এডিট করুন
কট্টরপন্থী পাঠক
আমার ইংরেজ বিদ্বেষ প্রবল আকার ধারণ করল এক সময়। ইংরেজী ক্লাসে কোন প্রশ্নের উত্তর জানলেও উত্তর দেই না। বিনিময়ে সপাং সপাং বেতের আঘাত প্রাপ্ত হই। মনে মনে ভাবি, এ আর এমন কি? আমার থেকে কত বেশী কষ্ট বিপ্লবীরা সহ্য করেছেন। আমি নিজেকে তাদের উত্তরসূরী কল্পনা করি।
চিন্তা করি কিভাবে বৃটেন দখল করা যায়, কিভাবে ক্ষতিপূরণ স্বরুপ প্রতিশোধ হিসেবে ব্রিটেনকে দুইশ বছর শাসন করা যায়। কিভাবে ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে আমার উপমাহাদেশের সম্পদ পুনরুদ্ধার করা যায়। ফলাফল স্বরুপ ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষায় ইংরেজীতে একশতে চল্লিশ পেয়ে রোল নং নীচে ডাবিয়ে নিয়ে ক্লাস নাইনে উঠি। যেদিন রেজাল্ট দেয় সেদিন বেশ চাপে ছিলাম। কারণ বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট মানেই আমার উপর বাবার কিছু চ্যালা লাকড়ি ভাঙ্গা।
আমি এখনো বুঝি না যে বাবা মায়েরা কেন সবসময় ছেলে-মেয়েদের ১ম স্থানে দেখতে চায়। আরে বাবা সবাই ফার্ষ্ট হলে সেকেন্ড হবে কে? টেলিভিশনে বিভিন্ন আদর্শমূলক ছোটদের অনুষ্ঠানে, "আমরা সবাই বঙ্গবন্ধু হব", "আমরা সবাই জিয়া হব" বলে চিল্লাফাল্লা করা হয়। আরে বাবা এত প্রেসিডেন্টের জায়গা দিবি কই?
রেজাল্ট অতি খারাপ। জীবনে এত খারাপ রেজাল্ট করি নাই। বাসায় কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।
ভয়ে ভয়ে, বিভিন্ন সূরা কালাম পড়তে পড়তে বাড়ীতে গেলাম। বাবা কারখানার একটা টেবিলে বসে হিসাব করতে ছিলেন। টেবিলটা আবার জানালার কাছে। আমি জানালা দিয়ে মার্কশীটটা বাবাকে দিলাম। নিরাপদ দূরত্ব রেখে দেখতে লাগলাম কি প্রতিক্রিয়া হয়।
প্রতিক্রিয়া হল ভয়াবহ। বাবা ঠান্ডা ভয়ংকর গলায় বললেন, ঘরে আয়। আমি দাড়িয়েই থাকি। কোন উত্তর দেই না। পরে বাবা মাকে ডাক দিলেন।
উনারা দুইজন বললেন যে আমার পড়ালেখা করার দরকার নাই। এর থেকে ভাল হবে আমাকে একটা রিক্সা কিনে দেবেন, রিক্সা চালাব। অবশ্য রিক্সা চালানোর প্রস্তাব আমি বহুবার পেয়েছি। নতুন কিছু না। এরপর উনারা বেশ হতাশাব্যাঞ্জক কথাবার্তা বলা আরম্ভ করলেন।
এইবার আমার কেন জানি খারাপ লাগা আরম্ভ করল। কিছুক্ষণ হতাশাব্যাঞ্জক কথাবার্তা বলে উনারা আমাকে বাড়ী থেকে বের হয়ে যাবার আদেশ দিলেন। আমি খালি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উনাদের কথাবার্তা শুনছি আর সময় অতিবাহিত করছি। কারণ সময় হল সবচেয়ে বড় অষুধ। উনাদের মন এই অবস্থার সাথে যত বেশী সময় থাকবে আমার পিঠে চ্যালা লাকড়ি তত কম পড়বে।
বাবা মা কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করতে লাগলেন, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না, আমি শেষ, আমার লেখাপড়া শেষ। তারপর মা একটা কাজে চলে গেলেন। বাবা একা একা বিভিন্ন নিরুৎসাহিতামূলক কথাবার্তা বলতে লাগলেন। আমি আবার নিরুৎসাহিতা একেবারেই পছন্দ করি না। আমি জানালা থেকে সরে আসলাম।
রাস্তায় বের হয়ে হাটতে লাগলাম। উনাদের হতাশা আমাকেও কিছুটা ছুয়ে গেছে। ভাবতে লাগলাম, আমাকে দিয়ে কি আসলেই কিছু হবে? আমি সম্ভবত পরিত্যাক্ত। হাটতে হাটতে আমাদের এলাকার বিলের পাশে চলে এলাম। বিল জুড়ে ধানক্ষেত।
দুপুর বেলা। সকালে কিছু খাই নি। তবুও পেটে ক্ষুধা নেই। রৌদ্রকরোজ্জ্বল ধানখেত আর দুরের সবুজ গাছপালার সারি মনটা উদাস করে দিল। আমি প্রায়ই এই বিলে এসে বসে থাকতাম।
বৈরাগ্যের কড়া রোদের দুপুর তার উজ্বল সবুজের প্রাচুর্য নিয়ে আমার মনেও বৈরাগ্য সৃষ্টি করল। ভাবলাম, আসলেই বাড়ী ছেড়ে চলে যাব। টঙ্গীতে কিছু বেদে দল দেখা যায়। ওদের সাথে ভিড়ে যাব। যাযাবরের মত হারিয়ে যাব প্রচলিত এই জীবন থেকে।
আর ভাল লাগে না। আনন্দহীন প্রতিযোগীতার জীবন আমাকে আকৃষ্ট করে না। গৎবাধা মুখস্ত মুখস্ত মুখস্ত মুখস্ত মুখস্ত। ফার্ষ্ট সেকেন্ড থার্ড। সেরা ছাত্র, ভাল ছাত্র, ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র, ট্যালেন্ট।
কি লাভ এইসব করে। শেষ পর্যন্ত যদি আত্মাকে আনন্দ দিতে নাই পারলাম তাহলে এত উচুতে উঠে কি লাভ। স্কুলের শিক্ষায় কি হয়? কিছুই হয় না। ফালতু। একটা গল্প পড়া হয়, দুটো রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর ভাবভাবে, বিস্তৃতভাবে, পৃষ্ঠা ভরে ভরে লেখা জন্য।
ওখানে গল্পটার নির্যাতন হয়, এর বেশী কিছু হয় না। সবাই নোট নিয়ে বসে। অনেকে তো গল্পটাও পড়ে না, সোজা নোটবই মুখস্ত করে। পরীক্ষার খাতায় কে কতটুকু বুঝল তার থেকে বেশী প্রতিযোগিতা হয় কার হাতের লেখা কত দ্রুত। যে যত পৃষ্ঠা বেশী লেখতে পারে তার বেশী নাম্বার।
ভাল লাগে এইসব। হারিয়ে যাব সব ছেড়েছুড়ে। শিক্ষার নামে এই অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব না।
সারাদিন বসে বসে এইসব ভাবলাম। ভাবলাম কেউ কি যাবে আমার সাথে? না আসলে কেউ যাবে না।
জীবন বড়ই অনিশ্চিত। একলা চলতে বড় ভয়। এজন্যই হয়তো সবাই বিয়ে করে। সবার একজন সঙ্গী দরকার। এইসব ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমে এল।
আকাশে চাদ দেখা যাচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে বাড়ীর পথ ধরলাম। আসলে আমার যাবার কোন জায়গা নেই। গন্তব্য একটাই। ঐ বাড়ী।
বাড়ী যেয়ে বাবার সামনাসামনি হলাম। উনি আগেই একটা ভাল দেখে লাকড়ির লাঠি যোগাড় করে রেখেছেন। কিছুক্ষণ মার খেলাম। তারপর আর কি......... গজর গজর করে মা ভাত দিলেন খাওয়ার জন্য। খেলাম, ঘুমালাম।
মার খেয়ে স্বীকার করলাম এর পর থেকে ঠিক মত পড়াশোনা করব। আর সিদ্ধান্ত হল, এর পর থেকে আর কোন বই আনা হবে না বাড়ীতে। আমি এই কথার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। মাথায় বাজ পড়ল। এখন আমার কি হবে।
ভাতের আগে আমার প্রধান খাদ্য বই। কিন্তু কিছু বলার সাহস পেলাম না। এমনিতেই সব ক্ষেপে আছে। ভাবলাম পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক। পরে দেখা যাবে।
ক্লাস নাইনে আমি। স্কুলের নেতা ক্লাস। ক্লাস টেনের বিদায় বিদায় ভাব। আমি ছিলাম স্কাউটের সাথে যুক্ত। আমাদের দলের লিডার টেনে পড়ে।
অতএব আমি এখন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। ক্লাসের ইংলিশ ফর টুডে বইটা হাতে নিলাম। বুঝলাম আমার অবস্থা খুব খারাপ। অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে। খাটতে হবে।
আমার বন্ধুবান্ধবের তালিকায় কখনো ভাল ছাত্ররা ছিলনা। যে দু এক জন ছিল তারা অন্যরকম। ভাল ছাত্রদের নাক উচু ভাব আমি একেবারেই বরদাস্ত করতে পারি না। তাই সবসময় স্কুলের পেছনের বেঞ্চের ছাত্রদের সাথে আমার সম্পর্ক। আমি নিজেও সবসময় পেছনের বেঞ্চে বসি।
ক্লাসের লেকচার অতি জঘন্য। ক্লাসে শুধু অপেক্ষা করি কখন ক্লাসটা শেষ হবে। কিছুদিনের মধ্যেই আমি হাপিয়ে উঠলাম। বই না পড়ে বেশীক্ষণ থাকতে পারি না। ঐদিকে বাসায় আমাকে স্কুলের বই বাদে অন্য বই পড়তে দেখলে সোজা মার আরম্ভ করে।
কি করা যায় কি করা যায়...... প্রায়ই স্কুল পালাতাম। এর মধ্যে আমার এক বন্ধু, মুন্নু একদিন বলল, চল আজকে টিফিনে পালিয়ে এঞ্জেলের লাইব্রেরীতে যাই। ইন্টারন্যাশনাল এঞ্জেল এসোসিয়েশন, একটা জাপানী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ওদের ওখানে মেডিকেল সার্ভিস আছে জানতাম, কিন্তু লাইব্রেরী আছে জানতাম না। আমি চলে গেলেম মুন্নুর সাথে সেখানে।
মোটামুটি আমার জন্য সেই সময়ের তুলনায় বিশাল এক বইয়ের রাজত্ব পেলাম। আমাদের স্কুলের ছাত্রদের জন্য এন্ট্রি ফ্রী। কিন্তু বাসায় বই নেওয়া যায় না। আমি কিছুদিন স্কুল পালিয়ে যাতায়াত আরম্ভ করলাম সেখানে। স্কুলের টিফিনের সময় পালিয়ে চলে যাই সেখানে।
স্কুল ছুটি দেয় যে সময় তখন বাসার পথ ধরি। এর মধ্যে যতটুকু পড়া যায় পড়ে নেই। আগে ক্লাসের ক্যাপ্টেন ছিলাম। কিন্তু ক্যাপ্টেন নিজেই যখন পালায় তখন তার ক্যাপ্টেন না থাকাই ভাল। তাই ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব ছেড়ে দিলাম।
কয়েকদিন ধরা পরে মার খেলাম। তবে সেটা ব্যাপার না। সিক্স সেভেনে থাকতে খালেক স্যারের যে মার খেয়েছি তাতে দুই হাতের পেশী অনেক শক্ত হয়ে গেছে। এখন আর মার লাগে না। এর মধ্যে একদিন প্রমথ চৌধুরীর "বই পড়া" প্রবন্ধটা পড়লাম।
এই প্রথম একজন লেখক পেলাম যার লেখা আমার নিজের চিন্তাধারার সাথে মিলে। ক্লাসের ফার্ষ্ট বয় বেকুবের মত বলে বসল এই লোক গাঞ্জা খেয়ে এই লেখা লেখেছে। ক্লাসের স্কুল কলেজের শিক্ষাব্যাবস্থার বিরোধী সব ছেলেরা চিৎকার করে উঠল। বলল তুই গাঞ্জা খাইয়া এই কথা বলতাছিস। ক্লাসে তখন সুফিয়া আপা ছিলেন।
উনি কি বলবেন বুঝতে পারতেছিলেন না। কারন "বই পড়া"র মত স্ববিরোধী লেখা উনাকে বেশ বাটে ফেলে দিয়েছে। উনি বলতেও পারছেন না, ছেলেপুলেরা তোমরা সবাই বই পত্র ফেলে স্কুল ত্যাগ কর। আবার এটাও বলতে পারছেন না, প্রশ্নমালার প্রশ্ন দুটো ভালো করে মুখস্ত করে এস পরবর্তী ক্লাসে, আমি লিখতে দেব। জীবনে ঐ একদিনই ক্লাসে চরম আত্মতৃপ্তি অনুভব করেছিলাম।
আমার একটা নীতি ছিল, যা পড়ব বা শিখব তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করব। "বই পড়া" প্রবন্ধটা ছিল আমার জন্য একটা লাইসেন্স। কোনমতে ক্লাস নাইন শেষে ক্লাস টেনে উঠি। এইবার আর ফলাফল আগের মত খারাপ হয়নি। আমি ইতিমধ্যে ইংরেজী পড়া আরম্ভ করেছি।
তবে এইবার আমাকে অন্য কাজে পেয়ে বসে। "বই পড়া" প্রবন্ধ অনুসারে নিজের আত্মা রক্ষার কাজ। ক্লাস টেনে স্যারেরা অনেক ঢিলাঢালা। ক্লাসে উপস্থিতি নিয়ে তেমন একটা উচ্চবাচ্য করেন না। আমি স্কুলে আসাই বাদ দিয়ে দিলাম।
স্কুলের সময় স্কুল ড্রেস পড়ে বের হই। মুন্নুকে সাথে নিয়ে সোজা এঞ্জেলের লাইব্রেরীতে চলে যাই। সারাদিন ওখানে কাটিয়ে স্কুল ছুটির সময় বাড়ীতে ফিরে আসি। কোনদিন মন চাইলে স্কুলে যাই। টিফিন টাইমের সময় পালিয়ে আবার লাইব্রেরীতে চলে যাই।
ক্লাস টেন পুরোটা আমি এভাবে কাটিয়েছি। পরে দেখি উপস্থিতি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। ৭৫% ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবে পরীক্ষা দিতে হলে। সমাধানের জন্য গেলাম আমাদের ক্লাস টিচার স্যারের কাছে। উনাকে বললাম যে স্যার টেষ্টের আগে আর পরে আপনার কাছে পড়তে চাই।
কিন্তু শুনছি যে পরীক্ষাই নাকি দেওয়া যাবে না। উনি বললেন কোন ব্যাপার না। আমি ম্যানেজ করে নেব। তুই কবে থেকে আসছিস। আমি বললাম স্যার কালকে থেকেই আসব।
কিন্তু পড়ার সময়টা দিতে হবে স্কুল টাইমের আগে। কারণ স্কুল টাইম হল আমার অন্য কাজের সময়। স্যার রাজী হলেন। ঐদিকে আমার বন্ধুবান্ধবরাও স্যারের কাছে পড়ার জন্য লাইন দিল। কারণ ইংরেজীতে পাশ করা দরকার।
স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়লে পাশ নিশ্চিত। আমি এরপর স্যারের বেতনের দুইশ টাকা ধরিয়ে দেই মাসের শেষে কিন্তু নিয়মিত প্রাইভেটও পড়তে যাই না। কি দরকার। এই সময়টা বরং লাইব্রেরীতে কাটাই। এইভাবেই আমি স্কুল পালিয়ে নিয়মিত হাজিরা দেই নিজের আত্মা রক্ষা করতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।