১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রায় ১৪০ মাইল বেগে ঘূর্ণিঝড় গোর্কি আঘাত হানে বৃহত্তর নোয়াখালী, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী প্রভৃতি উপকূলীয় জেলায়। সে সাথে ছিলো ১০ ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছাস। এর চেয়ে বেশি তীব্রতার ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে পরেও আঘাত হানে। কিন্তু এতো প্রাণহানি আর ক্ষয়ক্ষতি এর আগেপরে আর হয়নি। বেসরকারী হিসাবমতে মানুষ মারা গেছে ১০ লাখ।
সরকারী হিসাবে ৫ লাখ। গবাদিপশুর মৃত্যু আর সকল ঘরবাড়ীর ধূলায় মিশে যাওয়ার দৃশ্য যে দেখেছে সে সেটা কখনো ভুলতে পারবে না। এতো বিপুল প্রাণহানি আর ক্ষতির কারণ ছিলো সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় যথাসময়ে সতর্কসঙ্কেত না জানানো, কুঁড়েঘর সহ দুর্বল কাঠামোর বাড়ীঘর, আশ্রয় নেয়ার মতো ভবনের অভাব এবং অতিঅনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা যা পরবর্তী ত্রাণ কার্যক্রমেও সমস্যার সৃষ্টি করেছিলো। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিলো তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সীমাহীন উদাসীনতা।
এসব জেনেছি বড়ো হয়ে।
নিজের বাস্তব যে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা সেটা জানাবার জন্যই এই প্রয়াস।
আমি তখন প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা। রমজান মাস ছিলো বলে তখন স্কুল ছুটি ছিলো। সামনে ছিলো ১৯৭০ সালের সেই ঐতিহাসিক নির্বাচন।
নির্বাচনী সভা আর মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিলো দেশের অন্য অঞ্চলের মতো উপকূলীয় অঞ্চলও। আমাদের বাড়ি ঠিক উপকূলীয় এলাকায় নয় বলে জলোচ্ছাস পৌঁছেনি। কিন্তু রেহাই পাইনি প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টির হাত থেকে।
ঝড়ের দু'তিন দিন আগে থেকে হালকা ঝড়ো হাওয়া আর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ছিলো। ফলে ঘরে আটকে থাকতে থাকতে অতীষ্ট হয়ে পড়েছিলাম সেই দূরন্ত শৈশবে।
নোয়াখালী এলাকায় বর্ষাকালে টানা ১০/১৫ দিন বৃষ্টির অভিজ্ঞতা ছিলোই। কিন্তু শীতের বৃষ্টি বলে মা ঘরের বাইরে পা ফেলতে দেননি। ঝড়ের মাত্র মাস খানেক আগে আমাদের চৌকাঠের ওপর নতুন ভিটিপাকা টিনের ঘর তৈরী হয়েছে। নতুন ঘরে ওঠা উপলক্ষে প্রথম রমজানে মিলাদ পড়ানো হয়েছিলো। এর আগে থাকতাম ইসলামাবদে কর্মরত আমার বেতার প্রকৌশলী বড়ো চাচার দালানে।
সেটি ছিলো আমাদের গ্রামের প্রথম দালান। (এজন্য আমাদের বাড়ীর নাম হয়ে গিয়েছিলো দালানওয়ালা বাড়ী)
১২ নভেম্বর সকাল থেকেই ঝড় আর বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে শুরু করে। আমাদের ঘরে সেই কালের সবচেয়ে বনেদী বলে গন্য হওয়া ফিলিপসের তিন ব্যাণ্ডের ট্রানজিস্টার ছিলো। সেটা শুনে বাবা মাকে বেশ চিন্তিত দেখে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। তাঁরা আমাদের না শোনার মতো করে কথা বলছিলেন।
আমরা তখন তিন ভাই এক বোন (এখন ৪ ভাই ২ বোন)। আমি সবার বড়ো। তখনকার সবচেয়ে ছোট ভাইটির বয়স সেদিন ছিলো ২১ দিন। ফলে আমার নানীও ছিলেন আমাদের বাড়ীতে। সকাল থেকেই অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় হারিকেন জ্বালাতে হয়েছিলো।
আসরের নামাজের সময়েই অন্ধকার ঘন হয়ে গেলো। তখন প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়ে গেলো। আব্বা মোটা মোটা দড়ি দিয়ে প্রতিটি খুঁটির সাথে চালের কাঠগুলোকে বেঁধে দিলেন। দুপুর থেকে ঘরে থাকা পাট দিয়ে আব্বা, আম্মা মোটা মোটা দড়িগুলো পাকাতে শুরু করেছিলেন। সন্ধ্যা থেকে মনে হচ্ছিলো এই সব দড়িতে কুলাবে না, সব ছিঁড়ে এই বুঝি ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেলো।
অবস্থা বেগতিক দেখে আমাদের বিভিন্ন ঘরের ছোটদের আমার দাদীসহ দালানে পাঠিয়ে দেয়া হলো। দাদা আর চাচারা নিজ নিজ ঘরে থাকলেন। রাতে খাবার নিয়ে এক মহা যন্ত্রণা। বাতাসের তীব্রতায় দালানের ভেতর পর্যন্ত স্টোভ ঠিক মতো জ্বলছিলো না।
ঝড়ের আগে বিকালে হঠাৎ দেখি বাতাসের ভাব বদলে গেছে।
মনে হচ্ছিল বাতাসে লবন মেখে দেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে লবনাক্ত বাতাসের সাথে গরম বাতাসও লাগছিলো। (১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়েরর সময় ঢাকায় বসে শৈশবের সেই হাওয়ার ছোঁয়া পেয়েছিলাম। )
রাত যতো বাড়ছিলো ঝড়ের তীব্রতা, বৃষ্টির মাত্রা বাড়ছিলো। মূল ঝড় রাতের প্রথম ভাগেই আঘাত হেনেছিলো।
ঝড়ের শব্দেই ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো। তারওপর শুরু হলো বিশাল বিশাল গাছ আর ডাল ভেঙ্গে পড়ার বিকট শব্দ। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি আমরা মরে গেলাম। সেকি প্রচণ্ড সোঁ সোঁ শব্দ ! গাছের ডাল ভেঙ্গে মনে হচ্ছিল গায়ের ওপর পড়বে।
আসলে লিখে বা বর্ণনা দিয়ে সেই ঝড়কে বোঝানো যাবে না।
যারা এই ঝড়ের পাল্লায় পড়েছেন তারাই শুধু বলতে পারবেন কী ভয়ঙ্কর এই অভিজ্ঞতা ! কেয়ামত কেমন হবে এই ঝড় হয়তো তার একটা ডেমোনোস্ট্রেশন !
২০০৭ সালের মে মাসে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় কর্মরত থাকার সময় ১৫ মে ৭নং বিপদ সঙ্কেত ছিলো। রাত ৮টায় গহিরায় ( রাউজানে আরেকটি গহিরা আছে) সাগরের পারে দেখেছিলাম ঝড়ের সময় সাগর কী রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ! সাগরের ঢেউ কতো বড়ো হতে পারে ! আমি পানি ছুঁয়ে দেখেছিলাম- অবিশ্বাস্য রকমের ঠাণ্ডা ! পানি ছুঁতে গিয়ে প্রায় পুরো শরীর ভিজে গিয়েছিলো।
যাই হোক, সব বিপদই এক সময় শেষ হয়। সেই ঘূর্ণিঝড়ও এক সময় থামলো। ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারিনি।
একটি শিশুর জন্য এটা যে কতো ভয়াবহ তা বোঝাতে পারার ভাষা আমার জানা নেই। সকালে দরজা খোলা হলো। দেখি তখনো ঝুম বৃষ্টি ! উঠানে পা দেবার জো নেই। বিশাল বিশাল কড়ই,আম,কাঁঠাল আর সুপারি গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে সারা বাড়ীতে। দুমড়ানো মোচড়ানো ঘরের চালের টিন পড়ে আছে।
কোথা থেকে উড়ে এসেছে সেই টিন খোদাই শুধু তা জানেন। বেশ কিছুদিন লেগেছিলো ভাঙ্গা গাছ সরিয়ে বাড়ি সাফ করতে।
ঝড় শেষ হবার পর খবর আসতে শুরু করলো মৃত্যু আর ক্ষয়ক্ষতির। রেডিওতেও শুনছিলাম। আমি ছিলাম রেডিওর অপারেটার।
এ নিয়ে একটা আলাদা ''ভাব''ও ছিলো।
দুদিন পর থেকে শুরু হলো বিভীষিকাময় আরেক অভিজ্ঞতা ! পচা লাশের লাশের গন্ধ আসতে শুরু করলো বাতাসে। গন্ধের চোটে খাওয়া তো মাথায় উঠলোই। শ্বাস প্রশ্বস নেয়াই তো এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়ে উঠলো। একটু নির্মল বাতাসে শ্বাস নেবার জন্য উন্মাদের মতো এখানে ওখানে ছুটে বেড়াতাম।
আল্লার কাছে প্রার্থনা করি আমার শত্রুরও যেন এমন শাস্তি না হয়। এই দূর্যোগে যাদের কাছের মানুষ মারা গেছেন তাদের কথা কী একটু ভাববেন চোখ বন্ধ করে।
তাহলে হয়তো একটু বুঝবেন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর আসলে কী ছিলো !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।