প্রেম ছিল, আশা ছিল
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিজয় সত্যিই রূপকথার মতো। আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসে এর আগে কখনোই রচিত হয়নি এমন গৌরবময় উপাখ্যান। ২-০ তে টেস্ট সিরিজ এবং ৩-০ তে ওয়ান ডে সিরিজ জয়। বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো সাফল্যের গৌরব।
১৯৯৭ সালে বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে কেনিয়ার বিপে জয়লাভের পর সারা দেশের মানুষ আনন্দের জোয়ারে ভেসেছিল।
সেদিন সমগ্র জাতি এক হয়ে রাস্তায় নেমেছিল বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে। সর্বস্তরের মানুষ সেদিন নেচে-গেয়ে আর রং মেখে প্রকাশ করেছিল উচ্ছ্বাস। টাইগাররা বিশ্বকাপের প্রথম আসরে খেলতে নেমেই শক্তিশালী পাকিস্তানকে হারিয়ে নিজেদের আগমনি বার্তা জানান দিয়েছিল। কিন্তু এই জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে সাফল্য এসেছে ধীরে ধীরে।
জয় এসেছে কালেভদ্রে। কিন্তু ধারাবাহিক সাফল্য দেখা দিল এই প্রথমবারের মতো। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর মাধ্যমে একদিনের ক্রিকেটে ইংল্যান্ড ছাড়া সব দলকেই হারাতে সম হলো বাংলাদেশ।
একমাত্র টি টোয়েন্টি ছাড়া সব ম্যাচ জিতেছে ধারাবাহিকভাবে, অর্জন করেছে টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ জয়ের দুর্লভ সম্মান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইট ওয়াশ করে নতুন এক ইতিহাস গড়েছে টাইগাররা।
দলের এই সাফল্য নতুন করে উদ্দীপ্ত করেছে জাতিকে। এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কি হতে পারে!
বাংলাদেশ দল নিয়ে সমর্থকদের আশাভঙ্গের বেদনা দীর্ঘদিনের। শুধু জয় নয়, ভালো খেলার ক্ষেত্রে দলের ঘাটতি লক্ষ করা যেত। অতীতের বিভিন্ন ম্যাচ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাজে বল খেলে আউট হওয়া, প্রতিপকে অকারণে উইকেট বিলিয়ে দেওয়া, বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করা টাইগারদের নিত্যদিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দলের এই বেহাল দশাকে অনেকেই রসিকতা করে বলতেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ইনস্ট্যান্ট নুডলস্ তৈরির কারখানা, `যাওয়া-আসা মাত্র দুই মিনিট'।
সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে এমন একটা সফর খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের পুরো সময়টাতেই টাইগারদের মধ্যে ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাস। প্রতিটা ম্যাচেই ছিল তাঁদের লড়াকু মনোভাবের পরিচয়। বোলিং বা ব্যাটিং, কোনোটাতেই সুবিধা করতে দেননি ওয়েন্ট ইন্ডিজ দলকে। ধারাবাহিক সাফল্যের এই জয়যাত্রা দেশের মানুষকে যেমন আনন্দ দিয়েছে, তেমনি প্রত্যাশাও বাড়িয়েছে অনেক।
নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করতে শুরু করেছে ক্রিকেটপ্রেমী সমর্থকেরা। তবে রাতারাতি খুব বড় কোনো পরিবর্তন আশা করা ঠিক হবে না। দলের এই বিজয় ইতিবাচক একটা পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে, যা আমাদের ক্রিকেটের অস্তিত্বের স্বার্থেই খুব প্রয়োজন ছিল।
ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিং তিনটি বিষয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তিনটির যেকোনো একটির দুর্বলতা দলের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
এই সফরের বেশির ভাগ ম্যাচেই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানরা ভালো করতে পারেননি। কিন্তু বোলাররা অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন সঠিকভাবে। ধারাবাহিক সাফল্য পেতে বোলারদের পাশাপাশি ব্যাটসম্যানদেরও ভালো পারফরম্যানস করতে হবে।
টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের কাছে শোচনীয় পরাজয়ে দারুণভাবে হতাশ হয়েছিল দেশবাসী। তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছিল ক্রিকেট আঙিনায়।
মোহাম্মদ আশরাফুল অধিনায়কত্ব হারান।
বেশ কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশ্ন উঠেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের মান নিয়ে। বলতে দ্বিধা নেই, অনেকটা হুমকির মুখে পড়েছিল টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। এবার তার উচিত জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এখন প্রয়োজন সাফল্যকে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদপে গ্রহণ।
একটি বিজয়ের আনন্দে গা না ভাসিয়ে ভবিষ্যতে কীভাবে আরও ভালো করা যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করা দরকার। বিগত দিনের ভুলগুলো সংশোধন করে প্রতিটা ম্যাচে নিজের সেরা খেলাটা উপহার দিতে হবে খেলোয়াড়দের। আর সেই দৃঢ় প্রত্যয়ের হাত ধরেই আসবে ধারাবাহিক বিজয়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রত্যেক ক্রিকেটার উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে। তবে বিশেষ করে বলতে হয় অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের কথা।
শেষ ওয়ানডে ম্যাচটি ছাড়া পুরো সফরে অলরাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন বিশ্বের এক নম্বর অল রাউন্ডার। পুরো সফরেই তিনি ছিলেন নত্রের মতো জ্বলজ্বলে। মাশরাফির অসুস্থতায় পাওয়া অধিনায়কত্বের চাপ তাঁকে ভারাক্রান্ত করতে পারেনি, বরং এনে দিয়েছে অনেক ভারত্ব। দলকে প্রতিটি ম্যাচেই নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। দীর্ঘ রান-খরা কাটিয়ে আশরাফুলের রানে ফেরা ছিল এই সিরিজ থেকে আমাদের বড় পাওয়া।
তামিম ইকবাল টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন। তার পরও ব্যাটিংয়ে ঘাটতি রয়েই গেছে।
`নিষিদ্ধ' ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) ফেরত ক্রিকেটারদের বিসিবি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। তাহলে এখন তো তাদের জাতীয় দলে খেলতে আর কোনো বাধা নেই। ব্যাটিং সাইডকে শক্তিশালী করতে হলে হাবিবুল বাশার, শাহরিয়ার নাফীস, আফতাব বা অলক কাপালির মতো পরীতি খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে একাধিক খেলোয়াড়কে অতিসত্বর দলে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নির্বাচকেরা ভাববেন বলেই আশা করি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে দলে যে গতি এসেছে, তা ধরে রাখতে না পারলে আবারও হোঁচট খেতে পারে আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। তাই সাফল্যের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে নতুন প্রতিভাবান ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের সংমিশ্রণ খুবই জরুরি।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর শেষ করেই ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে জিম্বাবুয়ে যাচ্ছেন টাইগাররা। আমরা আশা করি, সেখান থেকেও তাঁরা সিরিজ জয় করে দেশে ফিরবেন। দলের বিজয় যেমন জাতিকে আনন্দ দেয়, ঠিক তেমনি দায়িত্ববোধও বাড়িয়ে দেয় খেলোয়াড়দের।
দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আশরাফুল তো বলেই বসলেন, `জয় একটা অভ্যাসের ব্যাপার। ' সত্যিই তাই। আমরাও বিশ্বাস করতে চাই, আমরা যেন প্রায়ই জয়ের দেখা পাই। জয় যেন সত্যি সত্যিই অভ্যাসে পরিণত হয়।
সফলতা ধরে রাখার দায়িত্ব শুধু খেলোয়াড়দের একার নয়।
ভালো ফল পেতে ভালো খেলোয়াড়ের পাশাপাশি প্রয়োজন সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি) একটা বড় দায়িত্ব রয়েছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে প্রতিভার অনুসন্ধান করতে বিসিবিকে আরও মনোযোগী হতে হবে। বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরি করতে হলে পেশাদারি ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের ছোট্ট শহরগুলোয়ও।
(প্রথম আলোয় প্রকাশিত, ৫ আগস্ট ২০০৯)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।