সত্য বল সুপথে চল, ওরে আমার মন ...
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীঃ বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বাংলার মজলুম জননেতা। তিনি তাঁর সারাটা জীবন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য ব্যয় করেছেন। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের জীবনে কখনো কোথাও মাথানত করেননি। আপোষহীন থেকেছেন নিজের আদর্শের প্রতি। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামে ছিলেন অবিচল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগরিত করেন। জমিদারদের নির্যাতন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক-মেহনতিকে ঐক্যবদ্ধ করে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। শুধু ব্রিটিশ নয়, পাকিস্তান স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তিনি জীবনপণ লড়াই চালিয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। বস্তুতঃ তিনি জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শ-চেতনার সংমিশ্রণে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন (ন্যাপ)।
তাঁর বিচিত্র এই রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে- একটা কথা স্পস্ট বুঝা যায় যে, তিনি আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য লড়াই-সংগ্রামে কখনো পিছু হটেননি। বরং এই সকল লড়াই-সংগ্রামের জন্য জেল, জুলুম, হুলিয়াসহ নানা নির্যাতনের শিকার হন।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর বৃহত্তর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের ধানগড়া পল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী। হাজী শারাফত আলী ও বেগম শারাফত আলীর পরিবারে ৪ টি সন্তানের জন্ম হয়।
একটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে। মোঃ আব্দুল হামিদ খান সবার ছোট। তাঁর ডাক নাম ছিলো_চেগা মিয়া। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোট থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে বেগম শারাফত ও দুই ছেলে মারা যায়।
বেঁচে থাকলো ছোট শিশু আব্দুল হামিদ খান।
পিতৃহীন হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তাঁর আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে তিনি বগুড়ার পাঁচবিবির জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান।
সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন।
১৯২৫ সালে জমিদারের মেয়ে আলেমা খাতুনকে ভাসানী সহধর্মিনী করেন। তিনি অবশ্য রাজনৈতিক কারণে আরো দুটি বিয়ে করেছিলেন। ১৯২৬ সালে তিনি সহধর্মিনী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসামে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মোটামুটি এখানেই থেকে যান।
পূর্ব বাংলা থেকে ভাসানী স্বেচ্ছায় আসামে চলে যাননি। তাঁকে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। শৈশবকাল থেকে তিনি বাংলার নির্যাতিত কৃষকদের বেদনার অংশীদার ছিলেন। ওই সময় রাজশাহীর ধূপঘাটের জমিদারের সাথে তাঁর সংঘর্ষ বাধে। যে আন্দোলনে সংঘর্ষ হয় তা ‘অস্টন মোল্লার কৃষক বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত।
এই সময় তিনি জীবনের নিরাপত্তার জন্য টাংগাইলেরে কাগমারী চলে যান। সেখানে তিনি জমিদারদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন। জমিদার কাগমারী থেকে ভাসানীকে পুলিশ দিয়ে বের করে দিলেন।
ভাসানী বুঝতে পারলেন যে, এ সকল জমিদারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই। শুরু করলেন নির্যাতিত কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ।
জড়িয়ে পড়লেন প্রকাশ্য আন্দোলনে। শুধু টাংগাইল নয়, গৌরীপুরের মহারাজের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষেপিয়ে তুললেন। সকল ভূস্বামীরা এক হয়ে জেলা প্রশাসককে দিয়ে ‘এলাকার শান্তি রক্ষার স্বার্থে’ ভাসানীকে ময়মনসিংহ জেলা থেকে বহিস্কার করা হয়।
চলে গেলেন পাবনা। সেখানে গিয়ে আবার জমিদারে অত্যচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগঠিত কারার কাজ অব্যহত রাখলেন।
ওই সময় ওই এলাকার কৃষকরা সুদের ঋণের দায়ে ভূমিহীন হয়ে পড়েছিলেন। এদের নিয়ে জমিদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯২৬ সালে বাংলার গভর্ণর ভাসানীকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে এই প্রদেশ থেকে বের করে দেন। এরপর তিনি বাধ্য হয়ে আসাম চলে গিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি আসামে এক বৃহৎ কৃষক সম্মেলন করেন, যা ইতিহাসে এখন বৃহত্তর কৃষক সভা নামে পরিচিত।
১৯৩২ সালে টাঙ্গাইলের অদুরে চাড়াবাড়ির নদীর তীরে, সিরাজগঞ্জে তার নেতৃত্বে এক ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ উপস্থিত ছিল। এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। জনসাধারণের মধ্য ভাসানীর অসম্ভব জনপ্রিয়তা দেখে মুসলিম লীগ তাকে দলে টেনে নেয়। ওই বছর তিনি ধবড়ীতে প্রথম আমরণ অনশনের কথা করেন।
এবং এই অনশন কর্মসুচি পালন করেন। ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন পাশ হওয়ার পর মুহাম্মুদ আলী জিন্নাহ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি করার প্রস্তাব করে। ভাসানী ১৯৩৭ সালে আসাম মুস্লিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
বিংশ্ব শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে বাংলার ময়মনসিংহ, রংপুর, কুচবিহার, ত্রিপুরা ও সিলেট থেকে লক্ষ লক্ষ ভূমিহীন কৃষক আসামের জঙ্গলে ভাসান চরে বসবাস করতে শুরু করে। এই জঙ্গল ওই কৃষকদের কারণে বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠে।
এই কারণে প্রথম দিকে আসামের সরকার কৃষকদের অভিনন্দন জানায়।
কিন্তু যখন লোকসংখ্যা বেড়ে যায় তখন সরকার বহিরাগতদের উপর পীড়াপীড়ি শুরু করে। শুরু হয় সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ নিবারণের জন্য আসাম সরকার ভাসান চরে লাইন প্রথা প্রবর্তন করে। সরকার সেই সাথে গো হত্যা নিষিদ্ধ করে।
লাইন প্রথার সাথে যুক্ত হলো ধর্মীয় আন্দোলন। ভাসানীর নেতৃত্বে এ আন্দোলনে যুক্ত হলেন সকল বাঙ্গালী। ১৯৩৫ সালে ভাসানী ডাকে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী সমবেত হলেন। ভাসান চরের লাইন প্রথা ভেঙ্গে দিলেন তিনি। অসামান্য নেতৃত্বের জন্য এই চরের জনগণ তাঁর নামের সাথে ভাসানী যুক্ত করে দেয়।
১৯৩৮ সালে আসাম থেকে গাইবান্ধা এসে এক কৃষক সমাবেশ করেন তিনি। এ সমাবেশে সেই সময়ের খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিমলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ভাসানী সর্বভারতীয় মুসলিমলীগ নেতাদের ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালের ৩ মার্চ, ভাসানী ‘বাংলা–আসাম মুজাহিদ স্মমেলন’ ও ‘সাহিত্য সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত করেন।
৪ মার্চ তিনি ‘নওজোয়ান সম্মেলন’ ও ‘ন্যাশনাল গার্ডাস’ সম্মেলন অনুষ্ঠিত করেন। কিছুদিন পরে বস্তুতঃ আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে তাঁকে কারাগারে আটকে রাখা হয় ১৯৪৮ সলে মুক্তি পান।
১৯৪৮ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকায় কার্জন হলে পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিমলীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে মাওলানা আকরাম খাঁ ও ইউসুফ আলী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় সহকারী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শাহ আজিজুর রহমান।
আকরাম খাঁ ও ইউসুফ আলী চক্র ভাসানীকে নেতৃত্বে নেননি। অবশ্য এর একটা যৌক্তিক কারণ হতে পারে ভাসানী নেতৃত্ব পর্যায়ে থাকলে তাঁদের রাজনীতিতে আর মাতুব্বরী থাকবে না। কারণ জনপ্রিয়তা। ভাসানীর জনপ্রিয়তার কাছে সকল পরাদস্তু। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার ১০ বছর পূর্ব থেকে ভাসানী ছিলেন প্রাদেশিক মুসলিমলীগের সুভাপতি।
প্রথম সম্মেলনের পর বাংলার মুসলীমলীগের দায়িত্ব পড়ে খাজা নাজিম উদ্দিন ও মাওলানা আকরাম খাঁর উপর।
মাওলানা ভাসানী আসাম থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কিছুদিন পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার ‘রোজ গার্ডেনে’ প্রাদেশিক মুসলিমলীগের বিদ্রোহী নেতা-কর্মীরা একটি সভা অনুষ্ঠিত করে। এ সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। পরদিন ২৪ জুন বিকেলে আরমানীটোলা মাঠে নবগঠিত আওমী মুসলিমলীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত, দলের প্রধান ভাসানীর নেতৃত্বে।
ওই বছর ১৪ অক্টোবর ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫০ সালে সরকারের পুলিশ বাহিনী রাজশাহী কারাগারের খাপড়া ওয়াড়ের বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এর প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবন্দীরা অনশন ধর্মঘট পালন করে। যার ফলে ওই সময় ভাসানী মুক্তিলাভ করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরী হলে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে ভাসানীকে দীর্ঘ ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হতে হয়।
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর নির্বাচনে মুসলিম লীগকে প্রতিহত করার জন্য আওমী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, ইসলাম পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও খেলাফত রাব্বানী পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি বিরোধী দলীয় জোট, যা যুক্তফ্রন্ট নামে পরিচিত।
এই জোটের নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ একে ফজলুল হক ও মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এই ঐক্যজোট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইসতেহার প্রণয়ন করে। এটি অবশ্য এদেশের জন্য একটি অবিস্মরণীয় দলীল।
বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী দল এই জোটে থাকলেও মূল নেতৃত্বে ছিল বামপন্থী ও কমিনিস্টরা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ২৩৭ টির মধ্যে ২২৮ টি আসনে এ ফ্রন্ট বিপুলভাবে জয় লাভ করে। এ জয় লাভের পিছনে ভাসানীর অবদান ছিলো। এ ফ্রন্ট শেরে বাংলা এ একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে।
১৯৫৪ সালের ২৫ মে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য সুইডেনে যান।
৩০ মে পাকিস্তান কেন্দীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয় এবং হামিদ খান ভাসানীকে দেশে ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১১মাস পর ১৯৫৫ সালের ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তিনদিন ব্যাপী ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা ভাসানী। এই কাউন্সিলে তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
এরপর পূর্ব-বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬ সালের ৭ মে ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু হয়।
অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনা জড়িয়ে আছে মাওলানা ভাসানীর জীবনে। তার মধ্য অন্যতম ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় ঘটনা হলো ১৯৫৭ সালের ৮-১০ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত ‘পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলন’ যা কাগমারী সম্মেলন নামে পরিচিত। এটি পূর্ব-বাংলার সর্বকালের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনের পর সারা পাকিস্তান জুড়ে ভাসানীর নাম ছড়িয়ে পড়ে।
আওয়ামী মুসলিম লীগ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দিন দিন দক্ষিণপন্থী হয়ে পড়ে। বামপন্থীরা এই দক্ষিণপন্থীদের জন্য বা চাপে রাজনৈতিক সিদ্বান্ত গ্রহণ করতে পারছিলনা। ঠিক এমন একটা পরিস্থিতে ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালের ২৪ও ২৫ জুন কমিউনিস্টভাবাপন্ন নেতা-কর্মীরা একটি নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নিয়ে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন আহবান করে। এতে পাকিস্তান থেকে শতাধিক খ্যাতনামা বামপন্থী প্রবীণ নেতা অংশগ্রহণ করে। এই ঐতিহাসিক সম্মেলনের সিদ্বান্ত অনুসারে কৃষক-শ্রমিকের রাজনৈতিক সংগঠন ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (সংক্ষেপে ন্যাপ) গঠন করা হয়।
মাওলানা ভাসানী দলের সভাপতি ও মাহামুদুল হক ওসমানী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৮ সালে ৭ অক্টোবর সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর পাকিস্তান স্বৈর-সরকার সকল রাজনৈতিক দল ও তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে এবং রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে। ১২ অক্টোবর হাসপাতালে অসুস্থ্য থাকা অবস্থায় ভাসানীকে গ্রেফতার করে। তাঁকে ৪ বছর বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়। ওই সময় সরকার বন্যার্তদের ত্রাণকার্যে গাফিলতি করে।
এজন্য মাওলানা ভাসানী সরকারের বিরুদ্ধে জেলখানার মধ্যে অনশন ধর্মঘট করে।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে তিনি আইয়ুব খানের আমন্ত্রণে রাওয়ালপিন্ডি যান। এ কারণে এ সময় তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। ওই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি চীন সফরে যান। সফর থেকে দেশে এসে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করতে শুরু করেন।
এ সময়ও তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। ১৯৬৬-৭০ সাল পর্যন্ত কৃষক সমিতির ব্যাপক প্রসার গঠে।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বিরোধীতা করে তিনি বলেন, এটা সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত। এ চক্রান্ত জনগণকেই রুখে দাড়াতে হবে। ১৯৬৬ সাল থেকে শুরু করেন পাকিস্তান সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন।
এ আন্দোলন চলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। যেখানেই যান সেখানেই বলেন, জনগণের অধিকারের কথা। বলেন পুর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য স্বায়ত্ত্বশাসনের কথা।
১৯৬৮ সালের নবেম্বর মাসে মাওলানা ভাসানী জাতীয় রাজনীতিতে আবার কাণ্ডারীরূপে হাজির হলেন। ৫ ডিসেম্বর আইয়ুব খান ঢাকায় আসেন।
৬ ডিসেম্বর দিন ভাসানী পল্টনে এক জনসভায় বলেন, সমাজ পরিবর্তনের জন্য লড়াই-সংগ্রামের কোনো বিকল্প পথ নেই। আইয়ুব সরকার যদি আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভোটাধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে না দেয়, তাহলে আমরা পাকিস্থান স্বৈ-শাসকের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলবো। জনগণ এই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানান। ওই দিন এক অভূতপূর্ব ধর্মঘট পালিত হয়।
ওই ধর্মঘটে পুলিশের গুলিতে ২জন মারা যায় এবং শত শত আহত হয়। শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে ভাসানীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক দলের নেতারা পরদিন ৮ ডিসেম্বর আবার হরতালের আহ্বান করে।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদেরই সর্বোচ্চ ভূমিকা ছিলো। এই গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। এরপর ১৯৭০ সালে ভাসানী পাকিস্তান যান।
১৩ দিনে সেখানে ১২ টি জনসভা করে বক্তব্য রাখেন।
১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর ইতিহাসের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপর আঘাত হানে। ভাসানী শুরু করে দিলেন বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন ক্ষয় ক্ষতি। যা পারেন, যার কাছ থেকে যা এনে দেওয়া যায়_তা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করতেন।
কিন্তু পাকিস্তান সরকার নিস্প্রাণ। তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই_বন্যার্তদের নিয়ে। ক্ষেপে গেলেন মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ শেষে ঢাকায় এসে এক জনসভায় এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর কোনো দাবী নাই_পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা চাই।
১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে ভাসানীর বাড়িটা পুড়ে দেয় পশ্চিমা নরপশুর দল। ২৩ এপ্রিল তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় ও বেতারে একটি বড় আকারের বিবৃতি দেন। এই বিবৃতিতে মুক্তকামী জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে প্রায় তিন মাস পর্যন্ত তিনিই বাংলাদেশের পক্ষে সকল ধরনের বিবৃতি-বক্তব্য প্রদান করেন।
এরপর তিনি ভারতে যান। সেখানে তিনি নিরাপত্তার কারণে সসম্মানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে গৃহ বন্দী থাকেন।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের মানুষ পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত হয়। শেখ মুজিবের মুক্তির বার দিন পর ভারত থেকে মাওলানা ভাসানী দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। শেখ মুজিব ভাসানীকে পিতৃতুল্য সম্মান করতেন।
স্বাধীনতার পর ২ এপ্রিল পল্টন ময়দানে এক জনসমুদ্রের সমাবেশে মাওলানা ভাসানী ভাষণ দেন। ভাষণ বিভিন্ন দেশের সাহায্য—সহযোগীতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আরো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি। এই ভাষণে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন_যুদ্ধে নিহত সকল শহীদদের প্রতি।
স্বাধীন দেশে ন্যাপের জাতীয় সম্মেলন ১৯৭২ সালের ৯-১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।
এ সম্মেলনে ১১ দফা দাবি কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ওই সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী সভাপতি ও কাজী জাফর আহম্মদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭৩ সালের ১৪ মে ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি ১৫ মে থেকে ৩ দফা দাবির ভিত্তিতে আমরণ অনশন কর্মসূচির ঘোষণা দেন। কথা অনুযায়ী ১৫ মে সকাল ৮ টায় ন্যাপ কার্যালয়ে নেতা-কর্মী নিয়ে অনশন শুরু করেন। দল মত নির্বিশেষে সারা দিন মাওলানা ভাসানীকে হাজার হাজার মানুষ তাঁকে দেখতে আসে এবং তাঁরাও ওই কর্ম-সূচীতে সমর্থন জানায়।
এভাবে চলতে থাকে ১৬-২২ মে পর্যন্ত। ১৯ মে ভাসানী গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। ২২ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেশের রাজনীতিবিদরা তাঁর অনশন ভঙ্গ করায়। এত তৎকালীন সরকার বিব্রত অবস্থায় পড়ে। ১৯৭৪ সালের ১০ নবেম্বর ন্যাপের বিভক্তি ঘটে।
দুর্বল হয়ে পড়ে ন্যাপ।
জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে মাওলানা ভাসানী ১৯৭৪ সালের ৮ এপ্রিল নিজবাড়ি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ‘হুকমতে রব্বানিয়া সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর জুন মাসে তিনি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। যার কারণে ওই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁকে গৃহ বন্দী থাকতে হয়।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা বাধের বিরুদ্ধে ঐতহাসিক লংমার্চের নেতৃত্ব দেন।
ওই বছর ‘খোদাই খিদমতগার’ আরো একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। ওই তিনি ১৭ নবেম্বর ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।