উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি
ছেলেবেলায় আমার ইচ্ছে ছিল চিত্রশিল্পী হওয়ার । ছবি আঁকা, মূর্তিগড়া প্রভৃতির দিকেই আমার বেশি ঝোঁক ছিল। ১৯৩৯ সালে আমি যখন মানিকগঞ্জ ভিক্টোরিয়া স্কুলে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র, তখন আমাদের স্কুলে ভারত উপমহাদেশের চলচিত্র নির্মাণের পথিকৃৎ মানিকগঞ্জেরই ‘বগজুরী’ গ্রামের সন্তান বিখ্যাত হীরালাল সেন-এর তোলা আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্রের প্রর্দশনী হয়। সে প্রদর্শনী দেখেই আলোকচিত্রের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে। তবে আমাদের পরিবারে অনেক আগে থেকেই ক্যামেরার প্রচলন ছিল।
১৯১০ সালে আমার কাকার ক্যামেরা ছিল। আলোকচিত্রের প্রতি আমার আগ্রহ দেখে ১৯৪১ সালে আমার এক মামা, কলকাতা থেকে একটি ‘বেবি ব্রাউনি’ ক্যামেরা এনে আমাকে উপহার দেন। এ ক্যামেরা দিয়েই আমার হাতেখড়ি। ক্যামেরার সাথে দেয়া ম্যানুয়াল পড়ে, টেবিলের চারপাশে কাঁথা এবং হারিকেনে লাল সেলোফেন মুড়িয়ে, নদীর পানিতে ধুয়ে এ সময়ে ছবি ‘ডেভোলাপ’ ও ‘প্রিন্ট’ করতাম। আমার এক বন্ধুর মামা মানিকগঞ্জেরই নবগ্রামের বাসিন্দা, তৎকালীন ভারতের খ্যাতনামা আলোকচিত্রী হিমাংশু রায়ের কাছ থেকেও এ সময় অনেক ধারণা ও দিগ্নির্দেশনা পাই।
ম্যাট্রিকুশেন শেষে ১৯৪৩ সালে আমি ‘কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ’ এ ভর্তি হই। এ সময় জয়নাল আবেদীন, কামরুল হাসানসহ অনেক শিল্পীর সাথে আমার পরিচয় ও হৃদ্যতা হয়। তাঁদের সাহচার্যে আমার শিল্পবোধ ও শিল্পমনন সমৃদ্ধ হয়। ৪৩-এর মন্বন্তরের ছবি আঁকার সময় শিল্পী জয়নাল আবেদীন এর সাথে আমি কলকাতার অলিগলি রাজপথ ঘুরেছি - মন্বন্তরের ছবি তুলেছি। ইসলামিয়া কলেজের পাশে, ধর্মতলা মোড়ে এক স্টুডিও থেকে দুর্ভিক্ষের ছবি প্রিন্ট নেওয়ার সময় সে সময়ের বিখ্যাত আলোকচিত্রী সুনীল জানা, আমার ছবির ভূয়ষী প্রশংসা করেন।
১৯৪৭-এ দেশবিভাগ ও দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে, কলকাতা ছেড়ে নিজ গ্রাম পারিল-এ চলে আসি। এ সময় বেশ কয়েকবছর আমি গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশেষত নদীকেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতির ছবি তুলি। আমার অনুজ ড. নওয়াজেশ আহমেদও এ সময়ে আলোকচিত্র চর্চায় আমার সহযাত্রী হয়।
১৯৫১ সালে শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদীন এর মাধ্যমে ঢাকায় ‘পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্ট’-এ ‘আর্টিস্ট’ হিসেবে চাকুরি শুরু করি। আলোকচিত্রী আমানুল হক, যিনি এ অঞ্চলে শৈল্পিক আলোকচিত্র চর্চার পথিকৃৎ, তখন এখানে চাকুরি করতেন।
ছবি তোলার সুবাদে তাঁর সাথে আমার বিশেষ ঘনিষ্টতা ও বন্ধুত্ব হয়। আলোকচিত্রের শৈল্পিক অভিব্যক্তি বিষয়ে আমরা অনেক চিন্তা করতাম। দুজনে একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলেছি তৎকালিন ঢাকা, বুড়িগঙ্গা নদী ও এর আশেপাশে। ১৯৫৬ সালে ‘কলম্বো প্ল্যান’-এর আওতায় ‘সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার’ পড়ার জন্য শ্রীলংকা সরকারের বৃত্তি নিয়ে কলম্বো যাই। এসময় আমি ‘শ্রীলংকান আর্ট কাউন্সিল’-এ ফটোগ্রাফি বিষয়ে একটি কোর্স করি এবং আধুনিক ফটোগ্রাফি, ফটোগ্রাফির সম্ভাবনা ও বৃহৎ পরিমণ্ডল সম্পর্কে অবহিত হই।
জাতিসংঘ দিবসে Rural Life of East Pakistan শিরোনামে কলম্বোতে আমার আলোকচিত্রের বিশেষ প্রদর্শনীও হয়। 'Family of Man' প্রদর্শনীখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত আলোকচিত্রী এডওয়ার্ড স্টাইচেন প্রদর্শনী দেখে আমার ছবির বিশেষ প্রশংসা করেন। দেশে ফিরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওর্য়াদীর উৎসাহে কিছুদিন ‘পিআইডি’-তে চাকুরি করি। কিন্তু ‘পিআইডি’-এর আলোকচিত্রী হিসেবে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান তথা সরকারি কর্মকাণ্ডের ছবি তুলতে আমার ভাল লাগে নি। তাই ১৯৬১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,ময়মনসিংহে প্রধান আলোকচিত্রী হিসেবে চাকুরি শুরু করি।
এখানেই আমি সৃষ্টিশীল ছবি তোলার প্রকৃত সুযোগ পাই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-শোভিত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এর পাশদিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদ এর বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন সৌন্দর্য, নদীকেন্দ্রিক কর্মজীবী মানুষ, বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্য, গারোপাহাড়, বনাঞ্চল প্রভৃতির সাথে আমার ক্যামেরা নিয়ে মিশে যাই। অজস্র ছবি তুলি। শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদীন এর সাথে পূর্ণিমা-তিথিতে, বর্ষায় বা শরতে কাশফুলের মায়ায়, এ ব্রহ্মপুত্রের নীলজলে, নৌকায় বহুদিন বহুক্ষণ কাটিয়েছি। এর মাঝে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত চলে স্বাধিকার আন্দোলন।
ময়মনসিংহে এ আন্দোলনের অনেক ছবি আমি তুলেছি। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়, আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন ছবি তুলি। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়’, আমি আমার ক্যামেরা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ছবি তুলে বিভিন্ন কৌশলে, মাঝে মাঝে আমার এক শিল্পী বন্ধু শাহতাব-এর মামা তৎকালীন সাত নং সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহের-এর মাধ্যমে ভারতসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করে বিশ্বকে জানাতে চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম গণহত্যা আর নির্যাতিত নারীদের করুণ কাহিনী। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ছবিগুলো তুলেছি এ সময়।
মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল দিন গুলো এখনও আমাকে উদ্বেলিত করে। সে সময় যে ভয়াবহ দৃশ্য আমি দেখেছি, মনুষ্যত্বের যে অবমাননা আমি দেখেছি, যে বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, সে দুঃস্বপ্ন থেকে আমি আর বের হতে পারি নি। তাই মুক্তিযুদ্ধের অগণিত শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মুক্তিযুদ্ধের পর দাপ্তরিক কাজ ছাড়া আমি আর ছবি তুলি নি।
ছবি তোলার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই বাংলাদেশের সুন্দর পরিবেশ-প্রকৃতি, সবুজ মায়াময় অঞ্চল, এদেশের মানুষের সহজ সুন্দর সাবলীল জীবন-ধারা ও সংস্কৃতি - সবমিলিয়ে বাংলাদেশের রূপ আমাকে টেনেছে। আমি আমার মতো করে আমার বাংলার সেই রূপকে সুন্দর করে তুলে ধরতে চেয়েছি।
আমার ছবিতে কতগুলো বিষয়বস্তু আগে থেকেই বেছে নিয়েছি: বাংলার শিশু, বাংলার রাখাল, বাংলার কৃষক, বাংলার কুমোর, বাংলার ঘাট, বাংলার নারী, বাংলার নদী, নদী ও মানুষ, বাংলার পাহাড়ী অঞ্চল - গারো-হাজং-সাওঁতাল-চাকমা-মুরংদের জীবন-ধারা, সমস্ত মূলে বাংলা, কর্মজীবী মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ, আমার সুন্দর বাংলাদেশ, সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা,নদী মেখলা বাংলাদেশ।
শিল্প হলো একটা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ: 'Expression of an Emotion', সেটা মানুষের হতে পারে, প্রকৃতির হতে পারে। এ প্রকাশটা সাহিত্য, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র বা অন্য কোন মাধ্যমে ধরা যেতে পারে। ক্যামেরার মাধ্যমে যখন ধরা হয়, তখন হয় আলোকচিত্র। শিল্প-মাধ্যমের একটা ধারা হলো আলোকচিত্র।
আমি আলোকচিত্র করি, আমার ধারণা হলো, আলোকচিত্রের শিল্পমান অর্জন বা কোন বিষয় বস্তু শিল্পে প্রকাশ অনেক কঠিন। ধরুন পালতোলা নৌকার ছবি তুলবো, পেছনে মেঘ চাই। সেই পাল, আলো, কাক্সিক্ষত মেঘ, এগুলোর জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিন্তু এক্ষেত্রে চিত্রশিল্পীর সহজ পন্থা আছে, সুবিধাও আছে। তবে আলোকচিত্র কেবল ‘ডকুমেন্টেশন’ নয়।
ছবি তুললেই তো সব ছবি - ছবি হয় না। মন ও মননের সাথে সম্পর্ক করে আলোকচিত্রকে শিল্পমানে নিতে হবে। জন্মের পর থেকেই আলোকচিত্র বিভিন্ন ধারায় এগিয়েছে। আজকাল আলোকচিত্রে বিভিন্ন বিবর্তন এসেছে। ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ বা ভেঙ্গে ছবি তোলার প্রবণতাও আছে।
তবে এগুলো বুঝতে হলে, চোখ ও মনের প্রস্তুতি ও অনুশীলনের প্রয়োজন আছে। যেটা আমাদের গণ-মানুষের নেই। তাই সাধারণ মানুষের বোঝার জন্য আমি বাস্তববাদী বা ‘রিয়েলিস্টিক’ পথে গিয়েছি। আলোকচিত্রের যে বিষয়বস্তু, সেই বিষয়বস্তু থেকেই সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে চেয়েছি। আমাদের কর্মী বা শ্রমিক যখন কাজ করে, নিজস্ব ভঙ্গি ও গতিতে কাজ করে।
এর মাঝে একটা সৌন্দর্য আছে, তাই কৃষকের শ্রম, গুণটানা মাঝির কষ্টটা প্রকাশ করার জন্য আমি ‘রিয়েলিস্টিক’ ধারায় গিয়েছি। আমি মনে করি, মানুষের সাথে, জনগণের সাথে শিল্পের সম্পর্ক থাকতে হবে। আমি তাই শুধু ছবি তোলার জন্য ছবি তুলি নি। আমি তুলেছি গণ-মানুষের স্ফুলিঙ্গকে - হালবাওয়া কৃষকের ঘর্মাক্ত শরীর। শিল্পীকে মানুষের সাথে, গণ-মানুষের চিন্তা-চেতনার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হবে।
শিল্পের সাথে প্রকৃতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রকৃতি মানুষের হৃদয়কে খুব বড় করে দেয়। আমার সমস্ত কাজের মাঝে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য, প্রকৃতির যে কথা, প্রকৃতির যে ব্যথা, সেগুলোই দেখাতে চেষ্টা করেছি। তবে শিল্পের পথ হলো সত্যের পথ, সুন্দরের পথ, সাধনার পথ। শিল্পের পথেই প্রকৃত ‘বোধি’ অজর্ন করা যায়।
তাই মানুষ যদি শিল্পের মধ্যে দিয়ে না যায়, শিল্প যদি তার অনুভূতির মধ্যে না আসে সে মানুষের প্রকৃত রূপ পেতে পারে না। মানুষের হৃদয়ে যে কোমলতা বা প্রকৃতির জন্য মানুষ বা মানুষের জন্য মানুষ; এইসব চিন্তাভাবনা যেগুলো আছে, সব মিলিয়ে যে একটা ছবি বা শিল্পময় জগত তৈরি করা যায়, আমি সেই শিল্পময় জগতের খোঁজে এতদিন ঘুরে বেড়িয়েছি। শিল্পের কিছু একটা অংশ, আলোকচিত্রে ধরে, মানুষকে শোনাতে চেয়েছি প্রকৃতির গান, দেখাতে চেয়েছি প্রকৃতির ভাব। এই নিয়েই আমার শিল্প-জগতের ভাবনা। আমি এতে উত্তীর্ণ হতে পেরেছি কী না জানি না।
জয় হোক প্রকৃতির , জয় হোক মানুষের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।