আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুজোর ফুল

www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
দেয়ালে ঝুলে থাকা এক টিকটিকির অকস্মাৎ দৌড়ে পালানো দেখে বেডসুইচ চেপে বাতি নিভিয়ে ঘুমোতে গেল রাহাত। আজ বেশ কষ্ট গিয়েছে নিজের উপর দিয়ে, ভাবলো সে। বাচ্চাদের সামলানো সত্যিই খুব ঝামেলার! অপু চুপচাপ থাকে, বড় হয়েছে বেশ। নিজের একটা জগত হয়েছে, বোঝা যায়। আবার অন্যকিছু নাতো? তাহলে দূরে দূরে থাকে কেন ওর থেকে? মনে পরলো, এইতো ক’বছর আগে, অফিস থেকে ফিরে আসতেই লাফিয়ে আসতো।

"বাবা, বাবা..."। অনেক চাওয়া, অনেক আবদার। হঠাৎ এমন হয়ে গেল কেন? ত্রপার ব্যাপারটা আবার একেবারেই আলাদা। তার কাছে কোনো কিছুই তো নতুন নয়। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছে সে।

বাবাকে সবসময় পেয়ে অভ্যাস। যত রাগ, অভিমান সব তার সাথেই। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, রাহাতের কথার কোনো মূল্য থাকে না ওর কাছে। যেন এক পোষা প্রাণী সে ওই বাচ্চা মেয়েটার কাছে। আবার যখন খেলা করে ওর সাথে, কথা বলে পুতুলের মতন, খুব ভাল লাগে রাহাতের।

এক নিমেষে কেটে যায় অনেক ক্লান্তি, ক্ষণিকের জন্য ভুলে যায় অস্থিরতা। খুব ইচ্ছে করে রাহাতের, যদি ত্রপা সবসময় অমনই থাকতো! বড় বড় উদাসীন মানুষগুলোর মতন না হতো! রাস্তায় কুকুরের ডাক। হালকা বাতাস। ঠাণ্ডা পরছে আস্তে আস্তে। জানালাটা হাতের কাছেই।

খুলে দিল রাহাত। গুমট ভাবটা একটু কাটুক। শুনতে পেল, দূরে, অন্য কুকুরগুলোও সাড়া দিচ্ছে। সাইকেলের শব্দ? নাহ্‌, একটা রিকশা। এত রাতে ফিরে যাচ্ছে ঘরে? সারাদিন খাটুনি।

হয়তো রোজগার তেমন হয়নি আজকে। এখন ফিরছে। কিন্তু কিসের জন্য? কার জন্য? একটু স্বস্তি। একটু শান্তি। আপনজনের কাছে? হয়ত অপেক্ষা করে আছে গিন্নি, ঘুমিয়ে পরেছে হয়ত ছেলেমেয়ে।

যেতেই হবে। একেবারেই চুপচাপ হয়ে পরছে এখন। পাশের ঘরের ঘড়ি জানান দিল মধ্যরাত। টুঁ শব্দটি নেই আশেপাশে। হঠাৎ ঘ্রাণশক্তি প্রখর হয়ে উঠ'ল রাহাতের।

উদগ্রভাবে। পাশের ঘরে তৃষা ঘুমাচ্ছে, অনুভব করতে চাইলো সে। সেই তৃষা। একদা রাহাতের মনজগতের ওই একটিই উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার নির্গলিত অপার বর্ণালোকের সুধায় সে খুঁজে পেতো এক ঐশ্বরিক সমৃদ্ধতা, পরিপূর্ণতা। যার সাহচর্যে সে খুঁজে পেতো তার মলিন, স্থবির আর জরাজীর্ণ জীবনের কিছু উপলক্ষ।

এখনো কি পায় না? কতদিন চাঁদের আলোয় বৃষ্টিস্নাত শহরের পিচঢালা পথে, কখনবা পূর্ণিমায় গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যেত দুজন। বহুদূর। পথগুলোকে কি মসৃণ আর মোলায়েম মনে হত রাহাতের। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন শুনতে পেতো বীণার ঝংকার! বাতাসে অনুভব করতো কি এক স্বর্গীয় সুগন্ধ! স্নায়ু শীতল করা শিরশিরে অনুভূতিগুলোয় মিশে থাকতো তৃপ্তি আর শঙ্কা! মনে আছে, ফিরে আসতে চাইত না তৃষা। মনে আছে, বলতো, “আমি তোমার হাত ধরে এভাবেই হেঁটে যেতে চাই, রাহাত।

অনন্তকাল। ” ত্রপা জন্ম নেবার কিছুদিন আগে, কোন এক আরোগ্যশালার জনৈক চিকিৎসকের করুণা ফোটানো মুখে রাহাতের সেই পা দুটো কেটে ফেলার বিনীত আদেশের অভিব্যক্তিতে এই তৃষা’ই তো ফিস্‌ফিসিয়ে বলেছিলো, “আমি আছি। আমি থাকব। ” এইতো পাশের ঘরেই তো আছে ও। এইতো অনেক কাছে।

ও থাকবে, এটাও জানে রাহাত। তবে কিসের এত যন্ত্রণা! কাকে দোষ দেবে রাহাত? প্রতিদিন প্রত্যূষে আর সন্ধ্যালগ্নে, অফিসে যাওয়ার আগে আর অফিস থেকে ফিরেই যে ও দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দূর হতে রাহাতকে দেখে, সেটা রাহাত বিছানায় শুয়ে ঠিকই টের পায়। ওর হাতের কাছের টেবিলটায় প্রয়োজনীয় সব ওষুধ-পত্র তো ঠিকই প্রয়োজন অনুযায়ী বদলাচ্ছে, প্রতিনিয়ত অন্ন আসছে যাচ্ছে, নোংরা হচ্ছে না তার সীমিত পরিসীমার এই জায়গাটা, মাসে দুইবার করে আসছে চুল কাটার লোক। ঘর ভর্তি সব জরুরী জিনিসগুলোকে উচুঁতে না রেখে রাহাতের হাতের নাগালের মধ্যেই নিয়ে আসা হয়েছে। সব আসবাবপত্রগুলোকে রাহাতের কথা মাথায় রেখে ত্রুটিমুক্তভাবেই তো সাজানো হয়েছে।

কিসের অপ্রাপ্তি? কাকে দোষ দেবে রাহাত? স্বামী ভঙ্গুর হয়ে পরার পর সব দায়িত্ব তো নিজের ঘাড়েই নিয়েছে তৃষা। কত কাজ! কত মিটিং! কত অফিসিয়াল ট্যুর! ক্লায়েন্টের সাথে সমঝোতা! অনেক কাজ করে তৃষা। প্রায়ই যেতে হয় দেশের বাইরে! কাটাতে হয় বেশ কিছুদিন! বেশ কিছু রাত! বেশ উন্নতি করছে ও – জানে রাহাত। উন্নতি! বাচ্চাদের নিয়ে আর কোন চিন্তা নেই। ওদের ভবিষ্যত নিশ্চিত করছে তৃষা।

রাহাতের যত্নেরও কোন ঘাটতি নেই। সাক্ষাৎ দেবী! অন্নপূর্ণা! তাহলে তথাকথিত সড়ক দুর্ঘটনায় পা’দুটো হারানোর পর অকারণেই কেন দিনে দিনে জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে পরছে রাহাত? অকারণে! সেই উদ্যম আর যেন নেই। নিস্তেজ হয়ে পরছে। হয়ে পরছে নিষ্প্রাণ। হ্যাঁ, পঙ্গু সে।

অক্ষম সে। শুধু দুটো হাতই এই জগতের জন্য যথোপযুক্ত নয়। বুক ফুলিয়ে চলার জন্য যথেষ্ট নয়। টিকে থাকার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই দরকার পরে সঙ্গিনীর।

দরকার পরে সাহায্যকারীর। দরকার পরে করুণার। রাহাত সব জানে। সব দায়িত্ব তাই নিজের ওপরই নিয়েছে তৃষা। নিতে হয়েছে।

রাহাত সেটাও জানে। তবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাহাত। এত বেশী করুণা কি না হলেও চলতো না, তৃষা! ঠাণ্ডাটা বেশ প্রখর হচ্ছে এখন। জানালার গরাদ দিয়ে শিরশিরে কাঁপুনি তোলা বাতাসগুলো ঢুকে পরছে। জানালাটা খোলাই রাখে রাহাত।

অন্তত আকাঙ্ক্ষিত কিছুর অনুপ্রবেশ না হয় হোক এই শূন্য ঘরে। শূন্য ঘর? নাহ্‌। শূন্য কোথায়? ওইতো ওর ছোট্ট রিডিং টেবিলটা – হালকা ধূলো জমেছে ওটার ওপর। খাটের পাশেই নিঃশব্দে অপেক্ষমাণ ওর নিত্যদিনের সঙ্গী হুইলচেয়ারটি – চক্‌চক্‌ করছে ওটার হাতলখানি। রিডিং টেবিলটার পাশেই ওর পরিপাটি আলনা।

কাপড় রাখার আলমারিটাও বেশ সাজানো গোছানোই হবে, জানে রাহাত। সব দিকেই নজর থাকে তৃষার। আর মেঝের ওপর পরে থাকা এলোমেলো বইয়ের স্তুপগুলোর কথাও নিশ্চয়ই ভোলেনি তৃষা। দেয়ালজুড়ে দাঁড়ানো এক শূন্য আলমারির অস্তিত্ব সত্ত্বেও বইগুলোকে ওভাবেই রাখতে পছন্দ করে রাহাত। তৃষাও জানে সেটা।

তাই ঘরের অন্যান্য জিনিসপত্র যথাসময়ে যথাযথভাবে পরিষ্কার হলেও এলোমেলো বইগুলি ওভাবেই পরে থাকে নিরন্তর। অলীক স্বাধীনতা! টিক্‌টিক্‌ শব্দে টিকটিকিটা জানান দিলো ঘরের কোথাও ওটার অবস্থান। মৃদু হাসি রাহাতের মুখে। এই ঘরে ঐ একটা টিকটিকিই ওকে নিত্যদিন সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। টিক্‌টিক্‌! টিক্‌টিক্‌! টিক্‌টিক্‌! অন্ধকার ঘরের দিকে তাকিয়ে বিনম্র কৃতজ্ঞতা জানালো ওটার দিকে রাহাত।

সে অকৃতজ্ঞ নয়। না। সে অকৃতজ্ঞ নয়। পঙ্গু হওয়ার পর কিছুদিন তো সে বুঝতেই পারে নি যে সে পঙ্গু! বুঝতে দেয়নি তৃষা। সেই অনুদান মনে আছে রাহাতের।

কি করে ভোলা যায় সে কথা! সে আত্মত্যাগ! আর আজ? হঠাৎ ককিয়ে উঠে রাহাত। বুকে চিন্‌চিন্‌ ব্যথা। জ্বালা করছে। আজ তো সে আরও পঙ্গু! কাতর গলায় কে যেন বলে উঠে – কই, তখন তো এত করুণা দেখিনি তোমার মাঝে! ভালোবাসার চেয়ে করুণাই তোমার কাছে এখন বেশী প্রাধান্য পায়, তৃষা! কেন? আমি পঙ্গু বলে! আমি অক্ষম বলে! দূরে কোথাও রাতের ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। নীরবতা ছিন্ন করে ধেয়ে যাচ্ছে।

খটাখট্‌। খটাখট্‌। সম্বিত ফিরে পায় রাহাত। শেষরাতের ট্রেন। গন্তব্য বেশী দূরে নয়।

হ্যাঁ, একটু পরেই সূর্যদেব নিয়ে আসবে নতুন দিনের বারতা। নতুন আশা। আর একটু পরেই জেগে উঠবে তৃষা, জানে রাহাত। শেষরাতেই জেগে উঠে ও। তবে ঘুম থেকে উঠেই ওর দরজার চৌকাঠে আসে না সে।

পরিচ্ছন্ন হয়ে আসে। স্নান করে আসে। আসে ধীরলয়ে। খালি পায়ে। তবে রাহাত ঠিকই শুনতে পায় সেই পদধ্বনি।

নিঃশব্দ সেই চিরচেনা ধ্বনি এসে স্থির হয় চৌকাঠের ঠিক ওপাশটায়। সূক্ষ্ম প্রতিবন্ধকতা! যেন এক প্রাচীর! সূক্ষ্ম, কিন্তু অনতিক্রম্য। আর রাহাত যেন এক নিষ্পাপ পুজোর ফুল। নিজের ভেতরের ঐ কামিনী-দেবতার লিপ্সা নিবৃত করতে ঐ পুজোর ফুলের যে দরকার বড়! মৃদু হাসে রাহাত। সে জানে।

তাই এক অভূতপূর্ব পুজো শেষে ঐ অন্ধকার চৌকাঠের ওপাশে দাঁড়ানো এক অনুতপ্ত হৃদয়কে সে ক্ষমা করে দিতে চায়। তবে সেই বা ক্ষমা করার কে! ঐ অনুতপ্ত হৃদয় তো অন্য কারও কাছে ক্ষমা চাচ্ছে না হে পঙ্গু পুজোর ফুল! আবার বুক ধড়ফড়! রাহাত! এই অবুঝ মন কেন বুঝিস না! কেন বুঝিস না তোর সীমাবদ্ধতা! কেন বুঝিস না তোর জানালার ফাঁক দিয়ে সচরাচর দেখা এক বিলাশবহুল লাল লেক্সাসের ষ্টিয়ারিং এ হাত রাখা এক ফর্সা হাতের যোগ্যতা তোর থেকেও বেশী – যে হাত প্রত্যহ ড্রপ করে এক সতী-সাধ্বী, নিষ্পাপ হৃদয়কে! হ্যাঁ, অনেক রাত কাটাতে হয়! অনেক কথা কানে আসে! ওগুলো সব শকুনের দল! কত কাজ! কত মিটিং! কত অফিসিয়াল ট্যুর! তবু ঐ হৃদয় নিষ্পাপ – এটাই বুঝতে চায় রাহাত! ঐ হৃদয়ই রাহাতের মনজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার নির্গলিত অপার বর্ণালোকের সুধায় সে এখনও খুঁজে পায় এক ঐশ্বরিক সমৃদ্ধতা, পরিপূর্ণতা। যার অবর্তমানে সে এখনও খুঁজে পায় তার মলিন, স্থবির আর জরাজীর্ণ জীবনের কিছু উপলক্ষ। নিষ্পাপ হৃদয়! প্রত্যহ প্রত্যূষে তোর চৌকাঠের ওপাশে দাঁড়িয়ে যে হৃদয় করে এক নিখাদ স্বীকারোক্তি। গায় এক অনুতাপ-গীত।

করে গঙ্গা-অবগাহন। তবুও .... তবুও এ কেমন অস্থিরতা! এ কেমন ঈর্ষা! এ কেমন কুঁড়ে-কুঁড়ে খাওয়া মন! এ যে ভয়ংকর! রাতজাগা এক অস্থির-মনের কোন এক শান্ত-সুস্থির অংশ হঠাৎ পুনরাবৃত্তি করে। বলে উঠে, ‘না রাহাত! এই জগত চলমান। চলছে। আর এর মধ্যেই যত বৈপরীত্যের খেলা।

তোর জন্য উপদেশ এই যে তুই এর বিরোধিতা করবি না। প্রতিরোধ করবি না। তাহলেই ব্যথা পাবি। কষ্ট পাবি। আঘাত পাবি।

দুঃখ পাবি। তুই এটার সাথেই চলবি। শক্তির এই ছন্দোবদ্ধ প্রবাহের সাথে সাথেই তুই চলবি। ’ এখন সূর্য উঠছে। রাহাত ব্যথা ভুলে যায়।

তৈরি হয়। সে যে এক পুজোর ফুল!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।