শুচি সৈয়দ
প্রসঙ্গ তত্ত্বাবধায়ক সরকার
যে প্রশ্নের জবাব প্রয়োজন
স¤ž্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনির€জ্জামানের একটি সাাৎকার পড়ার সুযোগ হল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে তার এই সাাৎকারটি খুবই সময়োপযোগী। একজন সাবেক রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে অধ্যাপক তালুকদার মনির€জ্জামানকে ধন্যবাদ জানাই। যখন সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার বলে নিজেকে দাবি করবার পাগলামির প্রতিযোগিতায় মত্ত তখন খুব ¯žষ্ট এবং ঋজুতার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার বিপে বলার সাহস একজন স্বŽছ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরই থাকা সম্ভব। এই অযৌক্তিক ধারণার বিপে একজন সৎ এবং স্বŽছ রাজনৈতিক কর্মীও দাঁড়াতে পারেন- কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক কর্মীদের যে মান সেই মানে (অর্থাৎ চিলে কান নিয়ে গেছে, দৌড়াও চিলের পিছে) এই ভূমিকা গ্রহণ সম্ভব নয়।
গত ভোটের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিলে আমি একটি অভিন্ন শ্লোগান শুনেছি শুধু নেতার নাম পাল্টানো সেটা হŽেছ এই : ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার/শেখ হাসিনা রূপকার। ’ (আওয়ামী লীগের মিছিলে) একই শ্লোগান দিয়েছে বিএনপিও তবে তারা বলেছে : ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার/খালেদা জিয়া রূপকার। ’ আবার এই শ্লোগানই দিয়েছে জামাত : ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার/গোলাম আযম রূপকার। ’ তো দেখা গেছে রূপকারদের একটা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে- ভোটের আগেই। যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারই সর্বরোগহর বটিকা- এক ট্যাবলেটে সব অসুখ ঠাণ্ডা ! তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারণার বিরোধিতা অনেকেই করেছেন কিন্তু তা ধর্তব্যে আনা হয়নি নানা কারণে।
যেমন বিএনপি’র অর্থমšী সাইফুর রহমান সাহেব এক সাাৎকারে বলেছিলেন, ৩৩০ জন সংসদ সদস্য শয়তান আর ১০ জন উপদেষ্টা ফেরেশতা একথা আমি বিশ্বাস করি না। ৩৩০ জন রাজনীতিক যা সমাধান করতে পারবেন না ১০ জন উপদেষ্টা তা সমাধান করে দেবেন এ ধারণা মোটেই বা¯বসম্মত নয় (স্মৃতি থেকে যতোদর মনে পড়ছে এরকমই বলেছিলেন তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রাকে দেয়া সাাৎকারে)। তাঁর কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি কারণ তিনি বিএনপির মšী ছিলেন। একইভাবে যারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপে বলেছেন তাদেরকেই মতাসীন বিএনপির দালাল বলে সহজেই দমিয়ে দেওয়া গেছে। কর্মীদের মুখে শ্লোগান তুলে দিয়ে সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার সেজে ইতিহাসে মহান হয়ে চিহ্নিত হবার উন্মাদ উন্মত্ততায় ভুগেছে।
একজন রাজনৈতিক কর্মী (সাবেক) হিসেবে উঠতে-বসতে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ শুনতে শুনতে কান ঝালা-পালা হয়ে গেছে আমার। যতোই এই উদ্ভট কনসেপ্টের বিরোধিতা করি না কেন গড্ডলিকা প্রবাহের স্রোতের শ্যাওলাদের সঙ্গে পেরে ওঠা আমার কর্ম নয়- তাই সাবেক-এর খাতায় নাম লিখে রাজনীতির বাপাš করতে হয় আমাকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে প্রচুর বিতর্ক করেছি কিন্তু কে শোনে কার কথা- কথায় বলে যে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। গড্ডলিকা প্রবাহ দিয়ে গায়ের জোরে কোনো সত্যকে চেপে রাখা যায় না- সাময়িকভাবে বিভ্রাš করা যায় মাত্র। ধীরে ধীরে সত্যটাই ¯žষ্ট হয়ে উঠছে।
মিথ্যাটা ভেঙে পড়ছে। জানি না কতোদিন লাগবে আমাদের কানে হাত দিয়ে এই সত্য আবিষ্কারে যে, আমাদের কান কানের জায়গাতেই আছে- চিল নিয়ে যায়নি। অসুস্থ রাজনীতি অসুস্থ ঘর্ণাবর্তে ঘোরে- আর দুর্ভোগে ভোগায় সাধারণ মানুষকে সেই ভোগাšির একটা বড় প্রমাণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েমের আন্দোলন।
জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা বিশ্ববেহায়া এরশাদের স্বৈরাচার তাড়াবার ফর্মুলা হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটি ছিল যৌক্তিক কেননা তখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা অর্থাৎ রাজনীতির বাইরে থেকে আসা এরশাদকে তাড়াবার দ্বিতীয় বিকল্প ছিল সশ¯ গণঅভ্যুত্থান কিন্তু ভদ্রলোকী রাজনীতি সে পথে যেতে অনিŽছুক তাহলে আপাত বিকল্প : রাজনীতির বাইরের অন্য গ্রহণযোগ্য মানুষ এনে অগ্রহণযোগ্যকে বিতাড়িত করা- সেটাই ঘটেছিল নব্বই-এ কিন্তু তারপর তো ভোটের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই রাজনৈতিক সরকারকে কেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে সরাতে হবে ? মামার বাড়ির এই আবদারের পেছনে মাসীরা কি উস্কানিদাতা নয় ? যদি মেনে নিই রাজনৈতিক সরকারকে তাড়াতে অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার তাহলে এই মেনে নেওয়ার অর্থ কি এই নয় যে, ভবিষ্যতে আবারও যদি কোন এরশাদ এসে বলে ‘আইলাম একখান কুইজ কইতাম’- তাহলে দর্শক হিসেবে আমাদের সেই ‘কুইজ’ (অধ্যাদেশ, ফরমান এসব) শুনতে হবে!
অর্থাৎ আমরা ‘রিয়াল ডেমোক্রেসি’থেকে শত যোজন দরে।
আমরা আমাদের সামনে প্রতিনিয়তই অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখছি, দেখছি নানা রকম পাঞ্জা কষাকষি। আর্মি বনাম আমলা, অফিসার বনাম কর্মচারী, শ্রমিক বনাম মালিক এই পাঞ্জা কষাকষিতে বিচারপতি বনাম সেনাপতি যদি ভবিষ্যতে অবতীর্ণ হয় তাহলে কার দাবিই বা অগ্রাহ্য করা যাবে!
একজন প্রবীণ বিচারপতির একটি প্রসিদ্ধ উক্তি ছিল এদেশের আর্মিরা বারবার তাদের নিজের দেশটাই জয় করেছে- তাঁর এই শ্লেষাÍক উক্তিটি বার বার আসা সামরিক শাসনকে ল্য করে বলেছিলেন তিনি। এদেশের রাজনীতি বিশ্লেষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন অধ্যাপক তাঁদের বিভিন্ন লেখায় বার বার যে সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন তা হŽেছ এই যে, এদেশে বার বার সামরিক শাসন কায়েমের পেছনে রাজনীতিবিদদের নানাবিধ ব্যর্থতা, ষড়যš কাজ করেছে- অর্থাৎ রাজনীতিবিদরাই সামরিক শাসন ডেকে এনেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে। এক অর্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে রাজনীতিবিদদের সেই ব্যর্থতার সেই অমতার শেষ প্রতীক রূপে বিবেচনা করা যায়- অর্থাৎ এখন যেন তাদের অমৃতে অর€চি ধরেছে, লজ্জা লাগে উর্দি-বুট তাই সেটাকেই রূপ পাল্টে কোট-গাউনে রূপাšরিত করে নিতে হয়েছে মাত্র!
তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে যারা জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে তাদের জন্য কর€ণা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
কেননা তারা ভাবে জনগণ কিছু বোঝে না কিন্তু জনগণ তাদের সম¯ অমতাই বোঝে ভালোভাবে- তারা এখন যতই জিয়া কোট, মুজিব কোট, উর্দি আর গাউনে ছোটাছুটি কর€ক না কেন যে সংকট তারা জিইয়ে রাখছে সে সংকটের হাত থেকে তাদেরও রেহাই নেই- প্রশ্ন কেবল সময়ের।
রাষ্ট্রীয় জীবনে যারা তত্ত্বাবধায়ক তত্ত্বাবধায়ক করে প্রাণপাত করেছে তাদের দলের ভেতরও নেই গণতš- অচিরেই তাদেরকে দলীয় তত্ত্বাবধায়ক কমিটি গঠন করে দলীয় স্বৈরাচার তাড়াতে হবে। জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা খালেদা জিয়াকে হঠাতে দলীয় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক, জগদ্দল শেখ হাসিনাকে সরাতে দলীয় আওয়ামী তত্ত্বাবধায়ক আর জগদ্দল গোলাম আযমকে সরাতে জামাতী তত্ত্বাবধায়ক- একাšই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে কিন্তু একথা শুনলেই তো তত্ত্বাবধায়কের ‘রূপকার’ তিনজনা মুখ ব্যাদান করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন। কিন্তু তাতে সত্যকে কি উপো করা যাবে ? যেখানে কিনা তারা তিনজন একই ডিমে তা দিয়ে বাŽচা ফুটিয়েছেন ?
বিএনপি-র বির€দ্ধে আওয়ামী লীগ আর জামাতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের সময় থেকেই বলে আসছি এই ইস্যুটি যৌক্তিক নয়। বিএনপি ছিল একটি রাজনৈতিক সরকার।
রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা না করে তত্ত্বাবধায়ক আর আমলা দিয়ে মোকাবেলা করার যে দুর্বুদ্ধি সেই দুর্বুদ্ধির বিষবৃে অমৃত ফলবে না নিশ্চয়ই!
এদেশের রাজনীতিকরা নিজেদেরকে সেই ঈশপের গল্পের অতিচালাক তাঁতী মনে করে যে তাঁতী খুবই সক্ষ্ম কাপড় বোনে, বোকারা তা নাকি চোখে দেখতে পায় না- অতিসক্ষ্ম কাপড় পরিহিত রাজা যখন রা¯ায় বেরোয় উলঙ্গ- তখন সত্যবাদী শিশু চালাক সাজার ভান করে না, সরল উŽচারণে সত্যটি জানিয়ে দেয়, আরে রাজা মশায় ন্যাংটো যে! তখন সবার হুঁশ ফেরে তাই তো ? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পে যারা গলার রগ ফাটিয়ে রক্ত তুলে শ্লোগান বক্তৃতা দিয়েছেন তারাও অচিরেই বুঝতে পারবেন নিশ্চয়ই গণতš থেকে তত্ত্বাবধায়কের দরত্বের ভেতরেই ঘাঁপটি মেরে বসে আছে স্বৈরাচারের প্রেতাÍা। যে প্রেতাÍা কিনা নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারকে নখদšহীন অথর্ব করে তোলে। এমন অথর্ব যে মা¯ানদের চোখ রাঙানিতে তটস্থ থাকতে হয় সরকারি কর্মকর্তাকে (স্মরণ কর€ণ ফেনীর গড ফাদারের সার্বভৌম ফেনীর সাম্রাজ্যে’র কথা)। জনগণের বিশ্বাস হšারকরা হয়ে ওঠে নীতি নির্ধারক।
রাজনীতিকে দাঁড়াতে হবে নিজের মের€দণ্ডের ওপর, তত্ত্বাবধায়কের মের€দণ্ড মের€দণ্ডও নয় এবং রাজনীতির জন্য উপকারী তো নয়ই অপকারীই হবে ক্রমাগত যত দিন যাবে।
মধ্যস্বত্বভোগী ধরে কেউ কোনদিন লাভবান হয়েছে কি ? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থকদের দেখলে মনে হয় এদেশের রাজনীতি জামাতী চরিত্রের সমার্থক হয়ে উঠছে। জামাতীরা সব সময়ই কীবতার পরিচয় দিয়েছে। ৭১-এ ধর্ম রার দোহাই দিয়ে সহযোগিতা করেছে পাক হানাদারদের অর্থাৎ সব সময়ই মতাপ্রীতিতে আŽছন্ন ছিল তারা। তেমনই এদেশের রাজনীতিকরা সেনানিবাস ভীতিতে আŽছন্ন, আŽছন্ন বিচারপতিপ্রীতিতে। এইসব প্রবণতাই একটি রোগ বটে! আর তা হŽেছ মতার খড়ম পায়ে জনতার অধিকারের পদদলন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপকার হবার যে নির্লজ্জ শ্লোগান আমরা শুনেছি, আগামীতেও শুনবো- সেই নির্লজ্জতার পেছনে যে রাজনীতিশন্যতা রয়েছে সেই শন্যতাকে যথার্থ উপলব্ধি করবেন কবে আমাদের মহামান্য রাজনীতিবিদেরা ?
হয়ে গেল হাঁসজারু
কেমনে তা জানিনা
’হাসছিল সজার€ ব্যাকরণ মানি না,
হয়ে গেল হাঁসজার€ কেমনে তা জানি না। ’
সুকুমার রায়
একে বলা হয় ননসেন্স রাইম- অর্থহীন ছড়া। আজ লিখতে বসে সুকুমার রায়ের ছড়াটির কথাই মনে হলো। গত ক’দিন ধরে আমার মধ্যে এরকম একটি বোধ কাজ করছিল লিখে কি লাভ? কিছুই তো ঘটে না এ দেশে। শুধু শুধু অর্থহীন কাগজ-কালির অপচয় ছাড়া।
ব্যাপারটিকে নৈরাজ্যজনক চেতনার কাজও বলা যায়, তবুও এই অর্থহীনতার বোধ আমাকে কলম ধরা থেকে বারবারই দমিয়ে দিŽিছল। আমার মনে হŽিছল বারংবার- শুধু একই কথার পুনরাবৃত্তিই ঘটছে অনবরত আমার কলমের আর্তনাদে এবং তা বলা বাহুল্য অরণ্যে-রোদন বৈ কিছু নয়। এই ননসেন্স ছড়াটি পড়েই আবার কলম ধরতে পারলাম। আÍগত এইসব কাটাকুটি তর্কাতর্কির কথা থাক।
সেদিন হঠাৎ করেই আমার এ ছড়াটি মনে হলো।
আমাদের চারপাশের উল্টা-পাল্টা ব্যাপার, অদ্ভুত অদ্ভুত খবর, এসবের রাজ্যে ডুবে থাকা নিজেকে মনে হল ঠিক এই ‘হাঁসজার€র মতো’- হাঁসজার€ কেমনে হয় তা কিন্তু আমিও জানি না। কিন্তু ‘হাঁসজার€’ হয় ‘হাঁসজার€’ হয়ে যাŽিছ আমরা সবাই। আর এখানেই মজা বোধ করি।
বহুল প্রচলিত একটা দৈনিকে বিরাট একটি বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। বিকাশমান পোশাকশিল্পের নানা সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে বিজ্ঞাপনটিতে বেশ খোলাখুলি কিছু কথায়- বিদ্যমান সমস্যার স্বরূপ তাতে বিধৃত হয়েছে।
সত্যি অবর্ণনীয় সমস্যার আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা পড়ে আছে এই শিল্পটি অথচ যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এর বিকাশের। আমাদের মত দরিদ্র দেশে যদি এই শিল্পটির স্বাভাবিকত্ব বজায় রেখে বিকাশকে সহায়তা দেয়া যেত তাহলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বেকারত্বের ভয়াবহতা যেমন কমানো যেত তেমনই এই শিল্পের শ্রমিকদের চাকরির যে অনিশ্চয়তা, যে মর্মাšিক শ্রম শোষণ- তাও লাঘব করা যেত। সর্বোপরি যা করা যেত তা হŽেছ রফতানি আরো বৃদ্ধির মাধ্যমে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কিন্তু কার্যত এর কোনটিই ঘটছে না।
হ্যাঁ, আমি এদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিগুলোর সমস্যার কথাই বলছি। গার্মেন্ট, এই শব্দটি শুনলে এদেশের অনেকেরই চোখ ভ্র কুঁচকে যায়।
শুধু তাইই নয় সঙ্গে সঙ্গে আরও অনুভূতি, বোধ, মগজও কুঁচকে যায় ; এই ভঙ্গিমা কি একেবারেই অনভিপ্রেত কোনও কিছু? নাকি এর কিছুটা যথার্থতা রয়েছে? প্রশ্ন উঠতে পারে। আমারতো মনে হয় এর যথেষ্ট যথার্থতা রয়েছে। আর এর শেকড় বোধহয় অমানবিক শ্রম শোষণের ভেতরেই নিহিত। আজ দেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে যারা উদয়া¯ শ্রম দিŽেছন গায়ের রক্ত পানি করে তারাও কি সামাজিক, কি অর্থনৈতিক কোন দিক থেকেই যথার্থ স্বীকৃতি পাŽেছন না। তাদের শ্রমের যথার্থ মল্য যেমন মালিকরা দিŽেছন না, তেমনই সমাজও তাদের যথার্থ মল্যায়নের বদলে ভ্র কুঁচকে চেয়ে আছে।
এক অদ্ভুত বৈরি ব্যবস্থা- যেন শাঁখের করাত।
এই ইন্ডাস্ট্রি যারা সর্যোদয় থেকে সর্যা¯ এবং তার পরও শ্রম দিয়ে চালাŽেছন তাদের জীবন মধ্যযুগীয় ক্রীতদাসদের চেয়েও ভয়ংকর। এদের চাকরির স্বীকৃত কোন নীতিমালা নেই, মালিকের ইŽছা-অনিŽছা পর্যš চাকরির মেয়াদকাল। তারপরও আরো তো সমস্যা রয়েছেই। সময় মতো বেতন, ওভার-টাইম না পাওয়া, ন্যায্য মজুরী না পাওয়া- এক কথায় সব কিছুই মালিকের খেয়াল খুশির হাতে সমর্পিত।
সর্যোদয়ের সাথে সাথে পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে এসে ফ্যাক্টরির কার্ডটা জমা দিয়ে ফ্যাক্টরিতে ঢোকামাত্র এরাও হয়ে যায় এক একটা রোবটের মত যš, অ¯িত্ববোধঅনুভূতিহীন মেশিন বৈ আর কিছু নয়! যাদের কাজ শুধু কাপড় সেলাই করা- অন্য কিছু নয়। যেন মেশিনেরই একটা অংশমাত্র এমনকি মে দিবসেও এরা ছুটি পায় না। এই শিল্পে যেভাবে শ্রম-শোষণ, শ্রমিক নির্যাতন এবং অব্যবস্থা বিদ্যমান তা অবর্ণনীয়। একথা ভেবে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়- কি করে একটা মানুষ ২শ’ আড়াই শ’ টাকা বেতনে চাকরি করে সংসার চালায়, কি করে জীবন ধারণ করে? ভ্র-মগজ কুঁচকে যাবার মত। খোঁজ নিলে জানা যাবে পেছনের আরও মর্মাšিক সত্য।
মা তার শিশুটিকেও টেনে এনেছেন শ্রম দানের জন্য। বোন তার আদরের ছোট্ট বোনটিকে এবং এভাবেই সম্মিলিত শ্রমে জীবনধারণেরর জন্য অন্নসংস্থানটুকুই কেবল হŽেছ, শুধুমাত্র খেয়ে বেঁচে থাকা! অসুখ হলে ছুটি নেই, কাজ করলে পয়সা, না করলে- নেই। সময় মতো বেতনের নিশ্চয়তা নেই, ডিউটির কোন সুনির্দিষ্ট সময় সীমা নেই, ওভারটাইম, হোলনাইট বাধ্যতামলক- এত সব অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যেও যারা প্রাণপাত করে দেহের রক্ত পানি করে দেশের জন্যে মল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে গুর€ত্বপর্ণ অবদান রাখছে বিনিময়ে তারা কণা পরিমাণ সহানুভূতি না-পেলেও অনেকেই কিন্তু কোনও শ্রম না দিয়েই দিব্যি বগল বাজিয়ে ফায়দা লুটছে- সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটিতে সেই বগলবাজানো লোকজনদের কথাই তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের দেশে একটি প্রবাদ আছে বেশ চালু যে- ডিম পাড়ে হাঁস আর ডিম খায় দারোগা বাবু। হ্যাঁ, যে শ্রমিকরা দিন-রাত হাড়-ভাঙা খাটুনি দিয়ে উৎপাদনের শিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছে তার ফসল উঠে যাŽেছ অন্যের পকেটে, মালিক ছাড়াও আরো অনেক শোষক, জোঁক হয়ে বসেছে তাদের শ্রমের ওপর।
‘আমলা’- আমাদের দেশের আমলারাও দেখা যাŽেছ শক্তিশালী নেপথ্য শোষকে পরিণত হয়েছে। দেশের এবং দশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তো তারাই, অতএব তারা চব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয় সম¯ পদ্ধতিতেই খাবেন সেটাই তো স্বাভাবিক! জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে লড়াই করা- তা কি সাজে? যখন চারিদিকে অনেক কুমীর ঘেরাও করে রেখেছে নিñিদ্রভাবে? সাজে যে না- তা জেনেও অনেক টাকা খরচ করে অনেক দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বিজ্ঞাপনটি দিয়েছেন রফতানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারক এ্যাকশন কমিটি। বিজ্ঞাপনে তারা হিসেব তুলে দিয়েছেন কোথায় কোথায় কত কত টাকা উৎকোচ দিতে হয়। আমাদের দেশে আমলারা পারে না হেন কাজ বুঝি নেই। তারা ইŽেছ করলেই ডাক্তার হতে পারেন, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেন, রোগী হতে পারেন, পারেন রোগ হতেও- এক কথায় সবই পারেন।
যে সম¯ জায়গায় ঘুষ এবং চাঁদা দিতে হয় তার মোটামুটি বিবরণ দেয়া হয়েছে : রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর চাঁদা-ফি, বাংলাদেশ পোষাক প্রস্তুতকারক সমিতি বিজিএমইএ চাঁদা, কাস্টমসের ঘুষ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপরে ঘুষ এবং চাঁদা, ঢাকা বিমান বন্দরে ঘুষ এবং চাঁদা, মা¯ানদের তোলা- এত সব কিছু দিয়ে কিভাবে টিকে আছে এই শিল্প তা ভাবতেও অবাক লাগে!
এটা যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য ! বলা চলে মলত, এই অমানবিক শ্রম-শোষণ এবং কিছু চুরি-দাড়িই এ শিল্পটিকে এখনো পর্যš বাঁচিয়ে রেখেছে। আমদানিকৃত কাপড়ের ওপর শুল্ক আরোপ করা হলে শুধুমাত্র শ্রমিকদের হাড়-মাংস-মজ্জা গুঁড়িয়ে, পিষে কিংবা এক বছরের বেতন-ওভার টাইম বাকি রেখেও এই আমলাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবেনা- এই সত্যিটি মালিককুলের জানা আছে বলেই কুমীরদের হিংস্রতার শিকার হবার ষোল আনা সম্ভাবনাকে বা¯ব জেনেও খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় খোলাখুলি উন্মোচিত করতে হয়েছে সমস্যাগুলোকে। বিজ্ঞাপনটি ‘নির্যাতিত মালিক শ্রেণী’র। তারা তাদের সমস্যাই লিখেছে। তারা তাদের সমস্যার কথা লিখেছে পাশাপাশি শ্রমিকদের সমস্যার কথাকে দেওয়া হয়েছে ধামা-চাপা, যদিও জ্বাজল্যমান সে প্রসঙ্গটি পাশ কাটানোর চেষ্টা নিতাšই হাস্যকর।
তারা শ্রম সমস্যা উপ-শিরনামে বলছেন,
‘বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের জন্যে একটি নিুতম মজুরি প্রদান করেছেন যা পোশাক শিল্পের জন্যে মারাÍক সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। উক্ত নিুতম মজুরির ব্যাপারটি আপাতত স্থগিত রাখা হউক। ’
অর্থাৎ এই েেত্র তারাও স্বেŽছাচারিতার স্বাধীনতার একেশ্বর হতে চান। তাতে কি এ শিল্প সঠিক অর্থে বিকশিত হবে? না, মোটেই না। আমাকে যদি পেটে ভাত না দিয়ে মহৎ এবং মহত্তর সব কিছু লিখতে বলা হয় তবে আমি তা পারবো না।
এর চেয়ে বা¯ব এবং সত্যি আর নেই। অমানুষিক শ্রমে জর্জর শ্রমিকদের নিুতম মজুরি বঞ্চিত রেখে যা সেলাই করানো হবে তাকে দিয়ে, তা কিন্তু প্রত্যাশিত রফতানি মানঅর্জনে ব্যর্থ হবে আর তাই যদি হয় তবে ক্রেতা নিশ্চয়ই তা দাম দিয়ে কিনবে না। সেেেত্র তা এড়ানোর জন্যে হলেও কি শ্রমিকদের ন্যনতম মজুরি প্রদান করা উচিত নয়? উচিত নিশ্চয়! তাদের চাকরির নিশ্চয়তা, অসুখ-বিসুখে ছুটিছাটা, কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি একাšই জর€রি এই শিল্পের জন্য। মালিকরা তাদের বিজ্ঞাপনে একটি সুন্দর তথ্য দিয়েছেন,
‘১৭৪ কোটি টাকা ফাঁকির কথা বলে কাস্টম শতাধিক গার্মেন্টসের নামে ডিম্যান্ড নোট প্রদান করেছে। কিন্তু উপরোক্ত অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে একজন শুল্ক কর্মকর্তাকেও জবাবদিহির নোটিশ প্রদানের ঘটনা জানা নেই।
’
কাস্টমসের সহযোগিতা ছাড়া ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয় ‘কারণ’ কাস্টমসে একটা ডকুমেন্ট পাস হতে ৭৮টা সই আর ৫২টা টেবিল ঘুরতে হয়। ফলে কাস্টমসে পয়সা ছাড়া কোনও কাজ সময় মত করানো এক কথায় অসম্ভব। আটাত্তর জন মানুষ মিলে যে দলিলে সই দিয়ে ছাড়পত্র প্রদান করেন তারা যেন একেবারে ধোয়া তুলসীর পাতা! কেউই ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না!! কিন্তু পাঁচশো টাকার কড়কড়া নোটের গন্ধ না শুকলে সই বেরোয় না কলমের নিব দিয়ে। এই সব সই দেনেওয়ালা মহামানব শুধু সই দিয়ে আপনার আমার জন্ম-জন্মাšর ধন্য করে দেবার লোকেরা- কিছুই জানেন না! তা যত ফাঁকিবাজ আর বদমাইশ গার্মেন্টস মালিকরা- এ কথা যেমন আজগুবি, ঠিক তেমনই আজগুবি এবং অযৌক্তিক শ্রমিকদের নিুতম মজুরি কার্যকর না-করা এবং না-করার পে খোড়া অজুহাত দেখানো।
পোশাক শিল্পের যে বহুমুখী সমস্যা সেই সমস্যা কেবল মালিকরা যদি ভাবেন তারা নিরসন করবেন তবে তা অসম্ভব।
কারণ মা¯ান পুষে মা¯ান প্রতিরোধ করা যাবে না, যায় না, ঘুষ দিয়ে ঘুষ কমানো যায় না, যায়নি। প্রতিটি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করবার অধিকার দেওয়া উচিত, মালিকের মধ্যেও থাকা দরকার সংঘবদ্ধতা। শ্রমিক এবং মালিক- যদি এই দুই প নিজেদের স¤žর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিতে পারে তাহলেই কেবল সম্ভব এই শিল্পটির বিকাশ, সম্ভব সমাজের কুঁচকানো ভ্রকে স্বাভাবিক করা। তবেই সম্ভব আমলা নামক দুরারোগ্য ক্যান্সারের নাগপাশ থেকে ব্যাধিমুক্ত হওয়া। নইলে পাঠক প্রথমেই যে হাঁসজার€র কথা বলেছি-সেই অর্থহীন হাঁসজার€র মতোই পরিণতি হবে আমাদের সবার অ¯িত্বের।
সাত কোটি মৃত্যুর প্রতিমা
যে কোনও সমাজকে বুঝে উঠতে চাইলে সবার আগে দেখতে হবে শিশু এবং নারী স¤žর্কে সে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটি কি- শিশু ও নারীর প্রতি যে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি মানবিক সে সমাজ মানবিক। যে সমাজ এ বিষয়ে অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সে সমাজ বলাই বাহুল্য অমানবিক। সমাজ বিচারের জন্য এই মাপকাঠিটি সমাজতাত্ত্বিকদের দেওয়া। এই মাপকাঠিতে আমাদের সমাজের অবস্থানটি কোথায়? নির্দ্বিধায় বলা যায়, অমানবিকতার শেষ সীমায়, বর্বরতার চূড়াš মাত্রায়। একই সঙ্গে শিশু এবং নারী তানিয়া এবং তানিয়ার বয়সী মৌসুমী, এই সব অবুঝ শিশুরা আর্তনাদে জানিয়ে দিŽেছ আমরা পশু, পশুর সমাজে আমাদের বসবাস।
নারীরা এদেশে প্রতিদিন বর্বরতার বলী- সেই সাথে যোগ হয়েছে নারীশিশু। কতো বিচিত্র উপায়ে নারীকে লাঞ্ছিত করা যায়, কত বর্বরভাবে নারীকে অতিষ্ঠ করা যায় বাংলাদেশ ছাড়া অন্যকোনও দেশে তার দ্বিতীয় উদাহরণ পাওয়া যাবে কি? এসিড নিপে করে শরীর, মুখমণ্ডল ঝলসে দেওয়া, ফতোয়া-দোররা, পাচার-বিক্রি, যৌতুক .... শত-সহস্র উপায়-পদ্ধতি দিয়ে চিতার উপকরণ সাজিয়ে রাখা হয়েছে বাংলাদেশের নারীদের জন্য। প্রাচীন বাংলায় নারীকে ‘সতীদাহ’ প্রথায় জীবš পোড়ানো হতো- নারীকেই জীবš অগ্নিদগ্ধ হয়ে দিতে হতো তার সতীত্বের প্রমাণ, বর্তমান বাংলায় তার খুব পরিবর্তন হয়েছে কি? বাংলাদেশের বর্তমান নারী চিত্র আইয়ামে জাহেলিয়ার মধ্যপ্রাচ্যীয় ইতিহাসকে লজ্জায় অধোবদন করে দিয়েছে। দেশে-বিদেশে, কর্মেেত্র, সংসদে- সর্বত্র যে প্রথম শিকার নিষ্ঠুরতার- সে হŽেছ বাংলার নারী! এই নিষ্ঠুরতাকে বর্ণনা করাও দুঃসাধ্য-দুরূহ!!
এ সপ্তাহেই মšিসভার বৈঠকে বিল অনুমোদিত হয়েছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন ধর্ষণের শা¯ি মৃত্যুদণ্ড’- দেরীতে হলেও এই বিল নিশ্চয়ই নারী নির্যাতনকারী দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করবে কিন্তু নারীর লাঞ্ছনার শেষ যে হবে না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। যে সমাজে নির্যাতন নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচবার জন্য অসহায় তর€ণীকে পাগল সেজে পাগলা গারদে কালযাপন করতে হয় (টু¤žা পাগল নয় তবু তিন বছর পাগলা গারদে \ মুক্তকণ্ঠ ২৮.৩.৯৮)- যে সমাজে থানার দারোগার অফিসের টেবিল হয়ে ওঠে নারীর নিষ্ঠুর শরশয্যা (চট্টগ্রামের সীমা চৌধুরী), যে সমাজে পুলিশ কন্ট্রোল র€মে রক্তাক্ত হয় অবুঝ শিশু তানিয়া (ঢাকার আদালতপাড়ার ঘটনা) - সে সমাজে শুধুমাত্র আইন করে এই অন্ধকার দর করা অসম্ভব।
এ সমাজে নারীরা খুব উপাদেয় বিষয়বস্তু- সাংবাদিকের কলমও কম লাঞ্ছিত করে না তাকে। নারীরা নির্যাতিত হয় আর আমরা ব্যানার দেখি, দেখি ফেস্টুন, শুনি অগ্নিঝরা বক্তৃতা-বিবৃতি, মারমুখী মিছিল-মিটিং তারপর সবই ¯িমিত হয়ে যায়- আবার জেগে ওঠে, দেখি ব্যানার-ফেস্টুন-বক্তৃতা-শ্লোগানে নামটি শুধু পাল্টে গেছে নরজাহানের নাম পাল্টে ইয়াসমীন হয়, ইয়াসমীনের নাম পাল্টে সীমা, সীমার জায়গায় আসে তানিয়া, মৌসুমী- বিষয়-বক্তব্য-ক্রোধ একই থাকে। অর্থাৎ এক টুকরো অন্ধকারকেও সরানো যায় না। ল¤žট শাসককে উৎখাত করলেও আমরা লা¤žট্যকে তাড়াতে পারি না। রাষ্ট্রের সর্বোŽচ নির্বাহী পদে নারীর অধিষ্ঠানও নারীকে অধিষ্ঠিত করতে পারেনা সমাজে- মানুষের মর্যাদায়।
নারীকে নিয়ে একদিকে চলছে বিকৃতি-বর্বরতার বহ্নুৎসব আর তার বিপরীতে চলছে বক্তৃতা-বিবৃতি আর মিছিল-মিটিং-সেমিনার। যার কোনোটাই নারীকে তার ন্যনতম নিরাপত্তা দেবে না। কাজীর গর€ কেতাবে থাকে- গোয়ালে তার হদিস মেলে না। নারী অধিকারও তেমনই রয়েছে- সমাজ সেই অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে কি? পারছে না-আর সেজন্যই আজ প্রয়োজন সার্বিক সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। নারী সমাজ বিŽিছন্ন কোনও উপকরণ মাত্র নয়-যেমন বিŽিছন্ন অ¯িত্ব নয় নারী নির্যাতকেরাও।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক যে নারী সেই অর্ধেক জনসংখ্যার কর্মেেত্র অংশগ্রহণ দণি এশিয়ার সার্কভুক্ত সবগুলো দেশের চাইতে বেশি। উপমহাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবুল হক যিনি ইউএনডিপি’র ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট’ প্রণেতাদের মধ্যে প্রধান তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন শিায় অনগ্রসর দেশের নারীর কর্মেেত্র এই বিপুল উপস্থিতি ল্য করে- বিস্ময়কর হলেও এই বা¯বতাটি খুবই সত্য। আমাদের পরিবারের, আমাদের সমাজের, আমাদের সভ্যতার পিলসুজের সল্তেয় নিরšর শ্রম, রক্ত আর ঘাম সিঞ্চন করে নিভু নিভু যে জীবনীশক্তির আলো- সেটাও এই নির্যাতিত নারীরাই জুগিয়ে চলেছেন প্রতিদিন। তাদের কাঁধেই আমরা চড়িয়ে রেখেছি সিংহভাগ শ্রমের জোয়াল, যে শ্রমের স্বীকৃতি নেই একবিন্দু। তবুও কেন তারাই হŽেছ সর্ব প্রথম, মধ্য ও সর্বশেষ নিষ্ঠুরতার শিকার? উত্তর খুঁজতে হবে আজ এ প্রশ্নেরই।
নারীর অর্থনৈতিক সাবলম্বীতা ছাড়া এইসব নিষ্ঠুরতার হাত থেকে তাকে রা করা যাবে না। নিষ্ঠুরতার শিকার শিশু তানিয়াকে পুতুল কিনে দিয়ে, (মা করবেন এডভোকেট এলিনা) রঙিন বেলুন তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুরতার স্মৃতি আপাতত, ছাই চাপা দেওয়া হয়ত সম্ভব কিন্তু পরণেই তো গগণ বিদীর্ণ করে কেঁদে উঠছে মৌসুমী- তা সত্য নয় কি? কতো পুতুল আর কতো বেলুন দিয়ে আমরা ভোলাবো তাদের?
পুলিশের পাশবিক নির্যাতনে সীমার মৃত্যুর পর একটি কবিতা লিখেছিলাম :
‘মগজে লেগেছে ঘুণ
স্বপ্নের রঙিন বেলুন
ঢেকেছে নিবিড় নীলিমাকে
দু’পায়ে মৃত্যু খুন
নিয়ত সুনিপুণ
জড়িয়ে ধরছে কাদা-পাঁকে
নরজাহান-ইয়াসমিন-সীমা ...
সাত কোটি মৃত্যুর প্রতিমা। ’
আমাদের এই বর্বর সমাজে ‘নারী’ কি মৃত্যুর সমার্থক একটি শব্দে পরিণত হŽেছ না?
আমাদের কাজের টেবিলে আড্ডার ফাঁকে কে যেন হঠাৎ একটি সংলাপ ছুঁড়ে দিল- আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার পাক-বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ২ ল মা-বোনের লাঞ্ছনার বিচার চাই, সেই সংখ্যাকেও কি আমরা টপকে যাŽিছ না?-বর্বরতার সর্বোŽচ মাপকাঠিটিকেও আমরা ছাড়িয়ে যাŽিছ?- চকিত এই মšব্যে শিউরে উঠি। উত্তর জোটে না মুখে।
সেদিন আমাদের সহকর্মী দিলীপের টেবিলে দেখি হলুদ রঙের মার্কার দিয়ে একটি পত্রিকার বিভিন্ন পৃষ্ঠার হেডিংগুলো দাগানো।
দিলীপকে পত্রিকাটি এভাবে কেন নষ্ট করা হয়েছে প্রশ্ন করতেই দিলীপ বলল : হেডিংগুলো পড়লে বুঝবেন! হেডিংগুলো পড়েও শিউরে উঠলাম। একদিনের পত্রিকার ৮টি পৃষ্ঠায় এতোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধর্ষণের সংবাদ! সংবাদগুলো সব একত্রে ছাপলে প্রায় ১ পৃষ্ঠাই হয়ে যেত!
না, আমাদের নারীরা তো মৃত্যুর প্রতিমা নয়। আমরা বেহুলার কথা জানি, আমরা এই দেশকে কাব্য করে ‘বেহুলা বাংলা’ও বলি- বেহুলা তো জীবনের প্রতিমা। সাপে কাটা নি®ž্রাণ পুর€ষের শরীরে প্রাণ¯žন্দনের আরাধনা- সে-তো বাংলার নারীরই আরাধনা! সেই বেহুলাদেরকে কি আমরাই সাপের মতো বিষের ফণায় নি®ž্রাণ করে দিŽিছ না - প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন?
কবে কোন ভবিষ্যতে বাংলার বেহুলারা আবারও জীবনের প্রতিমা হয়ে উঠবে? উত্তরে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যেদিন আমাদের উদয়া¯ হাড়ভাঙা পরিশ্রমী গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকরা তাদের ন্যায্যমজুরি পাবেন, গ্রামের কিশোরীটি পাবে শিার আলো ।
১৯৯৮ ঢাকা
বাঙালি চরিত্র
এক সময় এই ঢাকা শহরে কয়েকটি বড় বড় সাইনবোর্ড ছিল এ রকমের যে, অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।
পবিত্র হাদীস শরীফের উদ্ধৃতি ছিল এটি। আজকাল আর সেই বাণী উৎকীর্ণ বোর্ড দেখা যায় না। এই শহরে বিষয়টি মানায়নি বলেই কিনা জানি না-সেগুলো উধাও হয়েছে।
কোনও কোনও ধর্মগ্রন্থে ঈশ্বরের অ¯িত্ব স¤žর্কে একটি চমৎকার যুক্তি দেয়া হয়, যুক্তিটি এ রকম : দিনের প্রতি-শব্দ যেমন রাত, আলোর প্রতি-শব্দ অন্ধকার, ঠিক তেমনি ইহলোকের প্রতি-শব্দ পরলোক। সৃষ্টি শব্দটি স্রষ্টার অ¯িত্ব প্রতিপন্ন করে অর্থাৎ সৃষ্টি থাকলে স্রষ্টা থাকছেই।
এই চমৎকার যুক্তিটি স্মরণে আসছে অপচয় প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে। উল্লিখিত যুক্তির মতই বলা যায়, দারিদ্র্যের প্রতি-শব্দ প্রাচুর্য, মিতব্যয়িতার প্রতি-শব্দ অমিতব্যয়িতা। অর্থাৎ বিষয়টি থাকছেই-একদিকে গগনচুম্বী অট্টালিকা ঠিক তার পাশেই নোংরা ব¯িত- এটাই হŽেছ ঢাকা শহর।
পাঠক, আমি কিন্তু উপরের যুক্তির সত্রে এই বিদ্যমান ব্যবস্থার পে সাফাই গাইছি না- বরং বলতে চাইছি বিদ্যমান ব্যবস্থায় এমনটিই ঘটে- তবে এটা শ্বাশত বা অমোঘ নয় এরও পরিবর্তন দরকার এবং তা করা সম্ভবও। হয়তো এই পরিবর্তনকে সোনারকাঠি-রূপোরকাঠি পাল্টে দেবার গল্পটির মতো বলা যায়।
শুধু বিদ্যমান অসঙ্গতিকে সঙ্গতি দান করা। মন্দ কে ভালোয় পরিবর্তিত করে তোলা। অন্যায় দরীভূত করে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করা কাজের মধ্যদিয়ে।
যে প্রসঙ্গে এতো ভূমিকা সে প্রসঙ্গটি বেশ পুরনো হয়ে গেছে। এবারের মহাপ্লাবনে ( ১৯৮৮-র বন্যা) আক্রাšদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য আহবান জানিয়ে ঢাকা শহরের অলি-গলি, রাজপথ অসংখ্য ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছিল।
বহুল প্রচলিত দৈনিক এ প্রসঙ্গে একটি রিপোর্ট ছেপে হিসেব কষে দেখিয়ে দিয়েছে যে, প্রায় পনের-বিশ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে এই ব্যানারের পেছনে। যে টাকা দিয়ে কিনা বন্যার্ত মানুষের অন্নসংস্থান হতে পারতো। অর্থাৎ ব্যানারের এই টাকা গুলি এক প্রকারের অপচয়। না পাঠক, এেেত্র ঐ বাক্যটি প্রয়োগ (অর্থাৎ কারো ভাই বলা) যুক্তিযুক্ত হবে না তবুও আমার তো মনে হয় দায়িত্বশীল ভাবনার প্রয়োজন ছিল এ বিষয়ে। একজন বিদগ্ধ লেখক বলেছিলেন, বাঙালিরা এক জায়গায় দু’জন থাকলে করে দলাদলি।
এই অসংখ্য ব্যানারে বন্যার্তদের প্রতি সহানুভূতির আবেদন ছাপিয়ে যা প্রকট হয়েছে তা কিন্তু ঐ দলাদলিই। অতঃপর শুর€ হয়েছে বন্যা কেন্দ্রিক সেমিনার, এেেত্রও ঘটছে একই ব্যাপার। এ দল আজ করে তো ও দল করে কাল। কেউ এ বেলা বক্তৃতা দিলে অন্য জন ও বেলা। অনেকটা যেন কানামাছি খেলা, এই করেই হয়তোবা কেটে যাবে বেলা ; সামনে শুধু আরেক বন্যায় ডোবার জন্য প্রতীা।
ছোটদের বইয়ে একটা ছড়া আছে, আমার কেন যেন মনে হŽেছ- এই সব তৎপরতা দেখে- আমরাই কি সেই ছড়াটির চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছি? ছড়াটি এ রকম-
’মালয় দ্বীপের এক যে বোকা শেয়ালে,
লাগলে েিদ মুরগি এঁকে দেয়ালে
চাটতে থাকে আপন মনে খেয়ালে। ’
হোসেন মীর মোশাররফ/বোকা শেয়াল
বন্যা ত্রাণের আহবান সম্বলিত বিবর্ণ ব্যানার গুলি দেখে আমাদের খেয়ালী চরিত্রের কথাই আমার মনে পড়ে। আজকে সেমিনার করে করে ঈথারে ছড়িয়ে দিŽিছ বন্যা প্রতিরোধের করণীয় পদেেপর ব্যবস্থাপত্র কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ করবার গরজ কিংবা উদ্যোগের কোনও খবরই নেই। কি অদ্ভুতই না খেয়াল আমাদের। অপচয় বিরোধী সাইন বোর্ডটির সাথে সাথে যদি আমাদের এই খেয়ালী প্রবণতাগুলি উধাও হতো, তাহলেই আশাবাদী হতে পারতাম।
বলতে পারতাম বিদ্যমান ব্যবস্থাটির নাগপাশ মুক্ত হতে পারছি।
মুক্তি চাই। কিন্তু তা পারছি কই? ঘ
চাই সিংহাসন, সোনার মুকুট
তাই রাজনীতি?
আমাদের দেশটা খুব ছোট, আর তার চাইতেও ছোট এদেশের রাজনীতিকরা। কথাটার সত্যতা স¤žর্কে যে-কোন সচেতন নাগরিকই দ্বিমত পোষণ করবেন না।
ছোটবেলা থেকে রাজনীতিবিদদের ওপর শ্রদ্ধা পোষণ করে এসেছি অপরিসীম।
তাদের আদর্শবাদিতা, আÍত্যাগ, কষ্ট সহিষ্ণুতা আর সাহস-অনুপ্রেরণা যোগাত। আ¯ে আ¯ে বড় হয়েছি আর আ¯ে আ¯ে সেই আদর্শস্থানীয়দের স্খলন-পতন দেখতে দেখতে বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছি। রাজনীতিকদের ওপর শৈশবের সেই প্রশ্নহীন শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছি। তাদের ওপর শ্রদ্ধা কমে আসবার কারণেই অবাক হইনি দেশের দুই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী যখন নাগরিকত্বহীন জামাত নেতার দোয়া চাইতে গিয়েছেন তখন। অবাক হবার অবকাশ নেই, কারণ, যারা দোয়া চাইতে গিয়েছেন তারা রাজনীতির কেউ নন।
দুঃখ পাবারও কিছু নেই, কারণ তারা যে পেশা থেকে এসেছেন সে পেশা তাদেরকে জনবিŽিছন্ন করে রাখে- পেশাগত নিরপেতা বজায় রাখার স্বার্থে। ঔপনিবেশিক আমলের সব চাইতে ঠাঁটবাট বজায় রাখা পেশাটি থেকে তারা এসেছেন একেবারে স¤žর্ণ বিপরীত মের€তে। তারা ভুল করতেই পারেন, কারণ তাদের এলাকার বাইরে তারা পা বাড়িয়েছেন। যে-যার নিজের ভূমিকায় যথার্থ, তার বাইরে বেমানান। তাই তাদের এই দৌড়-ঝাঁপে দোষ দেখি না- তারা দোয়া চাইতেই পারেন, এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার তাদের।
কিন্তু যখন তারা রাষ্ট্রপতি হবার স্বপ্নেবিভোর হয়ে দোয়া চাই।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।