১. লোকটি মাওলানা মতি। মুখে ছোট ছোট কাঁচা পাকা দাড়ি, মাথায় জিন্নাহ টুপি। সন্ধ্যা হলেই সফেদ পাঞ্জাবীর উপর জিন্নাহ কোট চাপিয়ে, হারকিউলিক্স ব্রান্ডের নতুন সাইকেলখানা চালিয়ে অক্লান্ত ছুটে চলেন এক পাকি ক্যাম্প থেকে আর এক ক্যাম্পে। পেল্লাই পেল্লাই গোঁফওয়ালা খানসাহেবদের সাথে কী সব সলাপরামর্শ করেন। মাঝে মাঝে হো হো শয়তানী হাসিতে কেঁপে উঠে টেবিলখানা।
চক চক করে উঠে মাওলানা মতির দুই চোখ। দুই হাতের তালু কচলাতে কচলাতে তাজিমের সাথে বিদায় নিয়ে ফিরে আসেন তিনি। নিঃশব্দে ছুটে চলে হারকিউলিক্স ব্রান্ডের নতুন সাইকেলখানা। আল বদর বাহিনীতে নাম লেখানোর পর এই সাইকেলখানা পেয়েছেন মাওলানা মতি। আরো পেয়েছেন একখানা পাঁচ ব্যাটারিওয়ালা টর্চলাইট আর একখানা থ্রি নট থ্রি রাইফেল।
নিঃশব্দে ছুটে চলে তার সাইকেলখানা। পাঁচ ব্যাটারিওয়ালা টর্চলাইটের বিদীর্ণ আলোয় বড় ভয়ংকর লাগে তার মুখের অবয়বটা।
এই বছর খানেক আগেও লোকটিকে অন্যরকম জানতাম। আমাদের মত যুবকদের দেখলেই এগিয়ে আসতেন। হাসিমুখে গল্প করতেন।
ইসলামের গল্প, নবীজীর গল্প, সাহাবা অলি আল্লাহদের গল্প। বদর যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ, খন্দকের যুদ্ধে ইসলামের বীরত্ব গাঁথা। আমি তন্ময় হয়ে তার গল্প শুনতাম। খুব ভালো লাগতো সেই গল্পগুলি। তিনি যখন গাজী সালাহউদ্দীনের গল্প বলতেন, উত্তেজনায় আমার শরীরের রোমকূপগুলো খাড়া হয়ে যেত।
ইশ! আমি যদি গাজীর মত বীর হতে পারতাম।
আমি বীর হতে পেরেছি কি না জানি না, তবে যোদ্ধা হয়েছি। আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমি আমার মাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি আমার বোনকে, বাবাকে, আমার দেশকে। আমি ভালোবাসি এই দেশের আকাশকে, বাতাসকে।
এই দেশের মানুষগুলো আমার আত্নার আত্নীয়। তাদের জন্য আমি মুক্ত আকাশ, স্বাধীন মাটি আর শিশুর নিষ্পাপ হাসি আনবোই।
মাওলানা মতিকে আমি খুব ঘৃণা করি। তিনি এখন হায়েনাদের দোসর, মানুষরূপী জানোয়ার, শয়তান। নিঃশব্দে ছুটে চলে হারকিউলিক্স ব্রান্ডের নতুন সাইকেলখানা।
তার সফেদ পাঞ্জাবীর বুক পকেটে বাঙালি যুবকদের নাম ঠিকানার ফর্দ। পাঞ্জাবীর ডান পকেটে সংখ্যালঘুদের আর বাম পকেটে বাঙালি বোনদের নামের লিস্টি। এখন আর তার কাছে কেও নিরাপদ নয়। নয় সে বাংলার হিন্দু, নয় সে মুসলমান। তিনি নতুন নতুন ফর্দ করেন, আর খানসাহেবদের ক্যাম্পে দিয়ে আসেন।
খান সাহেবদের দাক্ষিণ্য পেয়ে আনন্দে বিগলিত হয়ে উঠেন, চক চক করে উঠে তার দুই চোখ। দুই হাতের তালু কচলাতে কচলাতে তাজিমের সাথে বিদায় নিয়ে ফিরে আসেন তিনি। নিঃশব্দে ছুটে চলে হারকিউলিক্স ব্রান্ডের নতুন সাইকেলখানা। নিজের স্বজাতিকে হত্যার জন্য ধরে নিয়ে যান পাকি ক্যাম্পে, নিজের মা বোনকে তুলে দিয়ে আসেন পাকিদের ফুর্তির জন্য। হায়রে বাঙালি, হায়রে মুসলমান!
২. সাঁথিয়াতে আমাদের অপারেশনটি অবশেষে সফল হল।
পাকিদের ক্যাম্পের সবকয়টা সেনা মরছে। ওদের সবগুলো ভারি অস্ত্র আমরা অক্ষত পেয়েছি। পেয়েছি চার বাক্স আর্জেস গ্রেনেড, গোলা বারুদ আর সপ্তাহ খানেক চলার মত খাদ্য রসদ।
আমরা এখন দশ জন। দুই জন মারাত্নক আহত।
এক জনের বুকে আরেক জনের বাম পায়ে গুলি লেগেছে। একটু দূরে বন্ধু সাইফুলের লাশ পড়ে আছে। আহারে! আমাদের সাইফুল আজ লাশ হয়ে পড়ে আছে তার প্রিয় বাংলার মাটিতে। বাংলা মা পরম মমতায় সোঁদা গন্ধ মাখিয়ে দিয়েছে তার গায়ে। টগবগে প্রাণবন্ত যুবক সাইফুল লাশ হয়ে পড়ে আছে।
এই কি সেই ঢাকা হলের টগবগে সাইফুল! যার কথার ফুল ঝুরিতে চির সজিব থাকতো আমাদের আড্ডাগুলো। যার স্বপ্নময় বাংলাদেশের প্রত্যাশা আলোকিত করতো আমাদের ও। রক্তে মাখামাখি সাইফুলের শরীর, ক্ষতবিক্ষত সাইফুলের শরীর। ওর চোখ দুটি এখন ও খোলা। কি জানি, সেই চোখে হয়তো এখনো খেলা করছে স্বপ্ন স্বাধীন বাংলাদেশের।
যেখানে থাকবে না ক্ষুধা, অভাব, অবিচার। যেখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান সবাই ভাই ভাই, সবারই এক পরিচয়; আমরা সবাই বাঙালি।
সাইফুল আমিও তোর মত ভালোবাসি এই বাংলাদেশকে। আমাদের নেতা শেখ মুজিবকে। আমি সাইফুলের চোখদুটি বুজিয়ে দেই।
আমার কান্না চলে আসে। গত চার দিন এই এগারোটা মানুষ একবেলাও কিছু খায় নি। ক্ষুধা, মৃত্যু, শোক, বেদনার সাথে আমাদের নিত্য বসবাস। সাত কোটি বাঙালি আজ ক্ষুধিত, শোকার্ত, আশ্রয়হীন। আর কত রোগ, শোক, মৃত্যু, রক্ত আমাদের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন? আমার চোখে কান্না ঝরছে আঝোর ধারায়।
বাঁধনহারা এ কান্না।
সাইফুলের বুক পকেটে একটি চিঠি পাওয়া গেল। ওর মাকে লিখেছিল। রক্তলাল ছেঁড়া চিঠিখানা আমি পড়লাম, তারপর কবির ভাই, তপু, আমরা সবাই। এ চিঠি যেন আমাদের সবারই মনের কথা।
ওর চিঠি আমাদের সাহস দেয়, শক্তি যোগায়। আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে মাকে, প্রিয় বাংলা দুঃখীনি মাকে।
মা
কেমন আছ? আমি ভালো আছি। সবসময় তোমার কথা মনে পড়ে। বাবা কেমন আছে? বাবার প্রেশারটা কি বেড়েছে? সানু কি ঠিক মত পড়াশুনা করছে, না কি শুধু দুস্টমি করে বেড়ায়? তুমি খুব কস্ট পেয়েছ তাই না, মা? তুমি যুদ্ধে আসতে দিতে না, তাই পালিয়ে এলাম।
লক্ষী মা আমার! তুমি রাগ করো না। তোমার ছেলে স্বাধীন দেশ নিয়ে তোমার কোলে আবার ফিরে আসবে। আর যদি ফিরে না আসি, তবে সাত কোটি বাঙালি আর আমার নেতা শেখ মুজিবকে তোমার সন্তান ভেবে চির দিন ভালোবেসে যেও।
ইতি
তোমার সাইফুল
৩. এখন রাত সাড়ে নয়টা। তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছি মাকে দেখতে।
বাবা চিঠি পাঠিয়েছিল, মা খুব অসুস্থ। সাইফুলের মত আমিও পালিয়ে গিয়েছিলাম যুদ্ধে। মা আমার চিন্তায় চন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এই বুঝি তার সোনা মানিকের বুকে গুলি লেগেছে। এই বুঝি তার মানিকের জীবন নিভে গেছে।
আমার গ্রামটা আমি চিনতে পারছিলাম না। মাওলানা মতির আল বদর আর পাকিরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে গ্রামখানা। আমার পরিচিত সব মানুষজনকে ধরে ধরে নিয়ে লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে। লাশগুলোকে শকুন কুকুর দিয়ে খাইয়ে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে। বাড়ির পর বাড়ি পোড়া মাটি হয়েছে।
গ্রামের যুবতী মেয়েদের পাকি ক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার শেষে হত্যা করেছে। বাতাসে পোড়ামাটি আর লাশের গন্ধ। কান পাতলে এখনো শোনা যায় গ্রামের মেয়েগুলোর আত্নচিৎকার। হায়রে মাওলানা মতি, হায়রে মুসলমান।
মা আমার পাতে লাউ শাক আর ভাত তুলে দিচ্ছিল।
তখনই মাওলানা মতির পাঁচ ব্যাটারিওয়ালা টর্চলাইটের আলোয় আমাদের অন্ধকার বাড়িটা আলোকিত হয়ে উঠলো। মাওলানা মতি দড়জায় আঘাত করছে, হাসানের মা দড়জা খোল, শুনলাম তোমার ছাওয়াল নাকি ফিরছে, হাসান বাবাজীর সাথে একটু গল্প করতে এলাম, শেখ সাহেবের গল্প, বাংলাদেশের গল্প। মা তার বুকের মাঝে আমায় শক্ত করে আগলে ধরে, আমার সোনা মানিক, তোরে আমি মরবার দিমু না। পাকিরা দড়জায় বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারে, এই বুঝি দড়জা ভেঙ্গে যায়। আমার দুঃখীনি মা কাঁদে, আরো শক্ত করে বুকের মাঝে আগলে রাখতে চায়।
আমারও চোখে জল চলে আসে। মা আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।