প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি
"আমি মরিয়া হইবো শ্রীনন্দের নন্দন তোমারে বানাবো রাধা, বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা" - রাধাররমনের বহুলশ্রুত এই গানে যে রাধার আকুলতার কথা শুনতে পাই, সেই রাধাকে আমরা কতটুকু চিনি? ‘রাধা’ নামে কোন চরিত্রের উল্লেখ মহাভারতে পাওয়া যায় না। এমনকি ১৮,০০০ শ্লোক সম্বালিত শ্রীকৃষ্ণের পুর্ণাঙ্গ জীবনী ভাগবৎ পুরানের কোথাও রাধা নামের কাউকে পাওয়া যায় না। কৃষ্ণের প্রণয়িনী হিসাবে রাধাকে পাওয়া যায় খ্রীষ্ঠিয় দ্বিতীয় শতকের প্রাকৃতকাব্য 'গাহাসত্যসঈ' তে। পরবর্তী সময়ে পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ ইত্যাদিসহ নানান সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশ কাব্যে শ্রীরাধার উল্লেখ পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতাব্দিতে কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং বড়ু চণ্ডিদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তনে রাধাকে কৃষ্ণের পরম প্রনয়িনী হিসাবে আমরা পাই।
জন্মসূত্রে সাধারন একজন গোপনারী হলেও কৃষ্ণলীলায় সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ চরিত্র হিসাবে তাঁকে পাওয়া যায়।
রাধা: বাংলার কল্পনা
শ্রীকৃষ্ণের প্রতি শ্রীরাধার গভীর অনুরাগ পৃথিবীর ভালোবাসার গল্পে এক আশ্চর্য কোমল অধ্যায় বলেই বোধ হয়; যে অনুরাগ জৈবিক তাড়নার সীমানা ছাড়িয়ে আরও ব্যাপক অর্থময় ও ব্যাঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে মথুরা-বৃন্দাবনের কৃষ্ণের কল্পনা চলে আসছে। কারও কারও মতে কৃষ্ণ ছিলেন ঐতিহাসিক ব্যাক্তি। পৌরাণিক জগতে কৃষ্ণ অবশ্য একজন নন; বেশ কয়েকজন কৃষ্ণকেই আমরা পাই।
কিন্তু কৃষ্ণের যুগল রাধার কল্পনা যিনি করেছিলেন বাংলারই এক কবি, তিনি কবি জয়দেব। এরপর থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত রাধা বাংলা পদাবলী সাহিত্যের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছেন। এই রাধার উপাস্য কৃষ্ণই যুগে যুগে ভারতবর্ষজুড়ে একাধারে প্রেমিক ও উপাসকের কৌতূহলের বস্তু হয়েছেন [১]। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাধা বাংলার কবিদেরই কল্পনা।
চৈতন্যপরবর্তী বৈষ্ণব সাহিত্যেই শ্রীরাধা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে আসেন।
নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্যদেবকে কৃষ্ণের অবতার বলে বিশ্বাস করেন বৈষ্ণবরা, রাধা ছিলেন তাঁর আরাধ্য। শ্রীচৈতন্যদেব বলতেন আমার অন্তরে রাধা, বহিরাঙ্গে কৃষ্ণ। এই উক্তির ব্যাখ্যা খুবই গভীর। শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন পুরুষ। ‘আমার অন্তরে রাধা’ - মানে, আমার অন্তরে নারীর অনুভূতি।
নারীর অনুভূতিই যাবতীয় শিল্পের ভিত। শিল্প-সঙ্গীত পাশাপাশি থাকে। বাংলা গানের ভিতটি শ্রীচৈতন্যদেবের হাতেই গড়ে উঠেছিল। আমরা যে কীর্তনের কথা জানি- সেই কীর্তনের সঙ্গে শ্রীচৈতন্যদেবের নাম জড়িত।
রাসলীলা প্রসংগে
বৈষ্ণব দর্শনে ভক্তের সাথে শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকেই বলা হয় রাস।
মণিপুরীরা অষ্ঠাদশ শতকে বৈষ্ণবধর্মের বলয়ে আসার পর তাদের প্রাচীন নৃত্যগীতের সাথে বৈষ্ণবধর্মের রাধাকৃষ্ণ দর্শনের সমন্বয় ঘটিয়ে মণিপুরী রাসলীলা প্রবর্তিত হয়। রাসলীলা অনেক ধরনের হয় - যেমন কুঞ্জরাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, মহারাস, দিবারাস ইত্যাদি। দিনের বেলায় যে রাস হয় সেটা দিবারাস। প্রতি বছর শারদীয় পূর্ণিমায় হয় মহারাস।
রাসলীলার সাথে নরনারীর ইহজাগতিক সম্পর্কের কোন যোগসূত্র নেই।
ভাগবৎ পুরাণে বলা হয়েছে, "রস্যতে আস্ব্যাদস্য অনেনেতি রাসঃ" - অর্থাৎ রাস হলো কৃষ্ণপ্রেমের রস আস্বাদন। পুরাণে নরনারী দু'প্রকারের ভক্তের সাথেই শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলার বিবরন রয়েছে। পুরুষদের রাসকে গোপরাস বা রাখুয়াল বলা হয়ে থাকে। বিষ্ণুপুরাণের ভাষ্য অনুযায়ী রাসলীলার সময়ে শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন নিতান্তই শিশু, বয়স ছিল মাত্র ৮ বৎসর ২ মাস। আর রাধা তো লোকসাহিত্যের একটি প্রতীকি চরিত্রের নাম যিনি লোকমুখে ক্রমবিবর্তিত হয়ে একাধারে হয়ে উঠেছেন একজন নারী, কুলবধু, কৃষ্ণভক্ত ও প্রেমিকার প্রতীক।
বলা হয় কল্পনার রাধাই মিথলজির কৃষ্ণকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। এই শুন্য শতকে এসেও মণিপুরী কবি তাই লিখে চলেন শ্রীরাধার গাঁথা- তুমি ছাড়া কৃষ্ণকে আমি চিনতাম না হে রাধা!
এক পরমপুরুষ, বাকী সব রাধা
সেই রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রনয়কাহিনীর ভেতর আরেক উচ্চমার্গের দর্শন। কৃষ্ণকে মনে করা হয় ভারতীয় মিথলজির পরমপুরুষ বিষ্ণু। কৃষ্ণ/বিষ্ণু হচ্ছেন পরমাত্মা আর সব জীবাত্মা। পরমাত্মা হচ্ছেন পুরুষ, আর জীবাত্মা হচ্ছে প্রকৃতি বা নারী; জীবাত্মার সর্বদা আকাঙ্খা পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়া।
বৈষ্ণব দর্শনে রাধারাণীকে সকল জীবাত্মার প্রতীক হিসাবে ধরা হয়, কৃষ্ণকে ধরা হয় পরমাত্মারূপে। পরমাত্মায় বিলীন হবার জন্য জীবাত্মার যে আকুতি - শ্রীরাধার প্রনয়যন্ত্রনা যেন তারই প্রতীক হয়ে উঠেছে।
শাস্ত্রের অকাট্যতা ও জাতিভেদ প্রথাকে অস্বীকার করে শ্রীচৈতন্য পদাবলী সাহিত্যের কোন একটি পাতা থেকে লৌকিক শ্রীরাধাকে তুলে এনে ভাগবৎ পুরাণের কৃষ্ণের সাথে সম্পর্ক গড়ে দিয়েছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল সকল মানুষ যেন নিজেকে রাধা ভাবে, তন্ত্রমন্ত্র যাগযজ্ঞ নয়, শ্রীরাধা যেভাবে তার ভক্তি ও প্রেম দিয়ে কৃষ্ণের কাছে পৌঁছে যান, সবাই যেন সেভাবেই তাকে পাবার সাধনা করে। বামুন-চণ্ডাল- বৈশ্য-ক্ষত্রিয় সবাই রাধা হয়ে গেলেতো আর জাতপাতের বিভেদ থাকেনা। সেকারণে শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলায় জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই রাধা হয়ে যান; রাধাভাব নিয়ে এক পরমপুরুষের প্রেমে বিলীন হয়ে স্থাপন করেন মানুষে মানুষে সাম্যতার অনন্য দৃস্টান্ত।
সবাইকে মহা রাসপূর্ণিমার অনেক শুভেচ্ছা।
তথ্যসূত্র:
১. ইমন জুবায়ের এর ব্লগ, রাধা: বাংলার কল্পনা
২. ভক্তি-রসনাম্বুমারি - এন তম্বা সিংহ, ইম্ফাল, ১ম সং, ১৯৬৮
৩. A Brief description of manipuri dance - Sharma, Atombapu & Singh, Amubi, 1960
৪. শ্রীরাধার ক্রমবিকাশ - শশীভূষন দাসগুপ্ত
৫. বাঙালীর ইতিহাস - নীহাররঞ্জন রায়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।