সাংবিধানিকভাবে বর্তমান এমপিদের জন্য তিনটি মৌলিক সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, সংসদ সদস্যপদ লাভজনক হওয়ায় এ পদে থেকে বর্তমান এমপিরা নির্বাচন করতে পারবেন কি না? দ্বিতীয়ত, কোনো আসন শূন্য হওয়ার আগে ওই আসনে নির্বাচন করা যায় কি না? তৃতীয়ত, একজন এমপির জায়গায় আরেকজন এমপি নির্বাচিত হতে পারেন কি না?
এ নিয়ে সম্প্রতি একজন নির্বাচন কমিশনার সাফ জানিয়ে দিলেন যে সংসদ ভাঙার কোনো দরকার নেই। বর্তমান সংসদ সদস্যরা পদে থেকেই আগামী দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তিনি আরও দাবি করেন, সংবিধানের ৬৬(২)(চ) অনুচ্ছেদমতে সংসদ সদস্যের পদটি প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদ নয়। তাই এ অনুচ্ছেদের আওতায় বর্তমান সংসদ সদস্যরা সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার জন্য অযোগ্য নন।
নির্বাচন কমিশনার মহোদয় কর্তৃক সংবিধানের এই ব্যাখ্যা অবশ্যই সাংবিধানিক আইনের ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। যদিও সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কেবল সুপ্রিম কোর্টই সংবিধানের ব্যাখ্যা করতে পারেন। আর নির্বাচন কমিশন তার ওপর অর্পিত সংবিধানপ্রদত্ত ক্ষমতা অনুসারে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার অধিকার রাখে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার মহোদয়ের এই মহৎ ভূমিকা পালনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর নতুন সংযোজিত ৬৬(৩) অনুচ্ছেদটি।
কেননা এ অনুচ্ছেদে খুবই পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, 'এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনকল্পে কোন ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।
'অর্থাৎ আলোচ্য ৬৬(২)(চ) এবং নতুন সংযোজিত ৬৬(৩) অনুচ্ছেদটি মিলিয়ে পড়াটাই সংবিধানকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে অধিকতর শ্রেয় হবে। আর এতে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে ৬৬(২)(চ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে থেকে কেউ সংসদ নির্বাচন করতে পারবেন না। আবার নতুন সংযোজিত ৬৬(৩) অনুচ্ছেদটি লাভজনক পদে থেকেও যারা নির্বাচন করতে পারবেন তাদের একটি লম্বা তালিকা প্রদান করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই তালিকায় এমপিদের কথা নেই। এ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের এই বিশেষ সুবিধাটি দেওয়া হয়নি।
এ হিসেবে সংসদ সদস্যপদকে লাভজনক বলতে কোনো বাধা নেই। তবে এটাও সত্য যে সংসদ সদস্যপদ লাভজনক কি না তা নির্ধারণে সংবিধানে বা অন্য কোনো আইনে এমনকি ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতেও সুস্পষ্টভাবে কিছুই বলা নেই।
তবে '৭৩ সালের সংসদ সদস্যদের বেতনভাতা আদেশ নামক আইনের আওতায় গত চলি্লশ বছর ধরে আমাদের একেকজন সংসদ সদস্য তাদের ক্ষমতার পাঁচ বছরে ৭৯ লাখ ৫ হাজার টাকা করে এমপি হিসেবে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে বেতন নিচ্ছেন। সঙ্গে আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা ও ভাতা তো রয়েছেই। অনেকে হয়তো যুক্তি দেখাবেন যে একই বিবেচনায় তো রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা মন্ত্রীরাও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতনভাতা নিচ্ছেন।
তাহলে তারা নির্বাচন করতে পারলে সংসদ সদস্যরা পারবেন না কেন? এর উত্তরটা পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৬৬(৩) অনুচ্ছেদেই বর্তমান এমপি সাহেবরা নিজেরাই দিয়ে দিয়েছেন। আরও মজার ব্যাপার হলো, বর্তমান এমপি সাহেবরাই এ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা মন্ত্রীদের নির্বাচনে যোগ্যতার সনদ দিলেও নিজেদের বেলায় নির্বাচন করতে এরূপ কোনো বিধান রাখেননি। হয়তো তাদের মাথায় কিংবা সংসদের নজরে তখন সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদটি ছিল না।
কেননা সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ মতে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন হবে এবং বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা কার্যভার গ্রহণ করতে পারবেন না। অর্থাৎ এমপি সাহেবরা সংসদ সদস্যপদে থেকেই নির্বাচন করবেন।
তখন একই সময়ে একই আসনে দুজন এমপি থাকবেন। এ অবস্থায় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি একেবারেই অসম্ভব হয়ে যাবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বর্তমান যেসব এমপি মনোনয়ন পাবেন না তারা মনোনয়নপ্রাপ্ত দলীয় প্রার্থীদের কোনোমতেই জিততে দেবেন না। এতে বৃহৎসংখ্যক আসনে সরকারি দলের প্রার্থীরা নিজ দলের এমপিদের কাছে অসহায় হয়ে যাবেন।
আসলে লাভজনক পদে আসীন ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন কি না তা সেই ১৭০১ সালে ব্রিটেনে অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্টের পর থেকেই আইনি বিধান হিসেবে বিবর্তিত হয়ে আসছে বিশ্বব্যাপী।
মূলনীতি একটাই, রাষ্ট্রের লাভজনক পদে থেকে নির্বাচন করার আইনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। কেননা ইংল্যান্ডেও রাজার অধীনে লাভজনক পদে থেকে কেউ সংসদ নির্বাচন করতে পারেন না। আমেরিকার সংবিধানের ১(৬)(২) অনুচ্ছেদ, অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ, এমনকি ভারতের সংবিধানের ১০২(১)ক অনুচ্ছেদসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশের সংবিধানেই এ একই রকমের বিধান দেখতে পাওয়া যায়।
তাই আবারও বলছি, একমাত্র সুপ্রিম কোর্টই সংবিধানের কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কোনো একজন নির্বাচন কমিশনার সংবিধানের এ রকম জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার নিজের মনগড়া ব্যাখ্যা জনগণকে চাপিয়ে দিতে পারেন না।
ভারতসহ পৃথিবীর বহু দেশে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট আইনের বিধান এবং এমনকি স্বতন্ত্র আইন পর্যন্ত রয়েছে। তাই বর্তমান সংসদের শেষ অধিবেশনেই সংবিধানের ৬৬(৩) অনুচ্ছেদটি সংশোধন করার সুযোগ রয়েছে। কিংবা প্রয়োজনে এ অধিবেশনেই এ বিষয়ে স্বতন্ত্র একটি আইন পাস করে এমপিদের এই মহাসংকট দূর করা যেতে পারে। এটা সম্ভব না হলে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স চেয়েও এর সমাধান করা যেতে পারে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই সংসদ ভাঙার কথা বলছেন।
অথচ সংবিধানের ৫৭(২) অনুচ্ছেদ মতে প্রধানমন্ত্রী শুধু সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারালেই কেবল সংসদ ভাঙার জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপিরা প্রধানমন্ত্রীর ওপর সমর্থন ফিরিয়ে নেবেন বলে বিশ্বাস হয় না। আর তা সম্ভব হলেও ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে এটা সম্ভবপর নয়।
তাই এ ক্ষেত্রে বর্তমান এমপিদের নির্বাচন করতে সাংবিধানিক সংকট তো খুবই দৃশ্যমান। একে তো সংসদ রেখে নির্বাচন করলে বর্তমান এমপিরা নির্বাচন করতেই পারবেন না।
অন্যদিকে ৫৭(২) ও ৭০ অনুচ্ছেদের খড়গে প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভাঙতেও রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারবেন না। সংসদ থাকলেও সমস্যা। আর ভাঙতেও সমস্যা। এ উভয় সংকটের একটাই সমাধান। সংসদ সদস্যরা নিজেরাই যদি সংসদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।
লেখক : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ
e-mail : malik.law.associates@hotmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।