আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্নিগ্ধ সবুজ বলধা গার্ডেন জনাকীর্ণ নগরে অরণ্যের আমেজ!

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

স্নিগ্ধ সবুজ বলধা গার্ডেন জনাকীর্ণ নগরে অরণ্যের আমেজ! শতবর্ষী বলধা গার্ডেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিচিত্র বাগান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা রকম বৃক্ষের সমারোহে সমৃদ্ধ। আকারে এটি ঢাকার যেকোনও পার্ক বা বাগানের চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু এটি অপেক্ষাকৃত তাৎপর্যপূর্ণ। বাগানটিতে বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশী বরেণ্য ব্যক্তিরা এসেছেন এবং তাদের অনেকেই নানা ধরনের বৃক্ষ রোপন করে বাগানের ইতিহাসে নাম লেখাতে চেয়েছেন।

এদের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অন্যতম। মানুষের জীবনে বিনোদন অনিবার্য বিষয়। কর্মবহুল এই যান্ত্রিক জীবনে প্রতিদিন কাজ করে করে যখন কান্ত মানুষ, তখন সে চায় কর্মহীন বিশ্রাম। আর সেই বিশ্রামের জায়গা যদি হয় একটু খোলামেলা, আলো-বাতাসে ভরপুর কিংবা গাছ গাছলায় ভরা ছায়া ঘেরা, তাহলে তো কথাই নেই। হোকনা সেটা মানুষের তৈরি সাজানো-গোছানো কোন গার্ডেন কিংবা প্রকৃতির গড়া সুজলা-সুফলা সবুজ বাগান।

ঢাকা শহরে এ ধরনের গার্ডেন বা বাগানের খুব অভাব। হাতেগোনা দু'একটি গার্ডেনই রয়েছে। এখানে বিচিত্র রকমের সব গাছ- ক্যামেলিয়া, স্বর্ণ অশোক, আফ্রিকান টিউলিপ, বিরল প্রকৃতির দেশী-বিদেশী ক্যাকটাস, অর্কিড, এনথোরিয়াম, ভোজ্যপত্রসহ বিচিত্ররকম বকুল গাছ, আমাজান, লিলি, রক্তজবা ইত্যাদি প্রায় ৮০০ প্রজাতির গাছ। তবে সাইকি ও শিবিলি অংশে দেশি-বিদেশী প্রায় ১৮০০০ উদ্ভিদ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা আছে। বলধা গার্ডেনের শিবিলি অংশের প্রধান আকর্ষণ শঙ্খনদ পুকুর।

এই পুকুরে রয়েছে ফুটন্ত শাপলা ও পদ্মফুল। শাপলা ও পদ্মফুলের পাতা দেখলে মনে হবে, এগুলোর পাতা যেন একেকটি ছোট-খাটো বিছানা। শীতলপাটির নরম বিছানার মতো পানির রংও বেশ স্বচ্ছ ও টলটলে। ইচ্ছে হয় একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি। পুকুরের দু-পাশে শান বাঁধানো ঘাট।

সিঁড়ির ধাপগুলো বেশ চওড়া। একসাথে বেশ কয়েকজন বসে মাছের খেলা দেখতে পারবে অনায়াসে। পুকুরের পাশেই বিখ্যাত জয় হাউস। এই হাউসে বসে ক্যামেলিয়া ফুলের গন্ধে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত "ক্যামেলিয়া" কবিতাটি লিখেছিলেন। এই বাগানের আকর্ষণের শেষ নেই।

সূর্যঘড়ি সেরকমই একটি। ঘড়িটি বাগানের প্রথম থেকে চালু রয়েছে। সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে এই ঘড়ির সময় ওঠে। দর্শনার্থীরা শঙ্খনদ, জয় হাউস এবং বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও ফুল দেখার সাথে সাথে সূর্য ঘড়িটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়। প্রকৃতিপ্রেমীরা প্রথম দর্শনেই বলধা গার্ডেনের প্রেমে পড়তে বাধ্য।

প্রকৃতির ঐশ্বর্যে ভরা বলধা গার্ডেনের অবস্থান পুরনো ঢাকার ওয়ারীতে। ১৯০৯ সালে তৎকালিন জমিদার এবং বিশিষ্ট প্রকৃতিপ্রেমিক নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এই বলধা এস্টেট্স এর প্রতিষ্ঠাতা। নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী প্রকৃতিপ্রেমিকের সাথে সাথে একজন বৃক্ষপ্রেমিকও ছিলেন। সাহিত্য বিষয়েও ছিল তার অগাধ জ্ঞান। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি সারাজীবন সাহিত্য চর্চা করেছেন।

বৃক্ষপ্রেমিক, সাহিত্যিক ও প্রকৃতিবিদ এই তিন গুণের সমন্বয় ঘটেছিল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মধ্যে। আর এসব গুণের আবিষ্টে অনুভূতিপ্রবণ হয়ে সাহিত্যিক নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী বাগানটিকে দুটি অংশে বিভক্ত করেন। এক অংশের নাম সাইকি। যার অর্থ আত্মা। আর দ্বিতীংয় অংশের নাম শিবিলি।

যার অর্থ প্রকৃতির দেবী। দুটিই প্রাচীন গ্রীক পৌরাণিক শব্দ। জমিদার নারায়ণ চন্দ্র রায় চৌধুরী নিশ্চই খুব ভেবে চিন্তে শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি গাছ গাছলার প্রতি এতোটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, দিনের প্রায় অর্ধেকটা সময়ই এর পেছনে ব্যয় করতেন। বলধা গার্ডেনের গাছ গছলাগুলো যেন তারই হাতের ছোঁয়ায় তৈরি।

কারণ, তিনি এর পেছনে অনেক শ্রম ও সময় ব্যয় করেছেন। কিন্তু ১৯৪৩ সালে জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর গার্ডেনটি কলকাতা হাইকোর্টের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারাই তখন বাগানের দেখাশুনা করতেন। ১৯৫১ সালে পাকিচ্চান আমলে কোর্ট অফ গোয়ার্জ এই বাগানের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন। কিন্তু বাগানের তেমন উন্নতি হয়নি।

তাদের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে ১৯৬২ সালে বলধা গার্ডেনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয় বন বিভাগকে। বর্তমানে এদেরই দায়িত্বে চলছে। মাঝখানে এই বাগানের পরিবেশ যতোটা ভালো ছিল তা এখন অনেকটা বিলুপ্তির পথে। এখন প্রকৃতিপ্রেমীদের চেয়ে সাধারণ প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভিড়ই বেশি। এই ভিড় ছুটির দিনেই বেশি হয়।

সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের যাওয়া-আসা চলে। বলধা গার্ডেনে আসেন অনেক শিক্ষার্থীও। বিশেষ করে যারা উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোন্ গাছের কি নাম সেটা জানাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারণ, অধিকাংশ গাছের গায়েই সে গাছের নাম লেখা নেই।

এতে দর্শনার্থী ও শিক্ষার্থী উভয়েরই অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। অনেকেই তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে আসেন। উদ্দেশ্য বাচ্চারা দুর্লভ সব গাছ দেখুক, চিনুক। কিন্তু কোন্টা কি গাছ, তার নাম লেখা না থাকলে চিনবে কী করে? আগে প্রতিটি গাছের গায়ে নাম লেখা ছিল। বর্তমানে তা নেই।

দর্শনার্থীর অনেকেই এই টিনের পাতগুলো খুলে গাছের নিচে ফেলে দেন অথবা নিয়ে যান বলে। কেয়ারটেকারদের অভিযোগ। অনেকে গাছের ফুল ছিঁড়ে নেন। "হাজারো নিয়মের মাঝে এইটুকু অনিয়ম মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হচ্ছে" বললেন তারা। যে বাগানের এতো সুনাম, যার সৌন্দর্যের কথা এবং দুর্লভ গাছ গাছলার কথা সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের মুখে মুখে, দিন দিন তার সৌন্দর্য এভাবেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গার্ডেনের উত্তর ও দক্ষিণের অংশ বাথরুম ট্যাবের পানিতে সব সময়ই ভেজা ও স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। দেখলেই গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। বাথরুমে অসহ্য দুর্গন্ধ আর নোংরা পরিবেশ। প্রসাব আর পানিতে সারাক্ষণ ভিজে। সেই পানিতে ভেজা কাদার সাথে গাছের পাতা পঁচে জায়গাটাকে আরো বেশি নোংরা করে ফেলেছে।

ফলে বাগানের দুই দিক দিয়ে ঘুরতে গেলে নাকে রুমাল চাপতে হয়। এছাড়া মাঝাখানেও পানি জমে থাকে প্রায় সময়ই। অর্থাৎ যথাযথ পরিচর্যার অভাবে বাগানের সৌন্দর্যের হানি ঘটছে দিন দিন। সৌন্দর্য হারালেও বলধা হারায়নি তার মহিমান্বিত গৌরব ও জনপ্রিয়তা। তাইতো বলধার অজস্র সবুজ বৃক্ষের মুক্ত পরিবেশে সেই নির্মল ও নিটোল সুখের সন্ধানে বের হন শত শত দর্শনার্থী প্রতিদিন।

তরুণ-তরুণীরা খুঁজে ফেরে নগরে গহীন অরণ্যের প্রেমানুভূতি। এমন নন্দনকাননে মানব-মানবীর স্বতস্ফূর্ত উচ্চারণ "শুধু প্রেম দাও"!!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.