আমাদের জীবনটা জীবনই থেকে যায় সারাজীবন , লাইফ আর হয় না সিনেমার নায়ক নায়িকাদের মতো।
শেষের শুরু
কোথায় যেন পড়েছিলাম ঠিক দুপুরবেলা ভুতে মারে ঢেলা এই কথাটিকে প্রমান করতেই কিনা সূর্য যখন ঠিক মধ্য আকাশে তখনই যেন পুরো মতিঝিল দিলকুশাকে ভুতে ধরে, পিচগলা দুপুরবেলাতে যেন গাড়ী ঘোড়া সব বিকল হয়ে অতন্দ্রপ্রহরীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা বেষ্টিত এই ব্যাস্ত অফিস পাড়ায়, ভুতে পাওয়া মানুষের মত রাজপথ আর ফুটপাথ জুড়ে কর্মব্যস্ত পথিকের অজানার দিকে ভাবলেশহীন ছুটোছুটি। আর বসে থাকতে থাকতে বুড়িয়ে যাওয়া বাস চালকের হাতের চাপে চ্যাচিয়ে ওঠা হর্নের বিকট আওয়াজে প্রকাশ পায় প্রাগৈতিহাসিক কালের জমে থাকা চিটচিটে বিরক্তি। এরকম এক ঘেমে নেয়ে ঊঠা দুপুরে কোলাহল পূর্ণ এক বাসের উদরে বসে বসে ঝিমোচ্ছি, বাসটি প্রায় এক ঘণ্টা ধরেই একই জায়গায়, আগামী এক ঘণ্টা পরে ও নড়বে কিনা সেটা শুধু উপরওয়ালাই বলতে পারবেন। দূর থেকে মতিঝিলের বুক চিরে ফুটে উঠা বিশাল শাপলাটির কিছু অংশ দেখছি আর হাই তুলছি।
শাপলাটাকে দেখে কি যেন একটা মনে পড়তে চাইছে, খুব জরুরী কিছু হয়ত কিন্তু ক্লান্তিতে আমার দুচোখ বুজে আসছে, যে কোন সময় হয়তো অতলে ডুবে যাবো, আমার ক্লান্ত দুচোখ চাইছে ঘুমিয়ে নিতে আর মন চাচ্ছে জরুরী কিছুটাকে মনে করতে , চলছে প্রাণপণ লড়াই, দুই রাজার লড়াইয়ে আমি নিরীহ আসহায় প্রজা, যেই জিতুক না কেনো আমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে।
শান্ত সকালে মধ্যাহ্ন
হঠাৎ ঝুপ করে পানিতে কিছু পড়ার আওয়াজ পেয়ে পিছনে ফিরতেই দেখি কচি কলাপাতার মতো কোমল সবুজ ঘাসের গালিচা যেখানে শেষ সেখানে এক বয়স্ক গ্রাম্য জেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, মাছের খোঁজে পানিতে ছুড়ে দেওয়া তারই কালো মোটা জালের তড়িৎ ডুবে যাওয়া দেখছে। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় দিলকুশার বুক চিরে কুল কুল শব্দে বয়ে যাওয়া ছোটো নদীর মতো এই বিশাল খাল “মতিঝিলে” আশে পাশের গ্রাম থেকে মানুষজন মাছ ধরতে আসে। অথচ কিছুদিন আগেও একটা সময় ছিল কিছু নাম না জানা পাখি আর কিছু কাঠবিড়ালী ছাড়া এই সবুজ প্রান্তরে আর কোনো অধিবাসী ছিল না। সবুজ গাছগাছালী পার করে পশ্চিম দিকে কিছুদুর গেলে এবড়ো থেবড়ো মাঠের মধ্যে ছড়ানো ছিটানো তিনটে চারটে বাড়ি চোখে পড়ে।
মাঝে মাঝে আমরা স্কুল পালিয়ে আমার সঙ্গী দুপেয়ে যানটাকে নিয়ে এখানে চলে আসতাম। পুরোটা এলাকা সবুজ ঘাসে মোড়ানো, সবুজ ঘাস আর ধানক্ষেতের গা ছুঁয়ে বয়ে চলা মতিঝিলের পাড় ঘেঁষে দূরে দেখা যেত কতিপয় নিঃসঙ্গ মায়াবী কুটিরের ছবি, বছর খানেক আগেও যেখানে ছিল কলাগাছের সারি। শহরের শেষ উত্তর প্রন্তের সীমানা পেরিয়ে নরম হলুদ রঙের কলাগাছের ছায়াঘন পল্লবের আড়ালে আড়ালে আমি খুঁজে পেতাম আমার এক টুকরো স্বর্গ, বুঝলাম স্বর্গের মালিকানা বদলের বুঝি সময় এসেছে।
কুল কুল বয়ে যাওয়া এই বিশাল খালটাকে আমার নিজস্ব সম্পত্তি মনে হতো, মনে হত আল্লাহ বুঝি শুধু আমার জন্যই মতিঝিল খালটাকে বানিয়েছে। যদিও অনেক পরে জেনেছি, ইসলাম খাঁ নামে জনৈক শাসক নৌপরিবহন আর পয় নিস্কাসনের জন্যে ঢাকার বুকে দুটো খাল কেটেছিলেন।
যার একটি ধোলাইখাল, বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে বাবুবাজার দিয়ে যাত্রা শুরু করে বাবুবাজারের পুলের নিচ দিয়ে তাঁতিবাজারের পাস দিয়ে নবাবপুর নারিন্দা রোড অতিক্রম করে সরাফতগঞ্জ হয়ে লোহারপুলের নিচ দিয়ে আবার সেই বুড়িগঙ্গার গর্ভেই। আর দ্বিতীয়টি তাঁতিবাজার মালিটোলা হয়ে বংশাল রোড পার হয়ে সুরিটোলার পশ্চিমে ঘুরে নাজিরাবাজার ও দেওয়ান বাজার অতিক্রম করে নিমতলি হয়ে শাহাবাগ ও গাছে গাছে , ফুলে, ফুলে ঘাসে, ঘাসে রমণীয় রমনা গ্রীনের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একসময়ের ব্রিটিশ সেনা ছাউনি পুরানা পল্টন পার হয়ে দিলকুশার বুক চিরে সোজা পূর্ব দিকে চলে গিয়েছি, আমার ছেলেবেলার স্বর্গ, মতিঝিল খাল।
কয়েক বছরের ব্যাবধানে গাছগাছালির কোন পরিবর্তন না হলেও মানুষের অনধিকার প্রবেশ যেন বেড়েছে, বেড়েছে আমার ছেলেবেলার রহস্যময়ি বুড়ীর বাগান বাড়ি “দিলকুশা গার্ডেনের” নোনাধরা প্রাচীন প্রাচিরের গায়ে বেঁচে থাকা লতাপাতা গুল্ম। শুধু ভেতরে অযত্নে বেড়ে উঠা পদ্মপাতায় ঢেকে যাওয়া মস্ত সরোবরটাই বুঝি দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে। মতিঝিলের তীর ঘেঁষে পুরো দিলকুশাকে ঘিরেই বাগ এ দেলখোশ এর সীমানা।
এই বিশাল এলাকার মাঝে বেখাপ্পা দোতলা বাগানবাড়িটা যেন আরও বুড়ীয়ে গেছে এ কবছরে।
একবার শীতের সকালে সাইকেল নিয়ে একটু বেশীই ভিতরের দিকে চলে গিয়েছিলাম, মতিঝিল খালের একেবারে উত্তরের অংশে। সেখানে গিয়ে দেখি সৌখিন মাছ শিকারি ছিপ পেতে বসে আছে। আর দুরে কারা যেন পানিফলের পাতার উপর হেঁটে বেড়ানো চিকন ঠোঁটের কালো সাদা পাখি শিকারে নিমগ্ন, কান্নামাখা কুয়াশার চাদরে ঢাকা কচুরিপানার ফাকে ফাকে ডাহুক, বক নানারকম পাখির ছড়াছড়ি। সেদিন বাসায় এসে খুব কেঁদেছিলাম ঈষৎ বড় ঠোঁটওয়ালা এক অর্ধমৃত সাদাবকের করুন চাহনী দেখে, সেই অর্ধমৃত মায়াকাড়া চোখ আমার পুরো শৈশব কৈশোর জুড়ে অনেক কাল তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
বছর খানেক আগেও মতিঝিলের তীর থেকে পশ্চিম গুলিস্থান পর্যন্ত, উত্তরে পল্টন, রমনা পর্যন্ত পুরো এলাকাই ছিল ঘাসে মোড়া হরিৎ স্বর্গ। মনে পড়ে বিশাল নরম সবুজ ময়দানের প্রাণকাড়া ওই কোমল ঘাসের পরে আমার বাসর করার ও সাধ জেগেছিল আমার পড়ন্ত কৈশোরে। বাগ-বাগিচা শোভিত শহরের শেষ প্রান্তে অনেক খালি জায়গা নিয়ে গড়ে উঠা রমণীর রমনায় ধীরে ধীরে বসতি গড়ে তোলে শহরের সম্ভ্রান্ত লোকেরা। আর আমার সবুজ স্বপ্নটা ও বুঝি ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। ফিকে হয়ে আসা সবুজ ময়দান পেরিয়ে আমি স্মৃতির বাক্সপেটারা খুলে হারিয়ে গিয়েছিলাম, সম্বিৎ ফিরে অনতিদুরে বুড়ো খালের পাড়ে পাশাপাশি বেড়ে উঠা কয়েকটা কড়ই গাছের ছায়ায় দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক জেলের মতিঝিলের জীর্ণ বুকে ছুড়ে দেওয়া জালের ঝপাৎ শব্দে।
মলিন হতে থাকা ঘাসে মোড়া সবুজ ময়দান, প্রায় শূন্য কলাগাছের সারি , ছড়ানো ছিটানো কড়ই মেহগনি শীর্ণ মতিঝিলের উত্তর পশ্চিম সীমানাকে এখনো মলিন করতে পারেনি দেখে আমি স্বস্তি পাই, আমি বেঁচে উঠি। কেন জানি মনে হয় এই মতিঝিল মরে গেলে বুঝি আমিও মরে যাবো, এই ঘাসের প্রতিটি ডগায় যেন আমার প্রান গেঁথে আছে। আজীবন বেঁচে থাকুক আমার মতিঝল খাল, এই ছোট্ট চাওয়া টুকু বুকে গেঁথে এগোই কড়ই গাছের তলে যেখানে সেই গ্রাম্য পুরুষটি দাঁড়িয়ে মাছ সিকারে নিমগ্ন। সেই কৈশোর কোলে চড়া গাছগুলো আজ রীতিমতো মোটাসোটা পূর্ণবয়স্ক, গম্ভীর যেন সমস্ত দিলকুশাকে পরম যত্নে আগলে রেখেছে। খালের কাছাকাছি পৌঁছে দেখি ২/৩ টি নৌকা বাঁধা গাছটির প্রকাণ্ড গুড়িতে।
খুব সাধ জাগে ছোটবেলার অপূর্ণ ইচ্ছাটাকে পূর্ণ করতে, মতিঝিলের টলমল পানি নৌকায় চড়ে পার হতে খুব ইচ্ছে হয়, আশেপাশে কাউকে না পেয়ে সেই জাল ছোঁড়া বয়স্ক লোকটিকেই জিজ্ঞাসা করি চাচা, চাচা বলতে পারেন এই নৌকা গুলো কার, আমি একটু ওপারে যাবো, চাচা চাচা, ও চাচা। কোনোমতেই যেন আমার ডাক পৌঁছায় মাছ ধরায় নিমগ্ন লোকটির কানে, আমি চাচা, চাচা বলে ডাকতেই থাকি, সমস্ত গাছপালায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ওই ডাক শুধু আমার কানেই যেন বাজতে থাকে।
গোধূলি বেলা
চাচা, চাচা, ও চা;6চা, ডাকটা এবার নিজের কানে বাজতেই ধড়ফড়িয়ে উঠি, কেউ একজন বলে, কতক্ষন ধইরা ডাকতাছি, কই যাইবেন ভাড়া দেন। হতভম্ব আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকাই, বেশ খানিকটা সময় লাগে ধাতস্থ হতে। কোথায় আমি জিজ্ঞাসা করতেই চোখের সামনে ঝুকে পড়া বিরক্তিমাখা চেহারার প্রশ্নকর্তা তথোধিক বিরক্তি নিয়ে বলে , “আর কইয়েন, ১ ঘন্টায় মাত্র মতিঝিল পার হইলাম।
” বুঝে ঊঠতে পারি না নৌকায় না উঠেই কিভাবে মতিঝিল পার হলাম , ভোজবাজির মতই মিলিয়ে গেছে জাল হাতে বয়স্ক লোকটা , সেই গাছপালা ঘেরা সবুজ বনানী। আস্তে আস্তে সম্বিৎ ফিরতে থাকে, বুঝলাম বাসে চড়ে হয়তো কোথায় যাচ্ছিলাম, কিছু সময়ের জন্য হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোথায় আছি কোথায় যাছি ভাল করে বোঝার জন্য জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। ব্যস্ত রাস্তা জুড়ে গাড়ী আর গাড়ী, ফুটপাত ঘেঁষে গড়ে উঠা ছোট ছোট দোকানগুলাতে অফিস করা মানুষের ভিড়। একটু সামনেই বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে অস্বাভাবিক রকম খালি ফুটপাত, ফুটপাত ঘেঁষেই লম্বা উঁচু দেয়াল, দেয়ালের ঠিক ভিতরের পাশেই পাশাপাশি বেশ কয়েকটা গাছ, গাছগুলোকে দেখে অনেক দিনের চেনা পরিচিতদের মত মনে হচ্ছে, এত আপন মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক যেন চিনে উঠতে পারছি না।
অনেকদিন পরে দেখা হওয়া কোন স্বজনের মত মনে হচ্ছে যে কিনা আমার অনেক ভালবাসার অনেক আদরের। ভাবতে ভাবতে আরেকটু সামনে তাকাই, দেখি টানা লম্বা দেয়ালের এক প্রান্তে বিশাল গেট রাগী রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর গেটের ঠিক উপরের অংশে বড় বড় হরফে লিখা “নটরডেম কলেজ”
সনশেষের শুরু
কোথায় যেন পড়েছিলাম ঠিক দুপুরবেলা ভুতে মারে ঢেলা এই কথাটিকে প্রমান করতেই কিনা সূর্য যখন ঠিক মধ্য আকাশে তখনই যেন পুরো মতিঝিল দিলকুশাকে ভুতে ধরে, পিচগলা দুপুরবেলাতে যেন গাড়ী ঘোড়া সব বিকল হয়ে অতন্দ্রপ্রহরীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকা বেষ্টিত এই ব্যাস্ত অফিস পাড়ায়, ভুতে পাওয়া মানুষের মত রাজপথ আর ফুটপাথ জুড়ে কর্মব্যস্ত পথিকের অজানার দিকে ভাবলেশহীন ছুটোছুটি। আর বসে থাকতে থাকতে বুড়িয়ে যাওয়া বাস চালকের হাতের চাপে চ্যাচিয়ে ওঠা হর্নের বিকট আওয়াজে প্রকাশ পায় প্রাগৈতিহাসিক কালের জমে থাকা চিটচিটে বিরক্তি। এরকম এক ঘেমে নেয়ে ঊঠা দুপুরে কোলাহল পূর্ণ এক বাসের উদরে বসে বসে ঝিমোচ্ছি, বাসটি প্রায় এক ঘণ্টা ধরেই একই জায়গায়, আগামী এক ঘণ্টা পরে ও নড়বে কিনা সেটা শুধু উপরওয়ালাই বলতে পারবেন। দূর থেকে মতিঝিলের বুক চিরে ফুটে উঠা বিশাল শাপলাটির কিছু অংশ দেখছি আর হাই তুলছি।
শাপলাটাকে দেখে কি যেন একটা মনে পড়তে চাইছে, খুব জরুরী কিছু হয়ত কিন্তু ক্লান্তিতে আমার দুচোখ বুজে আসছে, যে কোন সময় হয়তো অতলে ডুবে যাবো, আমার ক্লান্ত দুচোখ চাইছে ঘুমিয়ে নিতে আর মন চাচ্ছে জরুরী কিছুটাকে মনে করতে , চলছে প্রাণপণ লড়াই, দুই রাজার লড়াইয়ে আমি নিরীহ আসহায় প্রজা, যেই জিতুক না কেনো আমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে।
শান্ত সকালে মধ্যাহ্ন
হঠাৎ ঝুপ করে পানিতে কিছু পড়ার আওয়াজ পেয়ে পিছনে ফিরতেই দেখি কচি কলাপাতার মতো কোমল সবুজ ঘাসের গালিচা যেখানে শেষ সেখানে এক বয়স্ক গ্রাম্য জেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, মাছের খোঁজে পানিতে ছুড়ে দেওয়া তারই কালো মোটা জালের তড়িৎ ডুবে যাওয়া দেখছে। আজকাল প্রায়ই দেখা যায় দিলকুশার বুক চিরে কুল কুল শব্দে বয়ে যাওয়া ছোটো নদীর মতো এই বিশাল খাল “মতিঝিলে” আশে পাশের গ্রাম থেকে মানুষজন মাছ ধরতে আসে। অথচ কিছুদিন আগেও একটা সময় ছিল কিছু নাম না জানা পাখি আর কিছু কাঠবিড়ালী ছাড়া এই সবুজ প্রান্তরে আর কোনো অধিবাসী ছিল না। সবুজ গাছগাছালী পার করে পশ্চিম দিকে কিছুদুর গেলে এবড়ো থেবড়ো মাঠের মধ্যে ছড়ানো ছিটানো তিনটে চারটে বাড়ি চোখে পড়ে।
মাঝে মাঝে আমরা স্কুল পালিয়ে আমার সঙ্গী দুপেয়ে যানটাকে নিয়ে এখানে চলে আসতাম। পুরোটা এলাকা সবুজ ঘাসে মোড়ানো, সবুজ ঘাস আর ধানক্ষেতের গা ছুঁয়ে বয়ে চলা মতিঝিলের পাড় ঘেঁষে দূরে দেখা যেত কতিপয় নিঃসঙ্গ মায়াবী কুটিরের ছবি, বছর খানেক আগেও যেখানে ছিল কলাগাছের সারি। শহরের শেষ উত্তর প্রন্তের সীমানা পেরিয়ে নরম হলুদ রঙের কলাগাছের ছায়াঘন পল্লবের আড়ালে আড়ালে আমি খুঁজে পেতাম আমার এক টুকরো স্বর্গ, বুঝলাম স্বর্গের মালিকানা বদলের বুঝি সময় এসেছে।
কুল কুল বয়ে যাওয়া এই বিশাল খালটাকে আমার নিজস্ব সম্পত্তি মনে হতো, মনে হত আল্লাহ বুঝি শুধু আমার জন্যই মতিঝিল খালটাকে বানিয়েছে। যদিও অনেক পরে জেনেছি, ইসলাম খাঁ নামে জনৈক শাসক নৌপরিবহন আর পয় নিস্কাসনের জন্যে ঢাকার বুকে দুটো খাল কেটেছিলেন।
যার একটি ধোলাইখাল, বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে বাবুবাজার দিয়ে যাত্রা শুরু করে বাবুবাজারের পুলের নিচ দিয়ে তাঁতিবাজারের পাস দিয়ে নবাবপুর নারিন্দা রোড অতিক্রম করে সরাফতগঞ্জ হয়ে লোহারপুলের নিচ দিয়ে আবার সেই বুড়িগঙ্গার গর্ভেই। আর দ্বিতীয়টি তাঁতিবাজার মালিটোলা হয়ে বংশাল রোড পার হয়ে সুরিটোলার পশ্চিমে ঘুরে নাজিরাবাজার ও দেওয়ান বাজার অতিক্রম করে নিমতলি হয়ে শাহাবাগ ও গাছে গাছে , ফুলে, ফুলে ঘাসে, ঘাসে রমণীয় রমনা গ্রীনের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে একসময়ের ব্রিটিশ সেনা ছাউনি পুরানা পল্টন পার হয়ে দিলকুশার বুক চিরে সোজা পূর্ব দিকে চলে গিয়েছি, আমার ছেলেবেলার স্বর্গ, মতিঝিল খাল।
কয়েক বছরের ব্যাবধানে গাছগাছালির কোন পরিবর্তন না হলেও মানুষের অনধিকার প্রবেশ যেন বেড়েছে, বেড়েছে আমার ছেলেবেলার রহস্যময়ি বুড়ীর বাগান বাড়ি “দিলকুশা গার্ডেনের” নোনাধরা প্রাচীন প্রাচিরের গায়ে বেঁচে থাকা লতাপাতা গুল্ম। শুধু ভেতরে অযত্নে বেড়ে উঠা পদ্মপাতায় ঢেকে যাওয়া মস্ত সরোবরটাই বুঝি দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে। মতিঝিলের তীর ঘেঁষে পুরো দিলকুশাকে ঘিরেই বাগ এ দেলখোশ এর সীমানা।
এই বিশাল এলাকার মাঝে বেখাপ্পা দোতলা বাগানবাড়িটা যেন আরও বুড়ীয়ে গেছে এ কবছরে।
একবার শীতের সকালে সাইকেল নিয়ে একটু বেশীই ভিতরের দিকে চলে গিয়েছিলাম, মতিঝিল খালের একেবারে উত্তরের অংশে। সেখানে গিয়ে দেখি সৌখিন মাছ শিকারি ছিপ পেতে বসে আছে। আর দুরে কারা যেন পানিফলের পাতার উপর হেঁটে বেড়ানো চিকন ঠোঁটের কালো সাদা পাখি শিকারে নিমগ্ন, কান্নামাখা কুয়াশার চাদরে ঢাকা কচুরিপানার ফাকে ফাকে ডাহুক, বক নানারকম পাখির ছড়াছড়ি। সেদিন বাসায় এসে খুব কেঁদেছিলাম ঈষৎ বড় ঠোঁটওয়ালা এক অর্ধমৃত সাদাবকের করুন চাহনী দেখে, সেই অর্ধমৃত মায়াকাড়া চোখ আমার পুরো শৈশব কৈশোর জুড়ে অনেক কাল তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
বছর খানেক আগেও মতিঝিলের তীর থেকে পশ্চিম গুলিস্থান পর্যন্ত, উত্তরে পল্টন, রমনা পর্যন্ত পুরো এলাকাই ছিল ঘাসে মোড়া হরিৎ স্বর্গ। মনে পড়ে বিশাল নরম সবুজ ময়দানের প্রাণকাড়া ওই কোমল ঘাসের পরে আমার বাসর করার ও সাধ জেগেছিল আমার পড়ন্ত কৈশোরে। বাগ-বাগিচা শোভিত শহরের শেষ প্রান্তে অনেক খালি জায়গা নিয়ে গড়ে উঠা রমণীর রমনায় ধীরে ধীরে বসতি গড়ে তোলে শহরের সম্ভ্রান্ত লোকেরা। আর আমার সবুজ স্বপ্নটা ও বুঝি ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। ফিকে হয়ে আসা সবুজ ময়দান পেরিয়ে আমি স্মৃতির বাক্সপেটারা খুলে হারিয়ে গিয়েছিলাম, সম্বিৎ ফিরে অনতিদুরে বুড়ো খালের পাড়ে পাশাপাশি বেড়ে উঠা কয়েকটা কড়ই গাছের ছায়ায় দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক জেলের মতিঝিলের জীর্ণ বুকে ছুড়ে দেওয়া জালের ঝপাৎ শব্দে।
মলিন হতে থাকা ঘাসে মোড়া সবুজ ময়দান, প্রায় শূন্য কলাগাছের সারি , ছড়ানো ছিটানো কড়ই মেহগনি শীর্ণ মতিঝিলের উত্তর পশ্চিম সীমানাকে এখনো মলিন করতে পারেনি দেখে আমি স্বস্তি পাই, আমি বেঁচে উঠি। কেন জানি মনে হয় এই মতিঝিল মরে গেলে বুঝি আমিও মরে যাবো, এই ঘাসের প্রতিটি ডগায় যেন আমার প্রান গেঁথে আছে। আজীবন বেঁচে থাকুক আমার মতিঝল খাল, এই ছোট্ট চাওয়া টুকু বুকে গেঁথে এগোই কড়ই গাছের তলে যেখানে সেই গ্রাম্য পুরুষটি দাঁড়িয়ে মাছ সিকারে নিমগ্ন। সেই কৈশোর কোলে চড়া গাছগুলো আজ রীতিমতো মোটাসোটা পূর্ণবয়স্ক, গম্ভীর যেন সমস্ত দিলকুশাকে পরম যত্নে আগলে রেখেছে। খালের কাছাকাছি পৌঁছে দেখি ২/৩ টি নৌকা বাঁধা গাছটির প্রকাণ্ড গুড়িতে।
খুব সাধ জাগে ছোটবেলার অপূর্ণ ইচ্ছাটাকে পূর্ণ করতে, মতিঝিলের টলমল পানি নৌকায় চড়ে পার হতে খুব ইচ্ছে হয়, আশেপাশে কাউকে না পেয়ে সেই জাল ছোঁড়া বয়স্ক লোকটিকেই জিজ্ঞাসা করি চাচা, চাচা বলতে পারেন এই নৌকা গুলো কার, আমি একটু ওপারে যাবো, চাচা চাচা, ও চাচা। কোনোমতেই যেন আমার ডাক পৌঁছায় মাছ ধরায় নিমগ্ন লোকটির কানে, আমি চাচা, চাচা বলে ডাকতেই থাকি, সমস্ত গাছপালায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ওই ডাক শুধু আমার কানেই যেন বাজতে থাকে।
গোধূলি বেলা
চাচা, চাচা, ও চা;6চা, ডাকটা এবার নিজের কানে বাজতেই ধড়ফড়িয়ে উঠি, কেউ একজন বলে, কতক্ষন ধইরা ডাকতাছি, কই যাইবেন ভাড়া দেন। হতভম্ব আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকাই, বেশ খানিকটা সময় লাগে ধাতস্থ হতে। কোথায় আমি জিজ্ঞাসা করতেই চোখের সামনে ঝুকে পড়া বিরক্তিমাখা চেহারার প্রশ্নকর্তা তথোধিক বিরক্তি নিয়ে বলে , “আর কইয়েন, ১ ঘন্টায় মাত্র মতিঝিল পার হইলাম।
” বুঝে ঊঠতে পারি না নৌকায় না উঠেই কিভাবে মতিঝিল পার হলাম , ভোজবাজির মতই মিলিয়ে গেছে জাল হাতে বয়স্ক লোকটা , সেই গাছপালা ঘেরা সবুজ বনানী। আস্তে আস্তে সম্বিৎ ফিরতে থাকে, বুঝলাম বাসে চড়ে হয়তো কোথায় যাচ্ছিলাম, কিছু সময়ের জন্য হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কোথায় আছি কোথায় যাছি ভাল করে বোঝার জন্য জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। ব্যস্ত রাস্তা জুড়ে গাড়ী আর গাড়ী, ফুটপাত ঘেঁষে গড়ে উঠা ছোট ছোট দোকানগুলাতে অফিস করা মানুষের ভিড়। একটু সামনেই বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে অস্বাভাবিক রকম খালি ফুটপাত, ফুটপাত ঘেঁষেই লম্বা উঁচু দেয়াল, দেয়ালের ঠিক ভিতরের পাশেই পাশাপাশি বেশ কয়েকটা গাছ, গাছগুলোকে দেখে অনেক দিনের চেনা পরিচিতদের মত মনে হচ্ছে, এত আপন মনে হচ্ছে কিন্তু ঠিক যেন চিনে উঠতে পারছি না।
অনেকদিন পরে দেখা হওয়া কোন স্বজনের মত মনে হচ্ছে যে কিনা আমার অনেক ভালবাসার অনেক আদরের। ভাবতে ভাবতে আরেকটু সামনে তাকাই, দেখি টানা লম্বা দেয়ালের এক প্রান্তে বিশাল গেট রাগী রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর গেটের ঠিক উপরের অংশে বড় বড় হরফে লিখা “নটরডেম কলেজ”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।