_________________সেলাই গাছের কারখানা _______________________________________
মোস্তাক আহমাদ দীন
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব-প্রতি সন্ধ্যায়
কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে-আমি চুপ করে বসে থাকি-অন্ধকারে
নীল ফানুস উড়িয়ে দেয় কারা, সারারাত বাজি পোড়ায়
হৈ-হল্লা-তারপর হঠাৎ
সব মোমবাতি ভোজবাজির মতো নিবে যায় একসঙ্গে-উৎসবের দিন
হাওয়ার মতো অন্যদিকে ছুটে যায়, বাঁশির শব্দ
আর কানে আসে না-তখন জল দেখলেই লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার
মনে হয়-জলের ভেতর-শরীর ডুবিয়ে
মুখ উঁচু করে নিঃশ্বাস নিই সারাক্ষণ-ভালো লআগে না সুপর্ণা, আমি
মানুষের মতো না, আলো না, স্বপ্ন না-পায়ের পাতা
আমার চওড়া হয়ে আসছে ক্রমশ-ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শুনলেই
বুক কাঁপে তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি, ঘড়ির কাঁটা
আঙুল দিয়ে এগিয়ে দিই প্রতিদিন-অমার ভালো লাগে না-শীতকাল
কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাসে ঘুমিয়ে থাকব
একবার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেইে মেঘ ঝুঁকে থাকতে দেখেছিলাম
জানলার কাছে-চারদিকে অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না সেদিন-সেইদিন
তোমার কথা মনে পড়তেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম- চুলে, দেশলাই জ্বালিয়ে
চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার-
এখন আমি মানুষের মতো না-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
হঠাৎ এখন লাফ দিতে ইচ্ছে করে আমার-ভালবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস
আর মাথা নিচু করে বসে থাকতে ভাল লাগে না-আমি
মানুষের পায়ের শব্দ শুনলেই
তড়বড়ে নিঃশ্বাস ফেলি এখন-যেদিক দিয়ে আসি, সে-দিকেই দৌড় দিই
কেন এই দৌড়ে যাওয়া? আমার ভালো লাগে না
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব
হেমন্তে বিষণ্ণ ভাস্কর
কে যে পরিচয় করে দিয়েছিলেন জানি না, হঠাৎই, ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে, কোলকাতা বইমেলায় নয়া উদ্যোগ-এর স্টলে দেখা হয়ে গেল আমার। অত্যন্ত এলোমেলোভাবে ঘুরতে-ঘুরতে মনে হচ্ছিল, পছন্দের/অপছন্দের কত লেখকই তো ঘুরছেন এই মেলায়, যাদের অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই; তার প্রধান কারণ অস্বতঃস্ফূর্ততা/অপ্রতিভতা, অন্য কারণ মেলার বিশালত্ব; তার চেয়ে এই অনুভবটাই বা খারাপ কী-প্রতিক্ষণের স্টল-এর সামনে গিয়ে মনে হচ্ছে, কোথাও না-কোথাও নিশ্চয় বসে বা দাঁড়িয়ে দেবেশ রায় কি অরুণ সেনের সঙ্গে নিচু কণ্ঠে কথা বলছেন শঙ্খ ঘোষ, আবার, কথা বলতে-বলতে কখনো-কখনো থেমে-পড়াও অবাস্তব নয়, কারণ ঘরে ফিরে গিয়ে তাঁর মনে হবে ‘বড়ো বেশি কথা বলা হলো’, বা, কোনো তরুণ কবি কবিতা-বিষয়ে পরামর্শ চাইতে এলে, তাকে মধুরভাবে-হতাশ-করে-দিয়ে বলবেন, সে যেন কবিতা-বিষয়ে কোনোদিন কারও পরামর্শ না-নেয়। এই প্রকার স্বগত ভাবনার মাঝে, কয়েক দিনে, মৃদু দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে যে ক-জনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তার মধ্যে অন্যতম হলেন ভাস্কর, ভাস্কর চক্রবর্তী।
নয়া উদ্যোগের স্টলের ভিতরে বাংলাদেশী বইয়ের সংগ্রহ দেখছিলেন ভাস্কর, পরনে জিন্সের নীলরঙ পাঞ্জাবি; আমিও একটু বিশেষভাবে দেখতে চাইছিলাম ওখানে বাংলাদেশের কী কী বই যায়, কার কার বইয়ের প্রতি ওখানকার পাঠকের আগ্রহ- এইসব। কিছুক্ষণ পর বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দেখি, তিনি তখনো ভিতরে, এবং সম্ভবত এই সময়ই, বা এরও কিছু আগে কেউ একজন তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করে থাকবেন, হতে পারে, নবযুগ-এর অশোক রায় নন্দী, বা নয়া উদ্যোগের পার্থশঙ্কর বসু; আর, আমাদের পরিচয় হয়ে গেল।
তিনি বাইরে এলে-আমরা যখন বিলকুল মুখোমুখি-দেখি, তিনি সব দিক দিয়েই আমার চেয়ে বড় আর লম্বা, আর অতিঅবশ্যই সুপুরুষ; শুধু আমাদের মধ্যে একটা সাদৃশ্য বর্তমান : তাঁর পরনের পাঞ্জাবিটির মতো গাঢ় নীল রঙের আমারও একটি পাঞ্জাবি আছে, প্রেম-বিষাদ-ব্যর্থতা আছে। ছেঁড়া-ভাঙা কথা বলতে-বলতে, স্টলের সামনেকার ভিড়ভাট্টা ছেড়ে, নির্মেঘ আকাশের নিচে এসে দাঁড়াতেই দেখি, তার ঘাড়-মাথার পেছনজুড়ে রাতের নির্জন কালো আকাশ. আর কোনো-কোনো স্টলের বাতিগুলিকে মনে হচ্ছিল তারই নক্ষত্র-এমন ব্যাকগ্রাউন্ড পেয়ে গেলেই বোধ হয় একজন আলোকচিত্রী নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন, তার অস্বস্তি শুরু হয়, হাত নিশপিশ করে; কিন্তু আমার মনে পড়ছিল তাঁর বহুখ্যাত সেই পঙ্ক্তিত্রয় :
শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব-প্রতি সন্ধ্যায়
কে যেন ইয়ার্কি করে ব্যাঙের রক্ত
ঢুকিয়ে দেয় আমার শরীরে-আমি চুপ করে বসে থাকি-অন্ধকারে
কিন্তু সুন্দর সুঠাম শরীরের ভাস্করকে দেখে মোটেও মনে হয়নি, কেউ ইয়ার্কি করে তাতে ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে তাকত রাখে, আর সেই শরীর কখনো দীর্ঘ তিনমাসের শীতনিদ্রায় চলে-যাওয়ার জন্যে আকুলতা প্রকাশ করেছে। শুধু, টাক-পড়া মাথা দেখে সেই চারটি পঙ্ক্তি বিশেষভাবে মনে পড়ার কারণ ছিল :
চারদিকে অন্ধকার
নিজের হাতের নখও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না সেদিন-সেইদিন
তোমার কথা মনে পড়তেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম- চুলে, দেশলাই জ্বালিয়ে
চুল পোড়ার গন্ধে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আবার
তবে, ইতস্তত কথাবার্তায় ছবি-তোলার মতো অন্তরঙ্গতা তৈরি-হওয়ার পর, তুলতে গিয়ে অনভ্যাসে রিলে-বোতামে কিছু গণ্ডগোল করে-ফেলায়ই কি না জানি না তিনি হেসে ফেললেন, যে-হাসি বিষণ্ণন নয় মোটেও, এতে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ও ভালোবাসার আভাস, মনে হলো এখন চাইলেই আমার পক্ষে বলে ফেলা সম্ভব, ‘জানেন ভাস্করদা, এরকম একটি পাঞ্জাবি আছে আমারও’, কিন্তু তার বদলে, অপ্রতিভতার কারণে বললাম ‘এখন লিখছেন কেমন ভাস্করদা?’
কিন্তু এই প্রশ্নটাই যে অন্তরঙ্গ পরিবেশটাকে এমন গুমোট করে তুলবে, কে জানত; অনেক দিন মনমতো লিখতে-না-পারার যন্ত্রণা/হতাশা-র কথা বলে, নিজের ভেতর ডুবে গেলেন যেন; আজ মনে হচ্ছে, এই অনন্ত নির্বেদই বোধ হয় ছিল তাঁর লোকান্তরের প্রকৃত কারণ, এর বীজাণুর জন্যেই বুঝি তাঁর কবিতার জগৎ এত বিষণ্ণ আর রক্তক্ষরিত-যে-কবিতাগুলিকে, প্রকৃত প্রস্তাবে বলা উচিৎ, ভয়াবহ অর্থহীনতার কবিতা। এই সূত্রে ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ কবিতাটি যখন পড়ব, দেখব-সুপর্ণার সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া আছে তাঁর, জলে-লাফ-দেওয়ার-মতো আত্মধ্বংসী ইচ্ছে থেকে বাঁচতে তিনমাস ঘুমিয়ে-থাকার জন্যে যে-শীতঋতুর প্রয়োজন, তার আসা না-আসার সঙ্গে গভীরতর একটা যোগ আছে সুপর্ণার, সরাসরি বললে-কবি এখানে যা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না-পুরো শীতকালটাই আটকে আছে সুপর্ণার জন্যে। চারদিকে উৎসব হয়, নীল ফানুস ওড়ে, হৈ-হল্লা হয়, আর ইয়ার্কি (শব্দটা সাতিশয় লক্ষযোগ্য) করে ব্যাঙের রক্ত ঢুকিয়ে-দেওয়া শরীর নিয়ে তার জলে লাফ দিতে ইচ্ছে করে-এই পরিপ্রেক্ষিতে কবিতাটির (পূর্ণ) অর্থহীনতার মধ্যে, অর্থময় প্রেমের দ্যোতকরূপে স্থাপনযোগ্য বাক্য আছে শুধু ‘ভালোবাসার কাছে, দীর্ঘ তিনমাস/আর মাথা নিচু করে বসে থাকতে ভালো লাগে না’, তখন এতে যে-কারো মনে হতে পারে, ভালোবাসার মধ্যে ভালোবাসাহীনতার কবিতাও সেটি, এখানে শীতকাল-টীতকাল বলার মধ্য দিয়ে সুপর্ণাকে পাওয়ার আকুলতা যেমন আছে, তেমনই আছে ঘুমিয়ে-পড়ার-পলায়নের-অর্থ-কীর্তিহীন বিপন্নতাতাড়িত বেদনাও; মনে হবে, কবিতায় সুপর্ণামুখিতা যতটা আছে, আত্মমুখিতাও কোনো অংশে কম নয়।
এই কবিতাটি শুধু ছাপাযোগ্য হলে, এখানে আবার না-ছাপালেও চলত, এ-নিয়ে দু-চার কথা বলারও কোনো প্রয়োজন ছিল না; আমাদের ধারণা এই কবিতাটির ছাপাযোগ্যতার সঙ্গে-সঙ্গে, অভাবিত এক ছাপযোগ্যতাও রয়েছে; একবার পড়বার পর কবিতাটির শিরোনাম, উত্তমপুরুষের একবচন, উদ্দিষ্টার নামোল্লেখ, ক্রিয়াপদের বাহুল্য, সর্বোপরি ভয়ঙ্কর হৃদয়-আবেগ-এই সব বৈশিষ্ট্য আজকের পাঠক/কবিদের কাছে অতিরিক্ত/হালক মনে-হওয়ার সম্ভাবনা আছে, এই সব (সংস্কার) কাটিয়ে উঠে, পড়তে পারলে, এই কবিতার অন্তর্নিহিত শক্তি টের পাওয়া যাবে। কবিতাটির যে-টুকু দুর্বলতা, আজকের পাঠকের চোখে পড়তে পারে, তা যে কবির লক্ষসামর্থ্যরে বাইরে ছিল, তা ভাবা ঠিক হবে না, একে বরং চিন্তা ও উপস্থাপনাগত ভিন্নতা বলে উল্লেখ করা যেতে পারে; কারণ এই সব ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব কিছু ভাবনা ছিল, যা এই প্রসঙ্গে বিবেচিত হতে পারে : এবং মুশায়েরা জানুয়ারি-মার্চ ১৯৯৮ সংখ্যায় তিনি জানিয়েছিলেন, যে-কোনো লাইন থেকে শুরু হতে পারে একটি কবিতা, আবার যে-কোন্ োলাইনেই শেষ হতে পারে; সেই কবিতা হবে আপাতসরল কিন্তু হাজারমুখো, তাতে বিষয়ের কোনো বাছবিছার থাকবে না; কবিতার একটি লাইন থেকে আরেকটি লাইনের দূরত্ব হবে কমপক্ষে একশো কিলোমিটার কিন্তু তার অদৃশ্য তলদেশে থাকবে মিলিমিটারের নিবিড় সম্পর্ক। আরো লিখেছিলেন, ‘গত ত্রিশ/পয়ত্রিশ বছরের বাংলা কবিতাকে এখনই কেন মনে হবে উনিশ শতকের? কেন মনে হবে, শুধুই প্রতিভার প্রদর্শনী? কোথায় গেল সেই তীব্রতা, সেই ভূতগ্রস্ততা?;’ এই প্রকার কবিতাভাবনার সঙ্গে পরিচয় থাকলে, এই কবিতাটির এলোমেলো পঙ্ক্তি-বিন্যাস, যতিচিহ্ন, বিশেষ করে ডেশ-এর সহযোগে দুই দিকের অনুভব ধরার মধ্য দিয়ে বিষয়-অনুষঙ্গকে বিশৃঙ্খল করার চেষ্টা, আবার অনেক ক্রিয়াপদ সত্ত্বেও কবিতার অস্থিরতা-ব্যঞ্জক গতি-এই সবকিছু যে- অর্থময় অর্থহীনতারই দ্যোতক, তা বোঝা সহজ হতে পারে।
লেখাটি শেষ করার আগে, শেষ অনুচ্ছেদে যে-অনুভবটুকু প্রকাশ না-করলে অসততা হবে, তা হলো : কবিতাটি যতবারই পড়েছি, মনে হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অনর্থপীড়িত উদ্বাস্তু দুঃখী প্রেমিকদের প্রতি একটি অলিখিত দুঃখপূর্ণ উৎসর্গপত্রও লিখে গেছেন ভাস্কর; ফলে, প্রেম-ব্যাপারটির মধ্যে অনর্থ-বোধক কোনো চিরকালীনতা যদি থেকে থাকে, তবে ধরে নিতে হবে এই কবিতাটিরও সেটা আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।