জাতি, আর ভাইমার আমাদের গর্ব। ছোট্ট এই রিপাবলিকে ইহুদিকে সম্মান করা হয়েছে, তুর্কিরা এখন যেটি পাওয়ার আশা করে জার্মানিতে।
গেরহার্ড এই বার্তাটি মোহাম্মদকে পাঠাতে ইচ্ছা করে,-পূর্ব বাংলায় প্রেরিত পুরুষের ধর্মকে হত্যা করা হচ্ছে।
প্রিয় ফ্রাউলিন, আমি এখন হালকা হতে চাই। বুর্কেনহফের খবর জানাও আমায়। সে কি এখনো যথেষ্ট ওজন তুলতে পারে। ওয়েট লিফটিংয়ে বুর্কেনহফ এক আশ্চর্য প্রতিভা।
তার দশাসই শরীর গঁথিক খিলানের মতো কারুকার্যময়। জার্মানি বীরত্বকে সম্ভ্রম করে, আর বুর্কেনহফ সম্ভ্রম করার যোগ্য। ওকে বলো,-গেরহার্ড বুর্কেনহফকে সমীহ করে; যেহেতু ওয়েট লিফটিংয়ে সে অতিমানবীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে যাচ্ছে। জার্মানি অতিমানবকে সমীহ করে। যদিও অতিমানব এক অবাস্তব ওয়েট লিফটিং, হের হিটলার যার অনুশীলন করতেন।
বুর্কেনহফকে জানাও,-আসন্ন অলিম্পিকে ভাইমারের গর্ব যেন ক্ষুণœ না হয়। আমরা নিশ্চয় সোনার মেডেল পরা বুর্কেনহফের চেয়ে.. .. ক্রসটিকে অধিক পছন্দ করবো না? কিন্তু এখানে তা নয়। বুকে পদক ঝুলানো পাকিস্তানী জেনারেলরা পূর্ব বাংলায় শক্তির ওয়েট লিফটিং করছে এখন। তারা জেনে গেছে ওয়েট লিফটিং এক অতিমানবীয় ঘটনা, যা হের হিটলারকে চিরজীবী করেছে!
ফ্রাউলিন, ভাইমারের সংবাদ নেওয়ার আগে ওয়েট লিফটিংয়ের আরো কিছু বিবরণ শুনাই। ভাইমার একটি ছোট রিপাবলিক।
এবং পূর্ব বাংলার এই শহরটি ভাইমারের মতো। এখানে পা রাখার আগে তেরোটি শহর ও এগারোটি গ্রাম আমি ঘুরেছি। সংবাদকর্মীর দায়িত্ব হলো ঘটনার বিবরণ ও পরবর্তী সম্ভাব্যতা অনুমান করা। রাজধানীতে বসে আমার সম্পাদক কী চায় সেটি তুমি জানো। দক্ষিণ এশিয়ায় উড়ে আসার আগে মি. শোফেনস্খিলের টেকো মাথায় প্রজাপতি উড়তে দেখেছি আমি।
বিপদজনক বিছার মথ থেকে প্রজাপতির মতো যৌন-আবেদন সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। প্রজাপতি একটি চমৎকার যৌনতা। এটি মি. শোফেনস্খিলের টেকো মাথা ও ন্যাড়া পুরুষাঙ্গে যুদ্ধের গুঞ্জন তুলছে। ফ্রাউলিন, তুমি কি জানো,-শোফেনস্খিলের পুরষাঙ্গ কীসে উত্থিত হয়? তোমায় আমি এই খবর দিয়ে হাসাতে চাই,-শোফেনস্খিলের পুরুষাঙ্গ ভাইমারের রাণি মার্লিন ডিয়াট্রিচের যৌবনকে স্মরণ করে শিথিল হয়ে পড়ে। ডিয়াট্রিচের যৌবন ছিল জার্মানির উত্থিত হওয়ার মতো ঘটনা।
উত্থিত হওয়া এক গভীর শিল্পকলা, যেটি জার্মানিকে আমেরিকার কাছে বিস্ময়কর করেছে। ভাইমারের রাণি আমেরিকাকে উত্থিত করেছে তার শিল্পকলায়। শোফেনস্খিলকে পারেনি। তাকে যেটি উত্থিত করে, আমি কি সেই নাম উচ্চারণ করবো? তুমি খবর নিতে পারো, গেরহার্ড বলছে,-ভাইমারের রাণির চেয়ে বুখেনওয়াল্ডে শোফেনস্খিলের পুরষাঙ্গ অধিক দৃঢ় হয়ে ওঠে। হলিউড ভাইমার থেকে বহু দূর! বুখেনওয়াল্ড খুব বেশি হলে আট কিলোমিটার।
শোফেনস্খিল এই আট কিলোমিটারের ভিতরে উত্থিত হয়; কারণ, বুখেনওয়াল্ড হলো এক আজব চিড়িয়াখানা। বন্দি ক্রীতদাসরা সেখানে ভাড়া খাটে মিল-কারখানায়, এবং বাধ্য হয় উত্থিত জার্মানিকে স্যালুট দিতে। ওইসব বন্দি প্রজাপতি শোফেনস্খিলের পুরুষাঙ্গ দৃঢ় করে; কারণ, বন্দি আসে পূর্ব ইউরোপের পেট চিরে, জার্মানির পেটের ভেতরে বসে গণতন্ত্র জারি রাখতে ইচ্ছুক সব এলাকা থেকে। প্রিয় ফ্রাউলিন, তুমি কি একমত হবে,-জার্মানি কখনো গণতন্ত্রে ছিল না, আর গণতন্ত্রে পুরুষত্ব উচ্ছ্রিত হয় না। শোফেনস্খিল আজো বিশ্বাস করে,-নাজিরা দরকারি, কারণ, তারা জার্মানিকে পুরুষত্ব দিয়েছিল!
ফ্রাউলিন, আমি কি বলতে পারি শোফেনস্খিলের পুরুষত্ব তার টেকো মাথা ও চৌকোনো গোঁফের মতো রঙদার? এই দেশের খবর পাঠাবার জন্য আমায় সে বেছে নেয়।
যদিও আমার পুরুষত্ব এটি অনুভব করে উত্থিত হতে পারেনি। সে আমার পিঠ চাপড়ে বলেছিল,-রণাঙ্গনে যুদ্ধের খবর সংগ্রহের নাটকীয়তা সংবাদকর্মীর পুরুষত্বকে দৃঢ় করে! গেরহার্ড একজন শক্ত পুরুষ, এক খাঁটি জার্মান,-যুদ্ধের বিষকামড় সে সইতে পারবে।
ফ্রাউলিন, আমার হয়ে শোফেনস্খিলের টেকো মাথায় এই খবরটি চালান করো,-যুদ্ধের খবর সংগ্রহে আমি বোধহয় বিশ্বস্ততার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছি। ইস্টার্ন গ্যারিসনের সর্বশেষ তৎপরতা জানার জন্য পূর্ব বাংলার তেরোটি শহর ও এগারোটি গ্রাম আমি সফর করি। তিনটি বধ্যভূমি সরেজমিনে পরিদর্শন করি।
সফরটি আমায় এই অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে,-গুলি-খাওয়া মানুষের রক্তের রঙ সরু ফোয়ারার মতো; কোনো মানুষ যখন গুলি খেয়ে মাটিতে গুঁড়ি মেরে বসে বা লুটিয়ে পড়ে, তার গুলিবিদ্ধ জায়গাটি থেকে পিচকিরির মতো লাল ফেনা বের হয়; অতঃপর সেই লাল গলে-পচে সংবাদকর্মী ও শকুনের খোরাকি হয়। মি. শোফেনস্খিলের কাছে জরুরি বার্তা পাঠাচ্ছে গেরহার্ড,-তুমি জেনে আনন্দিত হবে তিনটি বধ্যভূমি আমি ঘুরেছি। মুক্তিবাহিনী সন্দেহে কয়েক হাজার বাঙালিকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। একটি বধ্যভূমির মধ্যে বাঙালির পাশে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সেনার লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। তাদের গায়ের ইউনিফর্ম দেখে মনে হলো বধ্যভূমিতে লাশ হওয়ার আকস্মিক দুর্ঘটনা তারা হজম করতে পারছে না।
এটি এক বিস্ময়কর সমন্বয় মনে হলো। শত্রু-মিত্রে বিভেদ ঘোচানোর জন্য যুদ্ধ হলো একটি মোক্ষম এমপিফিটামিন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বিকে সে বধ্যভূমিতে সমেবত করে।
ফ্রাউলিন, গেরহার্ডের হয়ে শোফেনস্খিলকে অবগত করো,-পূর্ব বাংলায় বধ্যভূমির সংখ্যা বাড়ছে আর আমি ক্রমাগত ভাইমারে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছি। দয়া করে জানাও, শোফেনস্খিলের টাক মাথার দিব্যি দিয়ে গেরহার্ড এই খবরটি ছাপাতে বলেছে,-বধ্যভূমিগুলো মানুষের দুর্গন্ধে পচে উঠছে।
চোখে ফেট্টি বাঁধা এইসব মানুষকে বর্ণনা করতে গেরহার্ড ভয় পাচ্ছে। তাকে যেন করুণা করা হয়। সে এখন ক্লান্ত। গত কিছুদিন ধরে একটি দুঃস্বপ্ন তাকে পাগলা কুকুরের মতো তাড়া করে। চোখ বুজলেই গেরহার্ড দেখতে পায় গ্যাস চেম্বারে ইহুদিরা ফুলে-ঢোল-হয়ে উঠছে, এবং শোফেনস্খিলের পুরুষাঙ্গ ও টেকো মাথার চতুর্দিকে একটি প্রজাপতি বনবন করে পাক খাচ্ছে।
________________________________চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।