আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জয়নুল আবেদিন

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

জয়নুল আবেদিনঃ বাংলার শিল্পাচার্য ও চিত্রশিল্প আন্দোলনের পুরোধা মানুষের জন্য শিল্প, শিল্পের জন্য শিল্প নয়। শিল্পকে মানুষের জীবন থেকে আলাদা করা যায় না। শিল্প যে প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি, প্রতিরোধের অস্ত্র, অধিকার-সাম্য-স্বাধীনতার ভাষা হতে পারে তা আমরা শিল্পাচার্য ও চিত্রশিল্প আন্দোলনের পুরোধা জয়নুল আবেদিনের কাছ থেকে শিখি। যিনি ১৯৪২-৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের নিদারুণ ছবি এঁকে দেখিয়েছেন।

যে ছবির মাধ্যমে আজো আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি সেই দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ বাস্তবতা। শুধু দুর্ভিক্ষের ছবি নয়, তাঁর আঁকা প্রতিটি ছবিই এক একটি সময় ও বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। তাঁর আঁকা জলচিত্রগুলো অনন্য আসাধারণ। যার মধ্যে আমরা দেখতে পাই, গ্রাম-বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও মা-মাটি এবং মানুষের জীননের নানা বাস্তবতার কথা। যার প্রচেষ্ঠায় বাংলাদেশে শিল্প আন্দোলনের জয় যাত্রা শুরু হয়।

চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে তিনি হলেন এ দেশের শিল্পীদের আচার্য। জয়নুল আবেদিনের জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়ায়। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ, মা জয়নাবুন্নেছা। তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন দারোগা।

নয় ভাই—বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন পিতা-মাতার বড় সন্তান। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছে। খুব ছোট বেলা থেকেই জয়নুল ছবি আঁকা পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফলসহ আরো কত কি এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। ময়মনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ভর্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রতিষ্ঠানিক পড়াশুনা।

পড়াশুনার চেয়েও বেশী ঝুঁকে পড়েন ছবি আঁকার দিকে। জীবনের শুরুতেই তিনি শৈল্পিক প্রতিভার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মা, মাটি, মানুষ ও প্রকৃতিকে ভালবেসেই নিজের মধ্যে নির্মাণ করেন শিল্প প্রতিভা। নদী ছিল তাঁর খুব প্রিয়। তিনি নদীকে ভালবেসে বলতেন_নদীই আমার শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক।

সেই ছোট বেলা থেকে প্রবল ইচ্ছা ছিল কলকাতায় গিয়ে শিল্পকলা শেখার। ১৯৩০ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে বন্ধু-বান্ধবের সাথে কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখতে যান। বাড়িতে ফিরে এসে মা-বাবাকে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দিতে বলেন। অবশেষে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের পড়াশুনা ইস্তফা দিয়ে ১৯৩৩ সালে জয়নুল ভর্তি হন কলাকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে। এখানে তিনি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত আর্টের উপরে পড়াশুনা করেন।

ওই বছর কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৩৮ সালে শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন। ওই একই বছর তিনি কলকাতায় জাতীয় চিত্র প্রদর্শনীতে ৬ টি জলরঙ চিত্রের জন্য গভর্ণর স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৪২-৪৩ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।

এই সময় ইংরেজ শাসকদের অবহেলার কারণে সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয়। গ্রাম-বাংলার আনাহারী মানুষ খাবারের জন্য ছুটছে কলকাতার দিকে। ওলিতে-গলিতে, রাজপথে-ফুটপথে অগনিত মানুষ ক্ষুধার তাড়নায়-যন্ত্রণায় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খুঁজে ফিরছে ডাস্টবিনে- নর্দমায়। জয়নুল আবেদিন দৃষ্টির ক্যামেরায় তুলে নিলেন_এ সকল মর্মান্তিক দৃশ্য।

দিনরাত ঘুরে ঘুরে তিনি আঁকলেন দুর্ভিক্ষ বিষয়ে অনেক ছবি ও স্কেচ। ১৯৪৪ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি আয়োজন করলো তাঁর ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী। এই প্রদর্শনী পরে দিল্লীতে হয়। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে জয়নুল আবেদিনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো নিখিল ভারতে। এতো দিন পরে সমগ্র দেশ চিনলো তাঁকে।

ওই বছর দুর্ভিক্ষ নিয়ে কলকাতায় যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল তাতে জয়নুল তাঁর দুর্ভিক্ষের উপর করা ছবি নিয়ে অংশগ্রহণ করেন। কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র The People's War পত্রিকায় ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি সংখ্যায় জয়নুলের ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর জয়নুল আবেদিন ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশে নর্মাল স্কুলে আর্ট শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১২ নম্বর আবদুল হাদী লেনে শ্বশুরালয় বসবাস করতে থাকেন।

অনেক সংগ্রাম আর পরিশ্রম করে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত করেন ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট। এর নাম ছিল ‘গভর্মেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্ট’। এই সময়েও কমিউনিষ্ট পার্টি তাঁকে সহযোগিতা করে। যে কারণে এই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ছড়িয়ে গেল শিল্পকলা আন্দোলন। ১৯৪৯-৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন।

জয়নুল আবেদিন১৯৫৬-৫৭ সালে বিশ্ব ভ্রমণের এক পর্যায়ে মেক্সিকো বেড়াতে গিয়ে সিকিওরসের সাথে দেখা করেন। ১৯৫৯ সালে জয়নুল আবেদিন পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ট সম্মান ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ফিলিস্তিনি যুদ্ধে যোদ্ধাদের আমন্ত্রনে সে দেশে যান। উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো যুদ্ধের মর্মান্তিক ছবি সংগ্রহ করা। ১৯৭০ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে আর্ট কলেজে ‘নবান্ন’ শীর্ষক এক বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

জননেতা মাওলানা ভাসানীর সাথে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় ভাষণও দিয়েছেন তিনি। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমীর সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল থাকেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর অন্যতম উপদেষ্টা মনোনীত হন। ওই বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়াস্থ ‘কংগ্রেস ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিটি’র সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। ওই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান সূচক ডি-লিট উপাধীতে ভূষিত করে। আমৃত্যু তিনি সম্মানের সাথে এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মাত্র ৬২ বছর বয়সেই ১৯৭৬ সালের ২৮ মে তিনি মারা যান।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.