আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পঞ্চদশ হলে ষোড়শ নয় কেন

কত দিন হয়ে গেল, প্রথম আলোয় আমার নিয়মিত কলামটি লেখা হয়নি! বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে, আসলে বর্জ্য পদার্থ জমা হয়েছে। তেমনটি ঘটেছে আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে। ঢাকার ল্যাবএইড আর হিল্লি-দিল্লি-সিঙ্গাপুর ঘুরে এসে শরীর অনেকখানি সুস্থ হওয়ার পরও অনেক দুর্ভাবনার জঞ্জালে ভরে আছে মস্তিষ্ক। জমাটবাঁধা জঞ্জাল পরিষ্কার না করেই প্রথম আলোর এ কে এম জাকারিয়ার তাগিদে কাঁপা হাতে কলম নিয়ে বসেছি। গত জানুয়ারিতে আমার শেষতম লেখাটি ছিল শাহবাগের জনতার মঞ্চ নিয়ে।

লেখাটি যতখানি ছিল বস্তুনিষ্ঠ অথবা বাস্তবানুগ, তার চেয়ে বেশি ছিল আবেগপ্রবণ। আমার মতো ৬০ বছরের সাংবাদিকতায় অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ব্যক্তি সেদিন বুঝতে পারিনি, এটি একটি নতুন এক রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়েছে।
অনেক কথার মাঝে সেদিন শাহবাগের আবেগাচ্ছন্ন অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সাবধান করে দিয়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তোমাদের এই বোধোদয় ও উচ্ছ্বাসের যেন রাজনৈতিকীকরণ না হয়। অচিরেই বুঝতে পারলাম, সেই যে আশঙ্কা প্রকাশ করে বাক্যটি লিখেছিলাম, শেষ পর্যন্ত তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বুঝতে পারলাম, এটি রাজনৈতিক একটি নতুন খেলা।

তারপর আর কিছুই লিখিনি। হাটহাজারীর একটি মাদ্রাসার ইমামের জায়নামাজের নিচ থেকে কারা এরই জের ধরে হেফাজতিদের রাজনীতির মাঠে আনল, তা বিলম্বে হলেও আমাদের সচেতন জনগণ এত দিনে বুঝে ফেলেছেন। বুঝতে পেরেছেন, যাঁরা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলে মুখে ফেনা তুলেছেন, দেশে সাম্প্রদায়িক তথা ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির নব অভ্যুদয়ের প্রকাশ তাঁদের কারণেই ঘটেছে। তবে আমি এই অশুভ প্রকাশকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না। কারণ, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে শত চেষ্টা করেও ধর্ম-উন্মাদনাকে বাঙালি মুসলমানের রাজনীতিতে কেউ স্থায়ী করতে পারেনি।

একসময় পশ্চিমা দেশগুলো থেকে, যেমন রাষ্ট্র ও দেশ পরিচালনার কর্তৃত্ব থেকে গির্জা আর রোমের পোপের আধিপত্যের অবসান ঘটেছে, তেমনি এ দেশের ধর্ম-পুঁজিবাদদের প্রভাব প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। এ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করলাম না। কারণ, জামায়াত ও হেফাজত নিয়ে চিন্তা-দুর্ভাবনা রাজনৈতিক দলগুলোর, জনগণের নয়। হেফাজত তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে প্রভাবান্বিত করবে না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, তাজরীন, হল-মার্ক আর ডেসটিনি নিয়ে আলোচনাও এখন বাসি।

এ নিয়ে ভবিষ্যতের নির্বাচনী দুর্ভাবনা ক্ষমতাসীন দলের, জনগণের যা বোঝার তা নির্দলীয় নির্বাচন হলে তখন ক্ষমতাসীন দলকে বুঝিয়ে দেবে।
এখন আমাদের ‘সময়ের প্রতিবিম্বে’ আমি এখন যে প্রতিচ্ছবিটি দেখতে চাই, তা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে, কারা করবে। এ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনা আর আশঙ্কা ও দুর্ভাবনা রয়েছে অনেক দিন ধরে। কারণ, কোনো একটি বিষয় নিয়ে সর্ববিস্তৃত ও সর্বগ্রাসী আলোচনা আমার বিগত দিনগুলোতে কখনো দেখিনি, শুনিনি বা বুঝতে হয়নি। কয়েক মাস ধরে অথবা এই বছরব্যাপী পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের বিজ্ঞজনদের আলোচনায় আসন্ন নির্বাচন কীভাবে হবে, কারা পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করবেন, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বলেই উপরোক্ত বক্তব্য দিলাম।

জনসাধারণ্যে রাজনীতিবিদ ও দলগুলোর মাঝে আলোচনায় (১) তত্ত্বাবধায়ক সরকার, (২) নির্দলীয় সরকার ও (৩) বিদ্যমান সরকার তথা সরকারপ্রধানের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। এসব নিয়ে আমি প্রথম আলোর কলামে কিছু না লিখলেও টেলিভিশনে অনেক কথা বলেছি। কোনো কোনো পত্রিকায় সাক্ষাৎকার আকারে কিছু মন্তব্য সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে।
এ নিয়ে মাস ছয়েক আগে চ্যানেল আইয়ে দর্শকপ্রিয় মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় আলাপচারিতায় বলেছিলাম, ‘দেশ গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে’। বক্তব্যটি নিয়ে অনেকের মধ্যেই আলোচনা আজও চলছে।

গৃহযুদ্ধ না হলেও আগামী সম্ভাব্য নির্বাচন নিয়ে সাধারণের মাঝে সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা বিরাজ করছে, সে ব্যাপারে জনগণ যে উদ্বিগ্ন, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। আমি অবশ্য এখন ভাবনার মোড় ঘুরিয়ে ভাবছি, ‘নির্বাচন আদৌ হবে কি না। ’ বর্তমান সরকারের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারিণী আদৌ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন অথবা প্রত্যাখ্যাত হওয়া নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন কি না? এ নিয়ে আমার প্রয়াত একজন মুরব্বির ভাষায় বলতে চাই, ‘মোটে মায়ে ভাতই রাঁধবে না, তার আবার তপ্ত আর পান্তা’।
সম্ভাব্য নির্বাচন নিয়ে যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের প্রায় সবারই বক্তব্য, তাঁদের মুখে, কথাবার্তায় ও দলীয় কার্যকলাপে যা বুঝতে পারছি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু বা সূক্ষ্ম-অসূক্ষ্ম একচেটিয়া কারসাজির আভাস স্বচ্ছ পাওয়া গেছে। এখানেই দেখা দিয়েছে আসল দ্বন্দ্ব, যা নির্বাচন অনুষ্ঠান অনিশ্চিত করেছে।

আবার, নির্বাচন যদি না হয়, নির্ধারিত সংবিধানে উল্লেখিত বিভ্রান্তির আগে বা পরের সময় সংঘাত-সংঘর্ষ কোন আকার ধারণ করবে? বিরোধী দল বলছে, তারা অতীতে তাদের নিজেদের প্রত্যাখ্যাত তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা পুনর্বহাল চায়। অন্যদিকে সংবিধানের তত্ত্বাবধায়ক-সংক্রান্ত ২ক পরিচ্ছেদ ৫৮ঘ ধারাটি আদালতের মাধ্যমে নাক দিয়ে এনে মুখে দেওয়ার মতো ব্যবস্থায় সংসদে সংশোধনের পর বাতিল হয়ে গেছে। সুতরাং সর্বশেষ প্লাস্টিক সার্জারি করা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হতে হবে অথবা অবশ্য করেই ছাড়ব।
আমি বিভিন্ন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের তথা আওয়ামী লীগ সরকারের এই বক্তব্যের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেছি। শুধু প্রশ্ন করছি, কোনো সংবিধান? পনেরো বার ব্যবচ্ছেদ অথবা প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে পরিবর্তিত, বিকৃত ও নিজস্ব ছাঁচে ঢালানো সংবিধান? সর্বশেষ এই কাজটি পঞ্চদশ পর্যায়ে করা বিধান নিয়েই সংঘাত-সংঘর্ষের অবসান নয় কেন? গৃহযুদ্ধ, সংঘাত, সংঘর্ষ ও হানাহানির আশঙ্কা দূর করার জন্য, ১৬তম বা ষোড়শবার করা যাবে না কেন? আওয়ামী সংসদ আদালতের দালান ঘুরিয়ে এনে পঞ্চদশটি তিন মিনিটে করেছে।

ষোড়শ বার করার জন্য আদালতের কাঁধে বন্দুক রাখার প্রয়োজন হবে না।
উপরিউক্ত পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আজকাল আয়োজিত সেমিনারে একটি চকিত মন্তব্য করেছিলাম, ‘পাঁচ মিনিটে বাকশাল করা গেলে তিন মিনিটে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা পুনর্বহাল করা যাবে না কেন?’ মন্তব্যটি বেশ সাড়া জাগিয়েছে, তা আমি বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। ‘পাঁচ মিনিটের’ বাকশাল মন্তব্যটির ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য আমি পরবর্তী নিবন্ধে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করব। তার চেয়ে বরং অন্য একটি প্রশ্ন করা যেতে পারে। জনতার দাবি মেনে নিয়ে, দাবি আদায়ের জন্য সহিংসতা বিস্তারের আগেই বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাটি সাত দিন স্থায়ী সংসদের মাধ্যমে সংযোজন করে সংশোধন করতে সংসদে কত মিনিট লেগেছিল? পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ-সর্বস্ব সংসদে যে ধারাটির দোহাই দেওয়া হচ্ছে, সেই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলোপ করতে কত মিনিটে লেগেছে?
এতক্ষণ যা আলোচনা করলাম, তার ভিত্তি হচ্ছে, একটি সাধারণ নির্বাচন বা এজাতীয় কিছু একটা হবেই এমন একটি ধারণা থেকে।

সেটি যদি বর্তমান সরকারের তথা দেশের বর্তমান শাসনকালের সর্বময় ক্ষমতার মালিক শেখ হাসিনার অধীনে হয়, অথবা যেনতেন প্রকারে হেন-তেনভাবে বর্তমানে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন করেই ফেলেন, তবে কেমন হবে? আমাদের দুই প্রধান নেত্রী এই ‘যেনতেন’ প্রকার নিয়ে বাগ্যুদ্ধ থেকে চুলোচুলির পর্যায়ে আলোচনাকে নামিয়ে এনেছেন। একজন বলছেন, প্রকার যা-ই হোক, নির্বাচন আমি করেই ছাড়ব, আরেকজন বলছেন, করতেই দেব না। একজন বলছেন, চুল ছিঁড়ে ফেলবেন আরেকজন চুল উড়িয়ে দেবেন।
জাতির জন্য কী লজ্জা! এ যেন দুই সম্মানীয় নেত্রীর রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, দুই অশিক্ষিতা গ্রামী মহিলার কোমরে আঁচল বেঁধে ঝগড়া। যা হোক, ক্ষমতাসীন দল ‘যেনতেন’ প্রকারে নির্বাচনজাতীয় প্রহসন হয়তো মঞ্চস্থ করতে পারবে।

আরেকজন আপাতত ঠেকাতে পারবেন না। কিন্তু যাঁরা করে ফেলবেন, পরবর্তী পরিস্থিতি সামলাতে পারবেন কি? বিগত বেগম জিয়ার সরকারও ‘যেনতেন’ নিজস্ব পরিকল্পনায় ছকবাঁধা পথে এগিয়েছিল। কিন্তু সেই পথের শেষ সীমায় পৌঁছতে পারেনি। এতৎসম্পর্কীয় একটি উদাহরণই যথেষ্ট। জেনারেল জিয়ার সঙ্গে খাল কেটে যাঁরা বিশ্বাসভাজন হয়েছিলেন, ছকবাঁধা প্রকারে নির্বাচন করার জন্যও বেগম জিয়া বিশ্বস্ত নিজস্ব আমলা-কর্মচারীদের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়েছিলেন।

তাঁদেরই শীর্ষস্থানীয় জিয়াউর রহমানের উচ্চপর্যায়ের খালকাটা আমলা ‘জনতার মঞ্চে’ যোগ দিয়ে বেগম জিয়ার ছকটি ওলট-পালট করে দিলেন। শেখ হাসিনা একইভাবে প্রশাসনকে, একইভাবে নির্বাচন কমিশনে আরেকজন সাদেক-আজিজ বসিয়ে ছক কাটছেন। নির্বাচনে তাঁদের যথেচ্ছ প্রয়োজনে ব্যবহার করার ইচ্ছা পূরণে ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে অনেকের ধারণা। তিনি কি বেগম জিয়ার আমলের উদ্ভূত পরিস্থিতি স্মরণে এনে বুঝতে পারছেন না, যাঁদের ওপর নির্ভর করছেন তাঁরা যেদিকে বৃষ্টি সেদিকে ছাতা ধরবেন? ছাতা কোন দিকে ধরতে হবে, তাঁরা সবার আগেই বুঝতে পেরেছেন। সেটি বোধ হয় ‘করেই ফেলব’ চিন্তাধারীরা বুঝেও বুঝছেন না।


এত সব সত্ত্বেও ধরে নিচ্ছি, পরিকল্পনামাফিক নির্বাচনের পথে শেখ হাসিনা জেদ বজায় রাখতে এগিয়ে যাবেন। অথবা ‘পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা গ্রহণ না করা পর্যন্ত’ তিনি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন, পঞ্চদশ সংশোধনী পড়ে যতটুকু বুঝেছি, তাতে মনে হতে পারে, তিনি শেষ পর্যন্ত বেগতিক দেখলে সংবিধানের এই কৌশলী ধারাটির সুযোগ নিতেও পারেন। যদি তিনি তা করেন, তবে কী যে হবে ‘আল্লাহ মালুম’ আর মালুম এই দেশের রাজনীতিসচেতন জনগণের। এই মালুমটি আইয়ুব, ইয়াহিয়া, এরশাদ ও খালেদা পারেননি, হাসিনা পারবেন? স্মরণ করতে পারছেন না? তবে নির্বাচন কমিশন মনে হয় মালুম করে ফেলেছেন।
কেন এই কথাটি উল্লাস? শুক্রবারের দৈনিক পত্রিকার একটি খবরের শিরোনাম, ‘নির্বাচন চলাকালীন আক্রান্ত কর্মচারী ও কর্মীদের ক্ষতিপূরণ দেবে ইসি’।

নিহত পাবেন পাঁচ লাখ, গুরুতর আহত এক লাখ টাকা। শেখ হাসিনার ‘নির্বাচন করবই’ আর খালেদা জিয়ার ‘হতে দেব না’ বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে পাঠকদের এই বিচিত্র খবরটির তাৎপর্য নিয়ে একটুখানি চিন্তাভাবনা করতে অনুরোধ জানাই। আমি ভাবছি, দুই প্রধান রাজনৈতিক দল তাদের
কর্মী বা মাস্তানদের জন্য এমন কোনো বরাদ্দ রেখেছে কি না।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.