আমার ছেলে বেলার কথা: তখন আমার বয়স কত হবে তা এই মুহুর্তে মনে নেই, ঝিনাইদহ শহরের বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড অফিসের আবাসিক এলাকায় আমাদের কোয়াটারছিল আব্বার চাকুরীর সুবাদে। আমার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার বর্তমান কমলনগর উপজেলার মার্টিন গ্রামে। মা থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। আমার লেখা পড়ার সুবিধার জন্য আব্বা আমাকে শহরে রাখতে চেয়েছিলেন। তখন আমি ঝিনাইদহ মডেল হাই স্কুলের ৬ষ্ঠ কিংবা ৭ম শ্রেনীর ছাত্র।
সখ ছিল দুটি। একটি বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলা এবং দুই সিনেমা দেখা। তখন প্রচুর সিনেমা দেখতাম, অবশ্যই বাংলা। তখনো হিন্দি সিনোমা দেখার সুযোগ হয়নি। ভিসিয়ার বা সিডি ডিভিডির কথা স্বপ্লতেও ছিলনা।
টিভি প্রথম দেখলাম বিদ্যুৎ অফিসের অফিসার্স ক্লাবে। আমরা তখন সেখানে রবিবার বিকেলে ইংরেজী সিরিয়াল টারজান এবং বুধ /শনিবার যথাক্রমে দ্যা বায়নিক ওম্যান এবং দ্যা সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান সিরিজ দেখতাম।
সময়টা ৭০দশকের শেষ দিকের হবে। ঝিনাইদহ তখন মহকুমা শহর মাত্র। আমার সময়টি ভাল কাটলেও টাকা পয়সার খুব অভাব ছিল মানুষের এবং টাকার মানছিল যথেষ্ট বেশি।
আব্বা আমার জন্য তখনকার সময়ে একজন গৃহ শিক্ষক রেখেছিলেন মাত্র ২০ টাকা মাসিক বেতনে। বর্তমানে ২০ টাকায় একপ্যাকেট সিগারের বা এককেজি চাল হয়না। আব্বার যত অভাবই থাকুক না কেন তিনি আমাকে কখনো অভাব নামের কোন শব্দ এর সাথে পরিচিত হতে দেননি। আব্বা ছিলেন সরকারী অফিসের একজন গাড়ি চালক। তখনকার সময়ে একজন গাড়ি চালকের বেতন আর কতই ছিল।
এখন অবশ্য সেটা বুঝি। যদিও গ্রামের বাড়িতে কোন টাকা পয়সা আব্বাকে পাঠাতে হতোনা, কারণ দাদার আমলের কিছু সম্পদ ছিল যা থেকে গ্রামের বাড়ির লোকদের দুবেলা দু মুঠো হয়ে যেতো। আব্বার অফিসে তার একটি আলাদা সম্মান ছিল। আব্বা নাকি কোন কাজে ঘুষ পছন্দ করতেন না বা ঘুষ খাবার সুযোগ ছিল না। নিজে সব সময় সৎভাবে জীবন যাপন করতেন।
অফিস কোয়াটারে অনেক পরিবারের বসবাস ছিল। সে সময়ে সেখানে কোন সমস্যা হলে সবাই আব্বাকে ডাকতেন, এমনকি অফিসের অনেক অফিসার পর্যন্ত আব্বাকে সমীহ করে চলতেন। সেই সুবাদে আমার দাপোট ছিল ছেলে মেয়েদের কাছে আলাদা। যেহেতু আব্বার সাথে আমি একা থাকি এবং বাচ্চা ছেলে। তাই আমাকে দিয়ে অনেকে নিজের বিপদের কথা আব্বার কাছে যানাতেন।
কোয়াটারের সকল বাসায় আমার যাতায়ত ছিল অবাধ। সবাই অবশ্য আমাকে খাতির যত্ন করতেন। কারণ আমার মা আমার কাছে ছিল না। অনেক বড় অপরাধ আমার জন্য ছিল নশ্যি। তাই বোধ হয় বড় হয়ে আমি কোনদিন কারো বা দেশের কোন কাজে লাগতে পারি নি।
পারিনি কোনদিন কোন মানুষের বড় ধরনের উপকার করতে। শুধু উপকার নিয়েই গেলাম। একদিন বন্ধুরা ধরলো একটি ফুটবল কিনে দিতে। আমি রাজি হলাম না, হই কি করে? একটি বলের দাম ৭০/৮০ টাকা। অত টাকা আমি যোগাড় করি কি করে? একজন প্রস্তাব দিল, আমি যদি রাজি থাকি তো সে বলের টাকার যোগান দেবে।
আমি বললাম কিভাবে। সে বলল তুই রাজি কিনা। না বুঝেই বললাম রাজি। তাহলে কাল দুপুর বেলা এখানে আসিস।
মন খুত খুত করছিল দুপুর বেলা এলে কিভাবে বলের টাকাটা যোগাড় হবে? যথা সময়ে আমি হাজির হলাম।
দেখি পেন্টাগন সদস্যদের মধ্যে আমিই বাকি। স্বপন প্রস্তাব দিল সংরক্ষিত এলাকার ষ্টোর থেকে কিছু তামার তার নিয়ে বিক্রি দিলেই হবে। আমি বন্ধুদের কথায় রাজি হলাম না দেখে সবাই আমাকে ব্যাক্লমেল করলো; তুই যদি রাজিনা থাকিস, তাহলে আমরা সবাই তোর নামে নালিশ দেব। আমি ট্যাপে পড়ে রাজি হলাম এই শর্তে যে আমি কিছুই করতে পারবো না। তোকে কিছুই করতে হবে না।
শুধু দাড়িয়ে দাড়িয়ে পাহারা দিবি। কেউ এলে আমাদের ইশারা দিবি। রাজি হলাম বটে আমার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে রোমগুলো দাড়িয়ে গেল। কি আর করা; মাথায় তখন একটাই চিন্তা যদি ধরা পড়ি আব্বার সকল সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। তবু ও দাড়িয়ে রইলাম।
কেউ এলো না আমাদের চুরি ধরতে। আমি নিশ্চল দাড়িয়ে রইরাম অলস ট্রাফিকের মত। কিছুক্ষন পর বন্ধুরা ডাকলো তাদের কাজ শেষ। দেখি তামার তার ছোট ছোট করে প্লায়ার দিয়ে কেটে বান্ডেল করে ফেলা হয়েছে। কিভাবে এততাড়াতাড়ী হলো জানতে চাইলে বললো সেটা তোর জেনে কাজ নেই।
এবার আসল কাজ । সিকিউরিটির সাথে তোর সম্পর্ক আছে তুই গিয়ে তার সাথে আলাপের মাধ্যমে তাকে অন্য মনস্ক করে রাখবি। ততক্ষনে আমরা মালটা প্রাচিরের বাইরে ফেলে দেব। পরের কাজ আমার জন্য খুব সহজ। সিকিউরিটিকে আমরা রুস্তম কাকা বলে ডাকতাম।
গিয়ে তার সাথে নানান কথা বলে তাকে একই জায়গায় ধরে রাখলাম।
এর পর বিকেলে চাকলা পাড়ার এক কামার দোকানে নিয়ে মালটা বিক্রয় করে দিলাম। কামার ব্যাটা ছয় নয় বুঝিয়ে আমাদেরকে আধা পয়সা ধরিয়ে দিল, সে জানতো মালটা আমরা চুরি করে এনেছি। ঐ টাকা দিয়ে ঝিনাইদহ শহরের সবচেয়ে নামি দোকান ভ্যারাইটিজ ষ্টোর থেকে একটি ফুট বল কিনলাম। সেটি ছিল আমাদের সকলের প্রথম নিজস্ব বল।
এর আগে অফিসার্স ক্লাবের বাচ্চাদের বল খেলতাম। সেটা পাওয়া যেতো বিকেল ৫টা সাড়ে ৫টার দিকে অতক্ষন আমাদের তর সইতনা। ওই এলাকায় বাতাবী লেবু প্রচুর ফলতো তখন। এখন ফলে কিনা জানিনা। সেই বাতাবী লেবু বা জাম্বুরা পেড়ে দেয়ালে পিটিয়ে নরম করে তারপর বল খেলতাম।
আমাদের চুরির দু’দিন পর বিদ্যুতের তার ও এঙ্গেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো এক চোর। চোরকে গনপিটুনিতে অজ্ঞান হতে দেখে আমার ও আমার বন্ধুদের সেকি অবস্থা। মনে মনে সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ জানালাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।