গতদিন আমরা কাজে কর্মে সদাচারণ নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার নিজের প্রতি সদাচারণ। নিজের প্রতি সদাচারণ আবার কি জিনিস? বলবেন আমি আবার আমার সাথে কি অসাদাচারণ করলাম? আমি তো আমিই আছি, খাই, দাই, ঘুমাই, কাজ করি। আমি অপরের সাথে কি আচরণ করলাম সেটা হলো কথা। নিজের সাথে আচরণটা করবোই বা কিভাবে, আর সেটা খারাপ ভালোই বা হবে কিভাবে।
আচ্ছা ভাবুন তো , আপনি পরীক্ষায় খারাপ করেছেন। আপনার মেজাজ মর্জি ভালো নেই। আপনি রাগ হয়ে একবেলা দু'বেলা খাবার গ্রহন করলেন না। তাহলে কি হলো? আপনার শরীর খারাপ হবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। অথচ এখানে আপনার শরীরের কোন দোষ ছিল না।
বরং আপনার যে শরীর এটাকে ভালো রাখা আপনার একটা অন্যতম প্রধান কাজ।
আসলে এই যে শরীর, মন , আত্মা- এগুলো হচ্ছে আমাদের প্রতি স্রষ্টার প্রদত্ত অনন্য নেয়ামত। এগুলোকে ঠিক রাখা আমাদের প্রধান দায়িত্ব। এবং যখন এই দায়িত্ব অবহেলা করি আমরা - তা যে কোন কারনেই হোক না কেন , তখন এটাই নিজের প্রতি অসদাচারণ। তাহলে সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি- নিজের জন্য ক্ষতিকর যে কোন কাজই নিজের প্রতি অসদাচারণের পর্যায়ে পরে।
তাহলে আমরা কিভাবে বুঝবো যে আমি নিজের প্রতি সঠিক আচরণটি করছি না? যখন আপনি দেখবেন যে আপনার শরীর ও মন ঠিকভাবে চলছে না, কাজ করছে না , তখন বুঝতে হবে আপনি অসদাচারণ করছেন নিজের প্রতি। আসলে বাহ্যিকভাবে অনেক কাজ আমাদের নিজের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করে করলেও, তা কিন্তু আমাদের জন্য ক্ষতির কারন হতে পারে। কিছু উদাহরণ দেখুন। যেমন:
ঃ ক্ষুধা লাগলো, আমরা পেট পুরে এক গাদা ফাস্টফুড খেলাম, ভাবলাম শান্তি পেয়েছি। কিন্তু পেটের ভেতরের খবর যদি নেন ।
দেখবেন সেখানে যন্ত্রনা শুরু হয়েছে যা আমরা খেয়াল করিনি।
ঃ ঘুম আসছে তাই ঘুমাচ্ছি এবং ঘুমাচ্ছি। সকাল ১১টার আগে ঘুম ভাঙে না। কি হবে? শরীরের ১২টা বাজতে শুরু করবে। কিছুদিন পর এই শরীর আর চলবে না।
ঃ মনের ক্ষণিক আনন্দের জন্য ড্রাগ গ্রহন করা এটাও একটা নিজের প্রতি চরম অবিচার-অসদাচারণ। আর ড্রাগ গ্রহনকারীর পরিণতি তো আমরা জানিই।
ঃ সাধারণ বায়োলজিকাল নিয়ম, রাতে ঘুম ,দিনে কাজ বাদ দিয়ে সারারাত কাজ দিনে ঘুম - এটা যতই প্রয়োজনীয় মনে করি না কেন পরিণতিতে খারাপ হিসাবেই দেখা দেবে। দু'একদিন যেটা হয় , সে কথা আলাদা, কিন্তু অপ্রয়োজনীয় ভাবে নিজে নিজেই নিয়ম করে নেয়া ঠিক নয়। নিজে নিজে যে কোন নিয়ম করে নেয়ার ক্ষমতা প্রকৃতি আমাদের দেয়নি।
ঃ বর্তমান যুগে যেটা দেখা যাচ্ছে সারাদিন টিভি বা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকা, প্রয়োজন থাক বা নাই থাক। চোখের যেমন বারোটা বাজছে , তেমনি বারোটা বাজছে শরীরের। এমনি নানা উপায়ে আমরা রীতিমত আমাদের শরীরকে জুলুম করছি। এটা নিজের শরীরের প্রতি অসদাচারণ।
আবার দেখুন- আমাদের মনের প্রতিও আমরা নানাভাবে অসদাচারণ করছি ।
আমরা যখন আমাদের নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে চাই না , তখনই আমরা আমাদের মনের প্রতি অবিচার করি। আমরা জানি এই জিনিসটা আমাদের জন্য ভালো আর এই জিনিসটা খারাপ। কিন্তু জেনেও যখন খারাপ কাজটা করি বা খারাপ জিনিসটা গ্রহন করি , তখন আমাদের মনে একটা দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। আর এই দ্বন্দ আমাদের মন খারাপের কারণ হয়। সেখান থেকে দু:খ কষ্ট রাগারাগি ইত্যাদী।
যেমন ধরেন আমি জানি সিগারেট খাওয়া ক্ষতিকর। তবু আমি খাচ্ছি। এতে শরীরের কথা বাদ দিলেও -মনের যে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া তা ক্ষতিকর তো বটেই।
আবার আমরা যখন যে বিষয়টাকে গ্রহণ করা ছাড়া কোন উপায় নাই, সেটাকে গ্রহন করতে পারি না- তখনও মনে এক ধরণের দ্বন্দের সৃষ্টি হয়। যেমন: মায়ের অসুস্থতা, যা আমি মেনে নিতে পারছি না।
এটা আমার মানসিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু যা হয়েছে তা আমাদের মেনে নেয়া এবং তদানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করাই কিন্তু সর্বোত্তম কল্যাণকর কাজ, মনের জন্যও , দেহের জন্যও। এমনি করে আপনি খুঁজলে পাবেন আরো কি কি ভাবে আপনি নিজের মনের প্রতি অন্যায় করছেন।
এমনি নানাভাবে আমরা আমাদের মন ও দেহেরে ক্ষতি করে চলছি। এটাই আসলে নিজের প্রতি অসদাচারণ।
আর এগুলো থেকে বিরত থেকে প্রকৃতিগত বিজ্ঞান সম্মত আচার আচরণ হচ্ছে নিজের প্রতি সদাচারণ। আপনি হয়তো ভাবছেন , এত চিন্তা ভাবনা করে কি লাভ- যেমন আছি ভালোই আছি। অত কিছু মেনে চলতে পারবো না। তাহলে একটু হাসপাতালগুলো ঘুরে আসুন । বিশেষ করে এই যুগে বয়েস ৪০ পেরোতে পারে না , এর মধ্যেই হার্ট লিভার কিডনী - নানারকম অসুখে শয্যাশায়ী।
এবং এ সকলের মূল কারণ ঐ একটাই । নিজের প্রতি সঠিক বিচার বা সদাচারণ না করা।
আসলে সুন্দর সুস্থ ভাবে চলতে হলে নিজেকে শুদ্ধ করতে হবে। জীবনটা শুধু যৌবনের এই কয়েকটি দিনই নয়। এর পরিধি আরো বিস্তৃত।
নিজেকে শুদ্ধ করার ব্যাপারে কোরআনের একটি আয়াত দিয়ে শেষ করছি :
' হে মুমিনগণ! আত্মরক্ষাই (আত্মশুদ্ধি) তোমাদের কর্তব্য । যদি তোমরা সৎপথে পরিচালিত হও, তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর প্রতিই তোমাদের সকলের প্রত্যাবর্তন। অত:পর তোমরা যা করতে তিনি সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে অবহিত করেন। ' - সুরা মায়িদা, আয়াত-১০৫।
(গত পোষ্টের পরে এক ভাই মন্তব্য করেছেন যে ধর্ম ছাড়া এই লেখাগুলো লেখা যায় কিনা। ধর্মীয় লেবাসটা না আনার ব্যাপারে তিনি বলেছেন এবং বলেছেন অন্য ধর্মে কি এই জাতীয় কথাগুলো নেই? এই ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো: অবশ্যই অন্য ধর্মেও এই কথাগুলো আছে। ভালো কথা সকল ধর্মেরই মূল। সব ধর্ম মানুষের সুন্দর আচরণের ব্যাপারে একই কথা বলে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন ধর্মকে ছোট বা বড় করি না।
তবে আমি যেহেতু আমার ধর্ম সম্বন্ধে কিছুটা জানি এবং চিনি তাই আমি আমার ধর্মের কথাগুলো উদ্ধৃতি হিসাবে দেই । অন্য ধর্মের উদ্ধৃতি জানলে আমি সেগুলোও দিতাম। কারণ ধর্মের এই কথাগুলোই আমাকে এই বিষয়গুলো ভাবতে শিখিয়েছে। সুতারং আমি মু্ক্তমনে ধর্মকে উদ্ধৃত করতে ভালোবাসি। আশা করি আপনারাও মুক্তমনে ধর্ম এবং এই বাণীগুলো সম্বন্ধে চিন্তা করবেন।
)
ধন্যবাদ সবাইকে। পরবর্তিতে আমরা আমাদের গৃহে সদাচারণ নিয়ে আলোচনা করবো ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।