আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাখি উড়ে চলে- নিরন্তর

সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত...............।

দিনের আলো মরে গিয়েছে সেই কখন! রাত এখন পূর্ণ যৌবনা। শ্রাবনের রাত; বিরামহীন কেঁদে চলেছে আকাশ; দুবে গেছে মাঠ-ঘাট। প্রয়োজনীয় জীবন রসের শেষ বিন্দু টুকু শুষে নেবার পর সিক্তা ধরণী যেন নিজেকে উপচে দিয়েছে। সরকারী বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে সেই কখন! অবিরাম বর্ষণ আর ঝিরঝিরে বাতাস ছাড়া সমস্ত বিশ্ব চরাচর সুপ্তিমগন; ক্ষনে ক্ষনে চমকে ওঠা বিদ্যুৎ ছাড়া আলোর দেখা নেই।

বজ্রের গর্জন ছাড়া শব্দ নেই। ঘুম নেই আমার দু'চোখে ও। নেই আর নেই এর মেলা বসেছে যেন চারপাশে। তারপরে ও কী যেন একটা আছে, না থাকার মত করে, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অনুভবে ও সে আসে অনেক তক্‌লিফ করে। আমার এই নিঃসঙ্গ জীবনের ও রাত ঘনিয়েছে।

পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে সূর্য। রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে প্রান্তর জুড়ে। প্রহর শেষের সেই রাঙা আলো প্রানপনে টেনে নেবার কী প্রবল আকূতি আমার এই শতাব্দী প্রাচীন দেহ জুড়ে- যেন দীর্ঘ যাত্রার আগে পর্যাপ্ত রসদ ভরে নিচ্ছে দূরের পথিক। মহাকাল ডাকছে তাকে অজানার পথে। এমনি সময়ে চোখ শুধু পুবের পানে ঘুরে যেতে চায়।

ভোরের মিঠে কড়া রোদ, মৃদুমন্দ হাওয়া, দ্বিপ্রহরের প্রবল প্রতাপ আর কর্মমুখরতা সবকিছুকেই কেমন স্বপ্নীল মনে হয়। মনে হয়, 'এই আমিই কি সেই আমি? নাকি, সেই সত্ত্বার নির্মোক ভেঙে জন্মেছি জরাগ্রস্থ নতুন এই আমি!' উত্তর খুঁজে পাই না। তাই স্মৃতির অতল তলানী হতে বুদ্‌বুদ্‌ তুলে আনি। দুঃখের স্মৃতি আমায় নাড়া দিয়ে যায় আর আনন্দের স্মৃতিগুলো আমায় কাঁদায়। কেবল একটি স্মৃতি, একজন নারী আমায় অনুভুতি শূণ্য করে দেয়।

এই গোধূলিবেলায় যখন সব পাখি নীড়ে ফেরে, তখন আমার একলা পাখি ঘর ছাড়ে। আঁধার আকাশে ডানার ঢেউ তুলে খুঁজে ফেরে অমিমাংসিত উত্তর। নারী - রক্তমাংসে গড়া এক দেহ মাত্র, অথচ প্রকৃতির এক রহস্যময় অবগুন্ঠন! তার দেহ আর মনের কোণে কোণে নিত্য নতুন আবিষ্কারের হাতছানি। কেবল একটি মাত্র তিল ঠোঁটের উপরে, কিংবা একটি গজদন্ত মাড়ীর নিচে, নয়তো একটুখানি দীঘল কুন্তল- তার জন্য কোরবান হয়ে গেছে হাজারো জীবন। কবিরা ব্যয় করেছেন দিস্তা দিস্তা কাগজ।

সৃষ্টির আদি হতে বোধহয় এই চলছে, আজও শেষ হয় নি। আমার সেই নারীও ছিল এমনি রূপকুমারী। "বলছি না সেই ছিল সময়ের সেরা সুন্দরী, কিন্তু এই পোড়া দু'চোখ যে তাতেই মজেছিলো"! সবে মাত্র কৈশোর পেরিয়েছি তখন, পৌছে গেছি এক অচেনা বন্দরে - যৌবন তার নাম। রক্তে কাঁপন তোলে, চেতনায় তোলে ঝড়। স্বপ্নীল হয়ে ওঠে সাদামাটা পৃথিবীটা।

এমনি সময়েই তার দেখা পেলাম। নব পত্রে-পুষ্পে যেমনি করে হেসে উঠে কৃষ্ণচূড়া, তেমনি করেই আমার চোখে ধরা দিলো সে। যৌবনের রঙে রাঙিয়ে দিলো হৃদয়। কখজন যে খুলে গেলো প্রাসাদের সিংহ দরজা, বখতিয়ারের সতেরো সওয়ার কখন যে বিনা রক্তপাতে দখল করে নিলো হৃদয়-সম্রাজ্য- আমি টের ও পাই নি। যখন টের পেলাম, ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছে।

আমি বাঁধা পড়েছি এক অদৃশ্য সূতোর কঠিন মায়াজালে। ভাবলাম, "প্রেমের হাতে ধরা দেবো, তাই রয়েছি বসে; অনেক দেরী হয়ে গেল দোষী অনেক দোষে"। কে যেন বলেছিলো, "ভালবাসা আয়নার মতো, এক মনে বাসা বাঁধলে অন্য মনে ছায়া পরতে বাধ্য"। কিন্তু, জীবন কাব্য নয়, জীবন হলো জীবনেরই মতো নিষ্ঠুর-নির্মম। এখানে ছায়া নেই, আছে মরিচীকা।

ফলে, যা হবার তাই হলো। ভালোবাসায় সাজিয়ে দেয়া পূজার ডালি উপেক্ষিত হলো ঘৃনাভরে। আমি বলে এলাম, 'দেখো, একদিন; একদিন ঠিক তোমায় জিতে নেব। ' ফিরে এলাম আমি। ডুবে গেলাম আমার মাঝে, আমারত স্বকীয় কর্মমুখরতায়।

কীভাবে কেটে গেলো দু’যুগের ও অধিক সময়! সময়- বড়ই মায়াদয়াহীন, মানবজীবনের এক সুকঠিন বাস্তবতা। চোখের পলকের চাইতে ও দ্রুত চলে সময়ের বাহন। বেদনার ক্ষতে বিস্মৃতির প্রলেপ দিয়ে সামনে এগিয়ে চলে সে। তাই দু''যুগের ঘোর কাটিয়ে যখন আমি চোখ মেলে চাইলাম, তদ্দিনে মেঘে মেঘে বেলা অনেক গড়িয়েছে, শত জীবনের আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য পদ্মা-মেঘনার জল হয়ে বয়ে গিয়েছে। সামাজিক মানুষের সাফল্যের মাপকাঠিতে উর্ত্তীর্ণ এই আমি আমার ভেতরের নিঃসঙ্গতাকে, সঙ্গীহীনাতার অতল গহবরকে আবিষ্কার করলাম।

বহু পুরনো ধামাচাপা দেয়া এক জেদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে আমাকে জাগিয়ে দিলো। তাকে জিতে নেবার ছেলেমানুষী ইচ্ছেটাকে সম্বল করে তার সামনে গিয়ে দাঁরালাম। শুনেছিলাম, স্বামী-সন্তান, বিত্ত-বৈভবে সুখেই আছে সে। কিন্তু, এ কী! এ কাকে দেখছি আমি! ঘোলাতে চোখের এক মধ্যবয়সিনী, পাতলা হয়ে আসা চুলের মাঝে শুভ্রতার ঊঁকিঝুকি। এই কি সেই, যাকে পাবার জন্য স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল এক করে দিতে তৈরী ছিলাম! আমার বিস্ময় সে অনুভব করলো।

বললো, 'নিজেকে দেখেছো?' বহুদিন পর আমি নিজের সামনে দাঁড়ালাম। আরে, তাইতো! এই কি সেই আমি? বয়সের বলিরেখা ঢেকে দিয়েছে যৌবনদীপ্ত মুখ। সময়ের অত্যাচারের স্বাক্ষী হয়ে আছে মাথাভর্তি শুভ্রতা। নিরবে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষন। তারপর, তার দিকে ফিরে জীবনে দ্বিতীয় বারের মত উচ্চারণ করলাম সেই সহস্রাব্দ প্রাচীন প্রশ্ন।

পৃথিবীর প্রথম মানব সম্ভবতঃ ভালবাসা ভরে প্রথম মানবীকে এই প্রশ্নই করেছিল। "যাবে তুমি? আমার সাথে?" জানিনা কী ছিল সেই ডাকে। দু'যুগ আগের পুনরাবৃত্তি আর হলো না। আকূতিভরা কন্ঠে সে বললো, "যাবো, নেবে আমায় সাথে?" আমি ফিরে এলাম। একা।

অসহ্য বেদনা আর হাহাকারে বুকের জমাট বরফ গলে গলে পড়ছিলো দু'চোখের ধারা হয়ে। না, সামাজিকতার অটুট বন্ধন ভেঙে আসবার সাহস তাকে আমি যোগাই নি। শুধু বলেছি, "মনে আছে? বলেছিলাম; একদিন তোমায় ঠিক জিতে নেবো। আমি জিতেছি, আমার ভালবাসা জয়ী হয়েছে। " আজ সময়ের শেষ সীমান্তে দাঁড়িয়ে আমি জেনে গিয়েছি, আমি জিততে পারিনি।

আর আমার ভালোবাসা? কে জানে, জিতেছে নাকি হেরে গিয়েছে। একাকিত্বের আগুনে পুড়ে যখন আমি নিঃসীমে বিলীণ হয়ে যাবো, তখন সে ভালোবাসার স্থান কোথায়? কীবা এসে যায় তার জয়- পরাজয়ে? তবে কি জন্ম-মৃত্যুই চরম বাস্তবতা- পরম সত্য; ভালোবাসা সময়ের বাগডোরে বন্দী? তবে একটা জীবন, যা আর কখনো কোন চেষ্টায় ফিরে আসবে না- নিঃশেষ হয়ে গেলো ভালোবাসার জ্বালায়? একটা কেন, এমন হাজারো জীবন যুগে যুগে পাড়ি দিল কষ্টের অকুল সমুদ্র! তাইতো আমার নীড়ের পাখি ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, খূঁজে ফেরে অমিমাংসিত উত্তর। নিরন্তর। বিঃদ্রঃ বছর কয়েক আগে এই গল্পটি লিখেছিলাম। সংগত কারণেই উঠতি বয়সের আবেগের বেড়া পার করে এটি সবল গদ্যের রূপ লাভ করতে পারে নি।

ব্লগার 'আহমেদ রাকিব' এটিকে মেধার অপচয় বলে অভিহিত করেছিল!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.