মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
কাপুরুষ! ভীরু মেষশাবক! দাঁড়িয়ে দেখছ কি? এখনো দাঁড়িয়ে আছো নির্বাক অচল কাঠের পুতুলের মত? লজ্জা কি নেই তোমাদের, ভুলে গেছো কি রানী ঝিন্দনের নির্বাসন? পাঞ্ঝাবের দাসত্ব? শ্রীমন্তের প্রতি নানা সাহেবের অবিচার? ভেলোরের রক্তপাত? রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের অশ্রুমোচন? অযোধ্যার অপমান? প্রতাপের রক্ত! শিবাজীর রক্ত! ভোলেনি ভারত_ভোলেনি সে কথা। ওঠো, জাগো। জাগো হে বীর। ঋণ শোধের দিন আজ —মঙ্গল পান্ডে।
পলাশী। একটা মাঠের নাম। মস্ত বড় সে মাঠ। আঁকাবাঁকা গঙ্গার তীরে অবস্থিত। এই মাঠের তিন দিক জ়ুড়ে দেড় হাজার বিঘার জমির ঊপর রয়েছে এক আমবাগান।
এর পূর্ব নাম ছিল লক্ষবাগ। ওই খানে লক্ষ লক্ষ আমগাছ ছিল বলে কালক্রমে তার নাম হয়ে দাঁড়ায় আম্রকানন। অর্থাৎ পলাশীর আম্রকানন। যেখানে বসে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আবাহমান বাংলার স্বাধীনতাকে কেড়ে নেয়া হয়ে ছিল।
শুরু হল ইংরেজ শাসন।
শাসন না বলে, বলা উচিত_শোষণ, ত্রাস, নিপিড়ন ও নির্যাতন। চলতে থাকে বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। এভাবে পুরো এক শতাব্দী।
বাংলার মানুষকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে শোষণ করার জন্য ইংরেজরা নানাধরনের পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে থাকে।
এজন্য ইংরেজ প্রথমে তার দালাল গোষ্ঠী তৈরী করে নেয়। এরা ছিল বেশির ভাগই সুবিধাবাদী। দালালদের নানাবিদ সুযোগ সুবিধা দিয়ে গোটা ভারতবাসীকে শাসন-শোষণ করার ভিত্তি পাকাপোক্ত করে নেয়।
তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীজ বপন করে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ভেঙ্গে দেয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে কেরানী বানানোর জন্য, পা চাটা কুকুর বানানোর জন্য শিক্ষানীতিসহ বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়ন করতে থাকে।
যার করালগ্রাস থেকে আজও আমরা মুক্ত নই। বাংলার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য ইংরেজ তার স্বার্থের অর্থনৈতিক ও উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করে। এক পর্যায়ে কৃষকদেরকে ধান, পাট ও সব্জির পরিবর্তে নীলচাষ করতে বাধ্য হয়। কোনো কৃষক নীলচাষ করতে অবাধ্য হলে তার স্ত্রী-কন্যাকে ধরে নিয়ে ওরা নিপীড়ন, নির্যাত ও ধর্ষণ করে মৃত্যুমুখে ছেড়ে দিত। আর যার স্ত্রী-কন্যা থাকতো না, তাকে অথবা তার ছেলেকে ধরে হাতের আঙ্গুল কেঁটে দিত।
এ রকম শত শত পাশবিক, লোমহর্ষক, নৃশংস, জঘন্য কর্মকাণ্ড ওরা নিরীহ বাংলীর উপর চালিয়েছে। বাঙ্গালীরা যে একশ বছরে কোনো প্রতিবাদ করেনি, বিষয়টি এমন নয়। অসংখ্য করেছে। তার মধ্যে সন্নাস বিদ্রোহ, পিন্ডারী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, ওহাবী আন্দোলন, শাওতাল বিদ্রোহ ইত্যদি। তবে এ সমস্ত বিদ্রোহের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ছিল অসংগঠিত।
গণভিত্তি সম্পন্ন নয়। । কিন্তু তাই বলে এর প্রভাব ও গুরুত্ব কম তা নয়, বরং এর ধারাবাহিকতায় সিপাহী বিদ্রোহ।
১৮৫৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল। এই রাইফেল ভারতীয় সিপাহীদের হাতে তুলে দেয় ব্রিটিশ সরকার।
রাইফেল গুলোর কার্তুজ গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরী হতো। সৈন্যরা তাদের রাইফেলের কার্তুজ লোড করার সময় তা দাঁত দিয়ে খুলে লাগাতে হতো। গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেয়া হিন্দু-মুসলিম সৈন্যদের জন্য অধার্মিক ও গর্হিত কাজ। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে সিপাহীরা(ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য) নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। নতুন কার্তুজ প্রতিস্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটিশ।
কিন্তু সিপাহীদের কাছে এই প্রতিশ্রুতির কোনো মানে দাড়াল না।
এ আগ্নেও অস্ত্র তুলে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ শোসকগোষ্ঠীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। সম্মুখীন হতে হয়েছিল সিপাহী বিপ্লবের। আর এই বিপ্লবের শুরুটা করেছিল মঙ্গল পান্ডে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম নক্ষত্র হল মঙ্গল পান্ডে।
তাঁর জন্ম ১৮২৭ সালের ১৯ জুলাই। উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলায় নাগওয়া গ্রামে। অনেকের মতে তাঁর জন্ম হয়েছিল ফৈজাবাদ জেলার সুরহুর গ্রামে। ব্রাম্মণ পরিবারে। দিবাকর পান্ডের ঘরে।
মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীতে সেপাই পদে যুক্ত হন।
ব্যারাকপুর। কলকাতার একটি অঞ্চল। ব্যারাকপুরের পঞ্চম ব্যাটিলিয়ানের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন মঙ্গল পান্ডে। ১৮৫৭ সাল।
ইংরেজকে সরাসরি প্রতিরোধের বছর। যাকে আমরা বলি সিপাহী বিদ্রোহ বা যুদ্ধ। বামপন্থীরা একে সিপাহী বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেন। কেউ কেউ মহাবিদ্রোহ বলে থাকেন। মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭ কে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন রূপে গণ্য করা হয়।
ইংরাজ ঐতিহাসিকরা একে সিপাহি বিদ্রোহ বলেছেন। ইংরেজ সেনাবাহিনীর অন্তর্গত ভারতীয় সিপাহীরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে মূল ভূমিকা পালন করেন। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়। কত লাঞ্ছনা! কত অত্যাচার! কত অশ্রুমোচন! কত নির্যাতন! দীর্ঘ একশত বছর পর অনন্তকাল সমুদ্রের বুকে একটা সাইক্লোন! এটাকে অনেকে আবেগের সাথে পলাশীর প্রতিশোধও বলে থাকেন। মাকে শান্ত করে দিল এই সাইক্লোন।
মায়ের সন্তানরা সজীব হয়ে উঠল। ফিরে পেল আস্থা। নেমে পড়লো দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য। Your English tyrants are few in number, murder them! ধ্বংস কর অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গদের। বজ্রগর্ভ এই সঙ্কেত পৌছে গেল জনে জনে, নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে।
উঠ! ভারতবাসী জাগো! হিসেব নিকেশের দিন এলো। একশ বছরের নির্যাতনে জর্জরিত মুমুর্ষু মা মুক্তির বেদনায় কাঁদছে।
“দিনটি ছিল ২৯ শে মার্চ, ১৮৫৭। রোববার অপরাহ্ন। ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে অসময়ে মানুষদের ভিড় বাড়ছে।
৩৪ নং ইনফ্যানট্টির সিপাহীরা আজ দলে দলে জটলা বাধছে। চাঁপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে চার দিকে। সিপাহীদের মধ্যে কেউ এসেছে খালি হাতে, কেউ এসেছে বন্দুক নিয়ে। সৈনিকদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। আজ রচিত হবে এক মহান ইতিহাস।
মঙ্গল পান্ডে সমস্ত সৈনিকদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ডাকেন ও সেখান থেকে সিপাহী বিদ্রোহের ডাক দেন। তাঁর উচ্চ পদাধিকারী তাঁকে আক্রমণ করলে তিনি তলোয়ার দিয়ে ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দেন।
লাইন থেকে পঞ্চাশ কিংবা ষাট হাত দূরে মঙ্গল পান্ডে। বন্দুক কাঁধে নিয়ে টহল দিচ্ছেন। সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে কানাকানি।
লোকটা কি পাগল হল! কিসের জন্যে তাঁর পাগলামী? সে আজ কি করতে যাচ্ছে। এর ফলাফল বা পরিণাম কি হবে, তারা জানে না। সবাই শুধু গভীর আগ্রহে তাঁর দিকে তাকাচ্ছে। ছয় ফুট দীর্ঘ দেহ। ধীর স্থির প্রকৃতির।
নিজের স্বভাবের গুণে সকলের কাছে দারুণ জনপ্রিয় পান্ডেকে কে না চেনে। সেই প্রতিদিনের পরিচিত মঙ্গল পান্ডে কি আজ এক নতুন মূর্তি নিয়ে দেখা দিয়েছেন। -------------
এ যেন পান্ডের এক নতুন ছবি। কে জানে, তাকে কোন দেবতা ভর করেছে। ঊদ্ধৃত চিবুক আকাশের দিক তুলে, গুলিভরা বন্দুক হাতে সামনে পিছনে পায়েচারি করছে।
হঠাৎ তীক্ষ্ম চিৎকার। বেরিয়ে এসো ভাইসব। ফিরিঙ্গীর পায়ের তলায় আর কত দিন থাকবে! ওরা আমাদের সোনার দেশ, গর্বের মাতৃভূমি লুটেপুটে যাচ্ছে। আর আমরা মরছি অনাহারে। ওরা আমাদের বেঁচে থাকার অস্তিত্বে হাত দিয়েছে।
আমাদের করেছে জাতিভ্রষ্ট। ভাইসব এসব ফিরিঙ্গীদের মারো। ---------------- কি অদ্ভুদ এই উম্মাদনা! কি এর নাম! মূর্খ সেপাই কি তা কি জানে! এর নাম দেশপ্রেম। মাতৃভূমি রক্ষার উম্মাদনা। --------------পান্ডেকে শায়েস্তা করার জন্য লেফটেন্যান্ট আসল।
কিন্তু পান্ডে স্থির ও অবিচল। বন্দুকের নল লেফটেন্যান্টের দিকে সোজা তাক করে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে পান্ডে। লেফটেন্যান্টের ঘোড়াটি সরাসরি পান্ডের গায়ের উপর চড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে পান্ডে গুলি চালাল। ঘোড়াটি মাঠে লুটিয়ে পড়ল।
লেফটেন্যান্ট পান্ডেকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। কিন্তু ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। পান্ডে একটু এগিয়ে গিয়ে তলোয়ার দিয়ে লেফটেন্যান্ট বগকে সলিল সমাধি ঘটাল”। ------এই অংশটি সত্যেন সেনের মহাবিদ্রোহের কাহিনী থেকে নেয়া।
লেফটেন্যান্টের পরে এসেছিল সার্জেন্ট।
সার্জেন্ট পান্ডের তলোয়ারের কাছে ধরাশয়ী হল। তার পর আসল পল্টু। সে ইংরেজদের দালাল। মঙ্গল পান্ডেকে পিছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। পল্টুও রক্ষা পেলনা পান্ডের ধারালো তরবারীর কাছে।
নিজেকে মুক্ত করল পান্ডে। সবাই উত্তেজিত। সিপাহীদের মধ্যে উল্লাস ধ্বনি। শেষ বিকেলে বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে সেনাপতি হিয়ার্সে চলে আসল সেনা ক্যাম্পে। ততক্ষণে মঙ্গল পান্ডে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
তারপরও তিনি ব্রিটিশদের হাতে মরবেন না বলে মনে মনে সিদান্ত গ্রহণ করেন। হঠাৎ পান্ডের পিস্তল গর্জে ওঠে। অভিমানী সৈনিক! আত্মহত্যা করার চেষ্ঠা করে। নিজের মাথায় ঠেকিয়ে দেয় পিস্তল। গুলি ফসকে গেল।
ধোঁয়া, বারুদ ও অগ্নিশিখার মধ্যে আহত রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়লো। ধরে ফেলল পান্ডেকে। তাঁকে চিকিৎসা করল ব্রিটিশ। উদ্দেশ্য সুস্থ্য করে নির্মম শাস্তি দেয়া।
৬ এপ্রিল সেপাই মঙ্গল পান্ডের বিচার।
বিচারের নাক প্রহসন মাত্র। দন্ডাদেশঃ ফাঁসি। মঙ্গল পান্ডে তখনো অসুস্থ। হাসপালে শুয়ে আছে। ক্ষত স্থানগুলো ফুলে ওঠেছে।
বাঁচার আশা নেই বললেই চলে।
৮ এপ্রিল সকাল বেলা। অসুস্থ মুমুর্ষু সৈনিক মঙ্গল পান্ডেকে বারাকপুরে সমস্ত সৈনিকদের সামনে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দন্ডাদেশ কার্যকর করে ইংরেজ। ওই দিন ঈশ্বর পান্ডেকেও ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। কারণ তিনি মঙ্গল পান্ডেকে গ্রেফতার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।