আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারীবাদী বেদেসমাজ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
বেদে শব্দটায় যেন দুটো ছবি জড়ানো। সাপ ও নৌকা। কেন? এই উত্তরটাই খুঁজি না কেন আজ।

এই ঢাকা শহরেই তো বেড়ে উঠেছি। ছেলেবেলায় একটা গান খুব শুনতাম। ফোক সং। আমার নামটি দয়াল বাইদ্যা বাবু বাড়ি পদ্মার পাড়; আমরা সাপখেলা দেখাই ... যারা সাপ খেলা দেখায় মূলত তো তারাই বেদে। না কি? বৈদ্য (চিকিৎসক) শব্দটির একটি অমার্জিত প্রতিশব্দ হল বাইদ্যা।

বাইদ্যা মানে, হাতুড়ে ডাক্তার। কারও কারও মতে বেদে শব্দটি ওই বাইদ্যা শব্দ থেকেই উদ্ভূত বলে মনে হয়। তো কারা এই বেদে? কেন তারা সাপখেলা দেখায়? কেন তারা নৌকায় থাকে? ইতিহাসের পাতা উলটিয়ে দুরকম ব্যাখ্যা পেলাম। প্রথমটি এরকমের: ১৬৩৮। চট্টগ্রামের পূর্বদিকে বর্তমান মায়ানমার (বা বার্মা) তৎকালীন আরাকান।

দেখি যে- আরাকানের রাজা বল্লাল শরণার্থী হিসেবে ঢাকায় পালিয়ে এসেছেন। আরাকানের রাজার সঙ্গে এসেছিল যারা তারা আর আরাকানে ফিরে যায়নি। ঢাকায় বসবাস করতে থাকে। ঢাকা তখন মুগলদের কেন্দ্র। মুসলিম শাসন।

তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে। তারা নাকি প্রথমে বিক্রমপুরে বাস করছিল। পরে বাংলার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল তারা- এমন কী পশ্চিম বঙ্গে আর আসামেও। আবার কেউ কেউ এমনও বলে যে- এককালে আরাকান রাজ্যে বাস করত মনতং নামে একটি জাতি। কোনও কারণে তারা আরাকান ছেড়ে পশ্চিমে অর্থাৎ বাংলায় এসেছিল।

মনতং-রা নাকি নানারকম ভেষজ চিকিৎসা জানত। এরাই আসলে বেদেদের পূর্বপুরুষ। এরা দেখতে নাকি ছিল অবিকল বাঙালিদের মতই। তবে সদা ভ্রমনরত বলে তারা ছিল সাহসী ও কঠোর পরিশ্রমী। বেদের সমাজ কৌমসমাজ।

এদের মধ্যে গোত্রপ্রীতি প্রবল। বাইরে থেকে দেখলে এদের পিতৃতান্ত্রিক মনে হলেও এরা আসলে নারীর সিদ্ধান্তের অনেক গুরুত্ব দেয়। বেদেসমাজে নারীরাই কাজ করে বেশি। বেদে ছেলেরা নাকি অলস হয়। এরা বাস করে মূলত নৌকায় ।

তবে নদী কি খালপারে মাচা তুলে ঘর বেঁধেও বাস করে বেদেরা। নৌকা এদের কাছে মরুভূমির উট কিংবা ঘোড়ার মতন। গাওয়াল শব্দটির মানে কি জানেন? ফসল তোলার মৌসুমে বেদেরা নৌকায় করে এক গঞ্জ থেকে অন্য গঞ্জে যায়। কেন? ব্যবসা করার জন্য। এই যে নৌকা করে এক গঞ্জ থেকে অন্য গঞ্জে যায়-একেই বলে গাওয়াল।

মজার ব্যাপার হল বেদে-নারীরাই বেশি যায় গাওয়ালে। (তখন তা হলে বেদে পুরুষেরা কি করে? আচ্ছা অলস তো এই পুরুষজাত!) বেদে মেয়েদের সঙ্গে থাকে সাপের ঝাঁপি। আর অষুধের ঝুলি। গাওয়াল শেষে আবার স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে আসে। তখন আয়োজন করা হয় এক আনন্দ উৎসবের।

উৎসব তো মানবসমাজের অনাদিকালের কৃত্য। তো বেদে সমাজে ওই উৎসবের ভূমিকা কিন্তু অনেক। উৎসবের সময় ছেলেরা মেয়েদের পছন্দ করে আর মেয়েরা ছেলেদের। একে অপরের পছন্দ হলেই তবে তাদের মা-বাবারা বিয়েতে সম্মতি দেন। তবে বিয়ের ব্যাপারে তরুণ-তরুণীর সিদ্ধান্তই শেষ কথা।

তবে তারা যে তাদের প্রেমের ফসলের যত্ন নেবে; মানে তাদের যখন বাচ্চাকাচ্চা হবে তখন সেই বাচ্চাকাচ্চাকে ভালো করে লালনপালন করবে সে ব্যাপারে হবু দম্পতির সবার সামনে শপথ করতে হয়। বাহ! বেদেদের এই শপথ নেওয়ার প্রথাটি কিন্তু আমার বড় ভালো লাগল। বিয়ের পরে স্ত্রী ...না না স্বামীই স্ত্রীর ঘরে যায়! তখন বলছিলাম না বেদেরা মাতৃতান্ত্রিক। মাতৃতান্ত্রিক ও সুখি। তো উৎসবের কথা বলছিলাম।

উৎসবে তো নাচগান হয়। এই ধরুন খালের পাড়ে মাঠে। তখন অনেকেই আসে নাচগান দেখতে। পুরুষ হলে বেদে মেয়েদের বিয়ে করতে বলে সর্দাররা। আর আমরা গুলি করি।

আমি ইউরোপের “অনার কিলিং”-এর কথা বলছি। প্রতি বছর কত কত মুসলিম মেয়ে কে প্রাণ দিতে হচ্ছে ভাইয়ের হাতে বাপের হাতে অন্য সম্প্রদায়ের ছেলেকে পছন্দ করার জন্য। ধিক! বেদেদের নিয়মকানুনই তো বেশি ভালো লাগছে। চলে যাব নাকি চাঁদপুর। আমার আবার সাপে ...আসলে যাওয়া হয় না।

বেদে পরিবার তো ভিনদেশি পুরুষের সঙ্গে বেদে মেয়ের বিয়ে হলে সেই ভিনদেশি পুরুষটাকে বেদেসমাজে রেখে দেওয়া হয়। কী কারণে কে জানে। মায়েরা হয় মেয়েদের চোখের আড়াল করতে চায় না। মায়েরাই তো সে সমাজের মূল ভিত। বেদে সমাজে যে কারণে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নাই।

আমার ধরনা মাতৃতান্ত্রিক বলেই নেই। নারীরা এই দুটো কদর্য প্রথা ঘৃণা করে। পুরুষেরা কেবল বোঝে না। এমন কী বিধবা বিবাহের প্রচলন রয়েছে বেদেসমাজে। আমার ধারনা বেদে সমাজ মাতৃতান্ত্রিক বলেই সেই সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন আছে।

নারী কেন সাদা থান পরে কলাসেদ্ধ খেয়ে আর হরিনাম জপ করে জীবন কাটাবে? সে তো প্রানি। তার জৈবিক তাড়না আছে। এই সত্যটা স্বীকার করে নিলেই হল। সমাজপতিদের এত চোখ রাঙানো কেন? যা হোক। বেদেরা মুসলিম।

তাই বলে মেয়েরা পর্দার ঘেরাটোপে আটকে থাকে না। সে সমাজের মেয়েরা স্বাধীনচেতা। কখনও বিবাহবিচ্ছেদ হলে সবই নাকি ভাগ হয়। বাচ্চাকাচ্চাও। তবে মেয়েরা ভাগে বেশি পায়।

একেবারেই নারীবাদী সমাজ বলে মনে হচ্ছে। বেদেদের নিয়ে আরও ভাবতে হবে। তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়ার জয়নাল আবেদিন খান রচিত একটি নিবন্ধ।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।