আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্নিগ্ধ ভালবাসা

নূর রবি

এক|| সজীবের আজ মনটা খুব ভাল, সপ্তাহে তিনটা দিন বিকেল থেকে তার মন খুব ফুরফুরে থাকে; রুয়েটের হামিদ হল থেকে বের হয়ে তালাইমারী থেকে একটা রিক্সা নিয়ে সাগরপাড়ার উদ্দেশ্য রওনা হল। রিক্সায় উঠেই তার সিগারেট ধরানোর অভ্যাস, গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময়টা এতে কেটে যায়। কিন্তু আজ সে সিগারেট ধরাল না, আসলে সপ্তাহের এই তিনটা দিন এই যাত্রাটুকু সে খুব উপভোগ করে- প্রতিটা মুহূর্ত দুরুদুরু বুকে তার মনে হতে থাকে কখন পৌঁছাবে! তার মনে হয় তীর্থযাত্রার আগে নিজেকে পবিত্র রাখা জরুরী। আর তাছাড়া এই তীর্থযাত্রার পরে পাপমোচনের আনন্দ উদযাপন করতে তার সারারাত নির্ঘুম কেটে যায়- তখন সঙ্গী থাকে এই সিগারেটইতো! ফার্স্ট ইয়ার থেকেই সে টিউশনি করে দুই-তিনটা করে, বাসা থেকে কোন টাকা-পয়সা নেয়না। ব্যক্তিগত চাহিদা কম থাকার কারণে খরচ করেও কিছুটা বেঁচে যায়- সেটা সে পাঠিয়ে দেয় বাবা-মাকে, ছোট ভাইবোন দুটোর পড়াশোনার জন্য! সহপাঠীদের দেখাদেখি তারও প্রেম করার শখ ছিল; কিন্তু তেমন কোন মেয়ে পায়নি যাকে তার প্রেমিকা হিসেবে পেতে খুব ভাল লাগবে।

টিউশনি করতে করতে দুই-একজন ছাত্রীর সাথে হয়ত কিছু একটা হতে পারত, কিন্তু নিজের মনে আদর্শিক কারণে তেমন সায় পায়নি বলে আর প্রেম করা হয়ে ওঠেনি। তারপর হঠাৎ এই নিতুর আগমন! নিতুকে তার খুব ভাল লাগে- আসলে এত সুন্দর একটা মেয়ে যে তার সাথে কথা বলবে সেটাই সে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনা! আর নিতুর সব কিছুই ভাল...যাকে বলে মানসপ্রতিমা!- পড়ে ভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে, সাবজেক্ট ফিজিক্স, উচ্চমধ্যবিত্তের মেয়ে বলে কোন অহংকার নেই- সারাক্ষন হাসিখুশি থাকে, খুবই মিশুক-আত্মবিশ্বাসী। আর তার সুন্দর মুখের হাসি দেখার জন্য সজীব হাজার বছর ধরে হাজার মাইল হেঁটে পাড়ি দিতে পারবে! নিতু আসলে মিতুর বড়বোন; মিতু সজীবের ছাত্রী, সে পড়ে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। গত প্রায় দেড় বছর ধরে সে মিতুকে পড়াচ্ছে...এই মেয়েটি পড়াশোনায় বেশ তুখোড়। সজীব ওকে পড়িয়ে বেশ আরাম পায়।

বছরখানেক আগে একদিন মিতুকে পড়াতে পড়াতেই হঠাৎ নিতু এসে হাজির তার ম্যাথের একটা প্রবলেম নিয়ে...যেহেতু সে রুয়েটে পড়ে তাই নিতুর ধারণা ছিল সজীব সহজেই তার অংক করে দিতে পারবে। সজীব পেরেছিল কিন্তু সাথে সাথে তার হৃদয়ে সুখের মত ব্যথাও শুরু হয়ে গিয়েছিল! আরেকদিন সে পড়াতে যেতে পারবেনা এই কথা জানানোর জন্য ফোন করেছিল...ফোন ধরেছিল নিতু; আর নিতুর কন্ঠ তখন থেকেই তার পরম আকাঙ্ক্ষিত মনে হতে থাকে। তখন থেকেই নিতুর সাথে তার বন্ধুত্বের সূচনা, তার জীবনের প্রথম বন্ধু যে একজন মেয়ে! এরপর প্রায়ই সে নিতুর গলা শোনার জন্য ফোন করে...অবশ্য অজুহাতটা থাকে মিতুর পড়াশোনা বিষয়ক। মিতু সবই বোঝে...তাই সে ফোনটা পাচার করে দেয় নিতুর হাতে। সজীব জানে নিতু তাকে পছন্দ করে; আর মিতুর সাথে কথা থেকে এটাও বোঝে যে নিতু জানে সজীবও নিতুকে নিয়ে অনেক ভাবে।

তবু কখনো বলা হয়না...সপ্তাহের তিনটি দিন তাই সে অস্থির হয়ে ছুটে যায় নিতুর সাথে একটু দেখা আর পাঁচ-দশ মিনিটের কথোপকথনটুকুর জন্য! মিতু বুদ্ধিমতী সে তার পড়াটুকু আদায় করে নেয়ার পাশাপাশি সুযোগ করে দেয় সজীবকে...তার এই ভালমানুষ স্যারটিকে খুব ভাল লাগে। সে ভাবে আপুর সাথে যদি কিছু হয় খারাপ কী! সজীব ভাবছে কয়দিন পর মিতুর টেস্ট পরীক্ষা- সামনে ইন্টার। তাই সে সামনে থেকে সপ্তাহে চারদিন করে পড়াতে যাবে...টাকা বাড়াতে হবে না! দেখা যাক, আজই সে মিতুর মাকে বলবে কথাটা... । । দুই একটি বছর পার হয়ে গেছে।

সজীব ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে গত কয়দিন ধরে চাকরী করছে। বেতন খুব একটা বেশী না কোনরকমে চলে যায়...আসলে অভিজ্ঞ না হওয়া পর্যন্ত এই দেশে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের তেমন ভাত নেই! রেজাল্ট ভাল তাই সজীব ভাবছে দেশের বাইরে স্কলারশীপের আবেদন করবে, কিন্তু এদিকটা না গুছিয়ে কীভাবে সে যাবে! এদিকে মিতুর ইন্টারের রেজাল্ট খুব ভাল হয়েছে; তারও রুয়েটে পড়ার ইচ্ছা। মিতুর ইচ্ছা সজীব স্যার তাকে ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত পড়াক। কিন্তু সজীব প্রাইভেট অফিসের চাপে সময় দিতে পারেনা। এদিকে সজীবের বাবা বুড়ো হয়েছেন, কেরাণীর চাকরী থেকে অবসর নিয়েছেন! এখন তার বড় ছেলেকে বিয়ে করানোর দায়িত্বটা পালনের শখ ! আর এদিকে পারিবারিকভাবে নিতুর বিয়ের কথাবার্তা চলছে।

কিন্তু সজীব এখন নিতুকে ছাড়া কোনকিছু ভাবতে পারেনা...তাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়েছে। যদিও দুজনের কেউই প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি...তবুও সজীব বুঝতে পারে ! সজীব ভাবছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে...শীঘ্রই! । । তিন রাত তিনটা। সজীব বসে আছে মস্কভা নদীর তীরে...প্রচন্ড ঠান্ডায় সবকিছু জমে যাচ্ছে।

পাগুলোতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে কিন্তু তার উঠতে ইচ্ছা করছেনা...আরেকটা সিগারেট ধরালো সে। গত আড়াই বছর ধরে সপ্তাহে তিনটি রাত সে এখানে কাটায়...জমে যাওয়া নদীর তীরে প্রচন্ড ঠান্ডায় বসে থাকে। প্রবল এক শূন্যতার অনুভূতি তাকে ঘিরে রাখে এই সময়টা...সে কোনকিছু ভাবে না, না অতীত, না বর্তমান, না ভবিষ্যত...শুধু শূণ্যতা! এই ঠান্ডা-এই জমে যাওয়া তাকে সাহায্য করে এই জগত থেকে তার আপন শূণ্যতার জগতে যেতে। সারাদিন সে ল্যাবে উম্মাদের মত কাজ করে, ইতোমধ্যে বড় বড় জার্নালে তার বেশ কিছু পেপার পাব্লিশ হয়েছে...কিন্তু যত কাজই থাকুক সপ্তাহে তিনটি রাত সে এখানে কাটায়! তিন বছর আগে সে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল নিতুদের বাসায়; নিতুর মা-বাবা তাকে বেশ পছন্দ করতেন। কিন্তু তার পরিবারের অবস্থার কথা তাদের জানা ছিল না।

তবুও তারা রাজি হয়ে গিয়েছিলেন...কিন্তু রাজি হয়নি নিতু! সে সরাসরি নূন আনতে পান্তা ফুরায় এমন পরিবারে যেতে আপত্তি জানায়; আরও জানিয়ে দেয় সে সজীবকে শ্রদ্ধা করে -খুব ভাল বন্ধু ভাবে কিন্তু কখনো তাকে বিয়ে করবে এমনটা ভাবেনি! । । চার সজীব দীর্ঘ সাত বছর পর দেশে এসেছে ছোট বোনটির বিয়ে উপলক্ষে। রাশিয়া থেকে পিএইচডি করে সে দুয়েকটা কোম্পানিতে কন্সাল্টেন্সি করেছে; তার ইউনিভার্সিটি তাকে সেখানে জয়েন করতে বলেছে। ফিরে গিয়ে সে জয়েন করবে ভাবছে।

অনেকদিন পর দেশে এসেছে...সবকিছুই অন্যরকম! সে এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত, পরিবারের সবাইকে সে ঢাকায় নিয়ে এসেছে, ছোট একটা বাড়ি কিনে দিয়েছে, ছোট ভাইটিও কিছুদিনের মধ্যে ভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরোবে। তার চাচাত বোনের মেয়েটি বায়না ধরেছে, বেইলী রোডে তাকে ফাস্টফুড খাওয়াতে হবে আর তাকে হুমায়ঊন আহমেদ নামে এক লেখকের বই কিনে দিতে হবে। হঠাৎ পেছনে ঘুরতেই সে দেখতে পায় নিতুকে। নিতুও তাকে দেখে এগিয়ে আসে...তার সাথে একটা ফুটফুটে ছেলে। নিতু আগের মতই কথার তোড়ে সজীবকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

তখন সজীব জানতে পারল ছেলেটি মিতুর; সজীব রাশিয়া চলে যাওয়ার পরপরই নিতু বিয়ে করে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিয়েটা পাঁচ বছরের বেশি টেকেনি। নিতু এবং তার স্বামী পরস্পরকে প্রবলভাবে ভালবাসলেও তার দুজনের দিক থেকেই দুজনে কিসের যেন একটা অভাব-কী যেন এক শূণ্যতা টের পেত! একটা পর্যায়ে তাদের মাঝে দূরত্ব এতই বেড়ে যায় যে সেটা অতিক্রম করা কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। তাই বছর দুয়েক আগে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়...নিতুর স্বামী এখন অন্যএকজনকে বিয়ে করে সুখে আছে; তবে দুজন এখনো ভাল বন্ধু! এই কথাগুলো শোনার সাথে সাথে সজীবের সারাজীবনের সব আবেগ-সব স্বপ্ন আবার এসে ভীড় করল; বিগত প্রায় দশ বছরের নিতুকে না-বলা কথাগুলো তীব্রগতিতে জলচ্ছ্বাসের মত বের হয়ে আসল। ঠিক সেই মুহূর্তেই সজীব নিতুকে জানাল সে এখনো নিতুকে পাগলের মত ভালবাসে! এবং নিতু রাজী থাকলে সে তাকে বিয়ে করতে চায়! নিতু এতটা আশা করেনি! কিন্তু সে সজীবের আবেগ-ভালবাসার তীব্রতা-গত কয়েক বছরের যন্ত্রণা সবকিছুই যেন চোখের সামনে দেখতে পেল...সজীবের অনুভূতির প্রকাশ তাকে এবার ভীষণভাবে এলোমেলো করে দিল।

এবং সে সজীবকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কোন অজুহাতই আজ খুঁজে পেলনা। বোনের বিয়ের পরপরই কিছুদিনের মধ্যে মহাধুমধামের সাথে সজীব-নিতুর বিয়ে হয়ে গেল; আর সেই বিয়েতে সবচেয়ে খুশি হল মিতু। । । পাঁচ সাত বছর পর! সজীব আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে চাচ্ছিল, কিন্তু ডিপার্টমেন্টে প্রফেসরদের মিটিংটা দেরি করিয়ে দিল।

আজ তার মেয়ের দ্বিতীয় জন্মদিন...মেয়েটা তাকে বারবার করে বলে দিয়েছে যেন খুব তাড়াতাড়ি সে বাসায় যায়। কিন্তু এই অফিস ছুটির পর হাইওয়ের ট্রাফিক তার মেজাজ খারাপ করিয়ে দিচ্ছে ...ঘরে অপেক্ষায় তার মেয়ে অনী আর বউ স্টেফানি!! হ্যাঁ, স্টেফানি...যে অসাধারণ আমেরিকান মেয়েটি তাকে প্রবল ভালবাসায় -প্রচন্ড আবেগে গত পাঁচ বছর ধরে তাকে ঘিরে রেখেছ। তিন বছর হল তারা বিয়ে করেছে; সে আজ ভীষণ সুখী ...কল্পনা করা যায়না এমন সুখী! এখন সজীবের অতীত নিয়ে কোন দুঃখ নেই-কোন অপ্রাপ্তি নেই...খুব একটা মনেও পড়েনা। নিতুর সাথে তার বিয়েটা একদমই সুখের ছিলনা...একবছরের মাথায় সেটা ভেঙ্গে যায়। সজীবের সামাজিক-পারিবারিক জীবনের অনভিজ্ঞতা, প্রবল ছেলেমানুষী আবেগ, বদলে যাওয়া সময়ের সাথে মানিয়ে নেয়ার অক্ষমতা আর অন্যদিকে জীবনে পোড় খাওয়া নিতুর কাছে শক্ত-নির্ভর করার মত একজন স্বামী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নেয়ার ব্যর্থতা তাকে বিবাহিত জীবনে শান্তি দেয়নি।

সে নিতুর প্রবল আবেগী-হাসিখুশি যে রূপটিকে হৃদয়ে পূজার আসনে বসিয়েছিল...তা কখনোই নিতুর মাঝে খুঁজে পায়নি! ছাড়ছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর সে আমেরিকার এক ভার্সিটিতে যোগ দেয়...সেখানেই স্টেফানির সাথে তার পরিচয়। আহ, যাক ! সামনে রাস্তা খালি...সজীব দ্রুত এক্সেলেটরে চাপ বাড়ায়...তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্টেফানির ভালবাসাময় মায়াভরা মুখটি...যার জন্য সে হাজার বছর ধরে হাজার হাজার মাইল হেঁটে পাড়ি দিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.