আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নয়নের কী হবে?

আমি বাংলার গান গাই আমি বাংলায় গান গাই আমি আমার আমাকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই

সাত বছরের নয়নকে নিয়ে যখন তার এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে পৌঁছালাম তখন বিকেল ৬টা। ছোট বাজারের অপরিসর রাস্তা দিয়ে আমাদের বহন করা কারটি যখন এগিয়ে চলেছে এমন সময় কানে ভেসে আসল ‘আরে এ যে সেই রাজা মাস্তান’। মুহূর্তেই নয়নের ঘাড় ঘুরে গেল আওয়াজের উৎস সন্ধানে। ইতিমধ্যেই বাজারের ব্যস্ত মানুষগুলোর অধিকাংশই পিছু ধাওয়া করে চলে এসেছে পরিষদের মাঠে। সেখানে নয়নকে কার থেকে মাত্রই নামানো হল।

চারপাশ থেকে ছুটে আসছে বিরতিহীন প্রশ্ন ‘কিরে কোথায় ছিলি, গেছিলি কই, বারবার এইপাল হারাইলেতে আর ফিরগে আইতে পারবি না’ ইত্যাদি। যার একটিরও জবাব না দিয়ে উৎসুক জনতার মধ্যে নিজের স্বজনদের খুঁজে ফিরছিল সাত বছরের অবুঝ শিশুটি। নয়নের বাড়ি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নে। আরো ছোট থাকতে মা অন্য এক লোকের সাথে পালিয়েছে। বাবা আরো একটি বিয়ে করে সেই স্ত্রীর সাথে ঢাকায় থাকে।

শেষপর্যন্ত দাদিই হয়ে ওটেন তার শেষ ভরসাস্থল। কিন্তু, নয়নের শিশুসুলভ আচরণে ‘অতিষ্ঠ’ দাদি আর ছোট ফুফু তাকে নানা বকাঝকা করে। বিরক্তির মাত্রা বেড়ে গেলে বা নিজেদের মনমেজাজ খারাপ থাকলে দাদি-ফুফু দু’এক ঘা বসিয়েও দেয় তার পিঠে। নিয়মিত বিরতিতে বাবা বাড়ি ফিরলেও কখনো আদর করে তাকে কাছে ডাকেনি। বরং যে ক’দিন বাবা বাড়িতে অবস্থান করেন সে ক’দিন নয়ন ধারাবাহিক নির্যাতনের শিকার হয়।

এভাবে নির্যাতন আর অবহেলা নয়নকে বাড়ির প্রতি আস্থাহীন করে তোলে। পর পর দু’বার সে বাড়ি থেকে চলে যায় অজানার উদ্দেশ্যে, আবার নজে নিজেই ফিরে আসে ১০/১৫ দিন পর। কিন্তু, নয়নের এবারের যাত্রাটি ছিল দীর্ঘ। কবে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছে তা ঠিকমত কেউই বলতে পারেনি। তবে যে মানুষটি নয়নকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেই জহিরুল ইসলাম জানিযেছেন ১৪ এপ্রিল ২০০৯ সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গা জেলাধীন আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনে তিনি নয়নকে পেয়েছিলেন।

জহিরুল বাড়ি আলমডাঙ্গা উপজেলার বাড়াদী গ্রামে। তিনি পেশায় একজন ভ্যানচালক। তিনি জানান, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় একটি ভাড়া নিয়ে রেলস্টেমনে যান। সেখানে নয়ন তার কাছে খাবারের জন্য হাপ পাতলে তিনি জানতে চান বাড়ি কোথায়। এসময় সে কোন সদুত্তর দিতে পারেনি।

তার সাথে যাবে কিনা জহিরুল জানতে চাইলে নয়ন সাথে সাথে রাজি হয়ে যায় এবং সে জহিরুলকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে থাকে। নয়নকে যখন পাওয়া যায় তখন তার সারা শরীরে ঘাঁ-পাচড়া ছিল এবং পাটকাঠির মত শরীরের সকল হাড় গোনা যাচ্ছিল-বলেছেন জহিরুলের এলাকার এক মেম্বর। তারপর জহিরুল তাকে খাইয়ে, চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেছেন। মাঝেমধ্যে তার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী নয়নের পিতামাতাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। আর একাজ করতে যেয়ে উপার্জনক্ষম একটিমাত্র ভ্যানরিকশাটিও বিক্রি করে এখন জহিরুল নিঃস্ব।

কিন্তু, নয়নের পরিবারের কোন খোঁজ তিনি করতে পারেননি। মাঝে স্থানীয় এক পত্রিকায় এ সংক্রান্ত রিপোর্ট চাপা হলেও কেউ নয়নের সন্ধানে জহিরুলের বাড়িতে আসেনি। এই পত্রিকাটি নিয়ে একদিন দুপুরে যশোর আসে জহিরুল। সেখানে আমার সাথে আলোচনার পর আমি তার কাছথেকে বিস্তারিত জানতে পারি এবং আমি যে সংস্থায় চাকরি করি সেই সংস্থার পক্ষ থেকে নয়নের পরিবারের খোঁজ নেওয়া হয়। ৩০ আগস্ট রোববার নয়নকে নিতে যখন জহিরুলের বাড়ি যায় তখন সেখানে কয়েক’শ মানুষের ভিড়।

সকলের চোখেই পানি। কয়েকটি মাস এসকল মানুষই নয়নকে আগলে রেখেছিলেন মায়ার বন্ধনে। এসময় নয়ন বিভিন্নভাবে বিরক্ত করলেও কেউ তার প্রতি কোন রূঢ আচরণ করেনি। কেউ মুড়ি, কেউ চিড়ে, কেউ বাতাবি লেবু আবার কেউ নগদ টাকা নিয়ে এসেছে নয়নকে বিদায়ী উপহার দেবে বলে। কিন্তু একি এত লোকের ভিড়ে নয়নের ‘আব্বা’ জহিরুলকে দেখা যাচ্ছে না কেন! সেনা থাকলে বা তার অনুমতি ছাড়াতো নয়নকে তার বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়ে যেতে পারবো না।

‘জহিরুল ভাই কই’ জানতে চাইলে তার মা জবাব দিলেন, ‘এই একটিমাত্র ছেলেটার জন্য আজ জহির পথের ফকির হইছে। তার পরও সে তরে ত্যাগ করে নাই। এখন যাইবার কালে সহ্য করতে পারবোনা বলেই সে বাড়ি থেকে চলে গেছে। ’ সকলের ভালবাসা, স্নেহাশীষ আর আবেগকে সাথে নিয়ে নয়ন চেপে বসল আমাদের গাড়িতে। উদ্দেশ্য বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ নয়নের বাড়ি।

দু’কিলোমিটার দূরে বন্ডবিলা বাজারে আসতেই দেখি হাতে একটা কাগজের ঠোঙা নিয়ে দাড়িয়ে আছেন জহির। গাড়ি থামিয়ে নিরাবেগী কন্ঠে বললেন ‘ছেলেটার স্যান্ডেল ছিড়ে গেছিলতো তাই কিনতে আইছিলাম। ওরে একটু দেখে রাখতি কবেন। বড় দুষ্টু ছেলে। ’ গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পর পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ঘাড়ের গামছা দিযে চোখ মুছছেন জহির।

রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের মেম্বর ওদুদ এবং সাহিদার মাধ্যমে নয়নকে যখন তা দাদির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল তখন ঝাঝালো কন্ঠে তার দাদি বলে উঠলেন ‘এই হাামজাদা পোলা এতদিন কোথায় ছিলি। থাবড়ায়ে দাতের সুদ্ধ উপড়ায়ে ফালামু’। দ্রুত তাকে থামিয়ে দিয়ে ওয়াদুদ মেম্বর বলে উঠলেন ‘এই জন্যই তো তোমাগো পোলাপানরা হারায়ে যায়। ’ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নয়ন আর তার দাদিকে নিয়ে যখন ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম তখন সবার আগে নয়ন। সেই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

‘এই খালে আমার দাদা ডুবাইয়া ডুবাইয়া চিংড়ি ধরতো, এই তালতলা বাজারে আইলে আমি মিডাই কিনতাম, এই ঘাডে আমরা গোসল হরছি, এইডা আমাগো দোকান’ ধারা বিবরণীর মত নিজের বাড়ির এলাকার পরিচয় উপস্থাপন করতে করতে হেটে চলেছে সে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সাকোর উপর বসে থাকা সমবয়সী তিনটি ছেলেকে দেখে বললো এই ্মার দোস্ত। কাছাকাছি আসতেই ছেলেদের মধ্যে একজন বলে উঠল ক্যাডা, নয়ন না! এই এদিকে আয়। কিন্ত, তাদের দিকে না তাকিয়ে, নয়ন হেটে চলে গেল বাড়ির উঠানে। রান্না ঠেলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসলেন নয়নের ফুফু, চাচি আর অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরা।

পেছন পেছন বাড়িতে ঢুকলেন তর দাদি। কিন্ত, হারানো নয়নকে ফিরে পেয়ে করো মধ্যেই আবেগতো দূরের কথা বাড়তি কোন উৎসাহও লক্ষ্য করা গেল না। এরই মাঝে নয়ন এক শিশুকে নিয়ে বাগানের দিকে ধাবিত হল। আমরা ফিরে আসলাম আমাদের গন্তব্যে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।