ফেসবুক আইডি:নাই
জিয়াউর রহমান হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি। দণ্ডাদেশ পরিবর্তনের পর যাবজ্জীবন জেল। জেল থেকে বেরিয়ে ব্যবসায়ী। রাজনীতি না করেও সর্বশেষ আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য। বর্তমানে গফরগাঁওয়ের স্বঘোষিত ‘লাটভাই’ সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাতারাতি বনে গেছেন গডফাদার। গড়ে তুলেছেন বিশাল বাহিনী। সংসদ সদস্যের এই বাহিনীর হাতে প্রায় প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য তার দলের নেতারাই লিখিত অভিযোগ করেছেন দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে।
সংসদ সদস্য এবং তার বাহিনীর ক্যাডাররা লুটপাট করেছে টিআর এবং কাবিখা’র প্রায় ১৩ শ’ টন চাল।
বিগত সময়ে যেসব সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন করেছে তারাই এখন আবার সংসদ সদস্য গিয়াসের ছত্রছায়ায় নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। জার্সি বদল করে তারা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে তার। নির্বাচন করতে যে খরচ হয়েছে সেই টাকা তোলার জন্য চাঁদাবাজি করছে প্রকাশ্যে। সর্বশেষ গত শুক্রবার দুপুরে কোন কারণ ছাড়াই গিয়াসউদ্দিনের নির্দেশে তার উপস্থিতিতেই ক্যাডাররা গফরগাঁও সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কামালউদ্দিন আহমেদের ওপর হামলা করেছে- অভিযোগ এলাকাবাসীর। অফিস থেকে টেনে বের করে মারপিট করা হয়েছে তাকে।
গাড়িতে বসে অধ্যক্ষকে মারপিটের সেই দৃশ্য দেখেছেন সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিন।
শনিবার ঘটনার বিচার দাবি করে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল করে। পরে অধ্যক্ষের ওপর হামলাকারী সন্ত্রাসীরাও মিছিল করে। মিছিলে সন্ত্রাসীরা স্লোগান দেয় ‘ক্যাপ্টেন গিয়াসের অ্যাকশান, ডাইরেক্ট অ্যাকশান’। এ ঘটনা নিয়ে সন্ত্রাসের জনপদ গফরগাঁওয়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিতর্কিত এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দলের সাধারণ সম্পাদককে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও থেমে নেই ক্যাডারদের কর্মকাণ্ড আর চাঁদাবাজি। সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র সাত মাসেই দলীয় এই সংসদ সদস্য এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ। সাধারণ মানুষেরও।
কে এই ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন?
বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যার ঘটনায় ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
বিচারে ফাঁসির আদেশ হয়। পরে রিভিউ কমিটির পর্যালোচনার পর ফাঁসির আদেশ প্রত্যাহার করে ১৪ বছর জেল হয়। জেল থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রামে ব্যবসা শুরু করেন। নাম লেখান আওয়ামী লীগে। কিন্তু কখনও সক্রিয় রাজনীতি করতেন না।
স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তার কখনও কোন প্রকার যোগাযোগ ছিল না। জোট সরকারের পাঁচ বছরে দলের নেতা-কর্মীর নির্যাতিত হলেও তিনি কোনদিন কাউকে দেখতেও আসেননি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরও এলাকায় আসেননি। সংসদ সদস্য হওয়ার পর এখনও উপজেলা আওয়ামী লীগের সব নেতাকে তিনি চেনেন না।
চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা যখন সঙ্গী
বর্তমানে তিনি এলাকায় এলে তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী থাকেন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা হত্যার দায়ে অভিযুক্ত লংগাইর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ।
অপারেশন ক্লিন হার্ট ও জরুরি অবস্থায় যৌথবাহিনীর হাতে আটক হওয়া এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী তিনি। এছাড়া কুখ্যাত মোখলেস ডাকাত, সন্ত্রাসী ইমাম খালিদ বিপ্লব, সজীব, সোহাগ, তায়েফ, রশীদ, শাজাহান ফকির, সাগর ও বহুল আলোচিত ডা. শফিক সবসময় তার সঙ্গে থাকেন। এদের মাধ্যমে চলছে নানা ধরনের অপকর্ম। চাঁদাবাজি, টিআর ও কাবিখা’র চাল লুটপাট আর প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার নানা তৎপরতা।
গত ১১ই এপ্রিল গিয়াসউদ্দিনের নির্দেশে তার বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় সমকাল প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল আমিন বিপ্লবকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে।
ওইদিন দুপুরে একটি অনুষ্ঠানে যোগদান দিতে যাওয়ার সময় রাস্তার ওপর গাড়ি দাঁড় করিয়ে গিয়াসউদ্দিন সাংবাদিক বিপ্লবকে এই বলে হুমকি দেন যে, পাঁচ বছরের মধ্যে তার বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট করা যাবে না। লিখলে পেটানো হবে। এ সময় লংগাইর ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি কারি রুহুল আমিন সংসদ সদস্যকে বলেন, আপনি সন্ত্রাসী সঙ্গে করে ঘুরে বেড়ান কেন? আপনার গাড়িতে বসা ওই সন্ত্রাসী হামিদ আমার বাড়িঘরের সবকিছু লুটপাট করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে গিয়াসউদ্দিন তাকে মারধর করেন এবং গায়ের পাঞ্জাবি টেনে ছিঁড়ে ফেলেন।
সন্ধ্যায় বিপ্লবসহ কয়েকজন সাংবাদিক শহরের কলেজ রোডের একটি কম্পিউটারের দোকানে বসে এ ঘটনার রিপোর্ট লেখার সময় ইমাম খালিদ, সজীব, রাজনসহ ১০-১২ সন্ত্রাসী সেখানে যায়।
চাপাতি দিয়ে সাংবাদিক বিপ্লবকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে তারা। এ সময় সংসদ সদস্য কিছু দূরে গাড়িতে বসে ছিলেন। ঘটনার সময় পুলিশ সেখানে উপস্থিত থাকলেও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এ ঘটনায় সন্ত্রাসীদের নামে মামলা হলেও পুলিশ সাংবাদিকের ওপর হামলাকারী কোন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করেনি। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশী বিদেশী কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন এ সময় সাংবাদিক বিপ্লবের পাশে এসে দাঁড়ায়।
টিআর ও কাবিখা’র চাল লুটপাট
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বর্তমান সরকারের গত সাত মাসে কাজের বিনিময়ে খাদ্য-কাবিখা’র বিভিন্ন প্রকল্পে ৫৯৭ টন এবং টেস্ট রিলিফ- টিআর প্রকল্পের আওতায় ৬৭৪ টন চাল বরাদ্দ হয়। কিন্তু এসব প্রকল্পের কোন কাজ হয়নি মাঠ পর্যায়ে। সবকিছু কাগজপত্রে হলেও বাস্তবে কিছুই নেই। এসব প্রকল্পের ভুয়া মাস্টার রোল তৈরি করে লুটপাট করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় উপজেলার ত্রিমোহিনী বানার নদীর পাড়ের রাস্তায় সংসদ সদস্যের গ্রাম পাতলাশি মুক্তিযোদ্ধা জালালের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ৮০ টন চাল বরাদ্দ হয়।
এই প্রকল্পটি গিয়াসউদ্দিনের নামে বরাদ্দ হয়। প্রকল্পের সেক্রেটারি করা হয় তার ভাই শাহাবুদ্দিনকে। কিন্তু রাস্তা সংস্কারের জন্য বরাদ্দ সব চাল বিক্রি করে দিয়েছেন শাহাবুদ্দিন।
দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা
নির্বাচনে বিজয়ের পর থেকেই সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিন দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের ভুলে যেতে শুরু করেন। অভিযোগ রয়েছে- তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন অন্য দলের নেতাদের।
গত ১৯শে মার্চ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আলতাফ হোসেন গোলন্দাজের ছেলে ফুয়াদ গোলন্দাজ জগলুর সঙ্গে বিএনপি নেতা ইমাম খালিদ বিপ্লবের কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনা নিয়ে দু’গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়া হয় গফরগাঁও বাজারে। কিন্তু সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিনের নির্দেশে আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলকে আসামি করে মামলা করা হয়। উপজেলা নির্বাচনে সংসদ সদস্যের কথা না শুনে তার প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করায় এই মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান বাবেল। এছাড়া সংসদ সদস্যের নিজ ইউনিয়ন নিগুয়ারীর যুবলীগ সভাপতি তাইজউদ্দিন মৃধা, প্রভাষক করিম, রুবেল মাস্টার, ছাত্রলীগের নজরুল ইসলাম সংসদ সদস্যের মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে এলাকায় আসতে শুরু করেন ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। এলাকার নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রথম বৈঠকে তিনি বলেন, টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনে এনেছি। টাকা খরচ করে যেভাবেই হোক পাস করতে হবে। আর এখন বলছেন, মনোনয়ন কিনতে আর নির্বাচন করতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এসব খরচের টাকা তুলতে হবে।
আমি ব্যবসায়ী মানুষ। লাভ ছাড়া লসের ব্যবসা কখনও করি না।
সরকারি জায়গা দখল
নির্বাচনে বিজয়ের পর থেকে সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিন ও তার বাহিনীর সদস্যরা সরকারি জমি দখলের উৎসবে মেতে ওঠেন। উপজেলার রেলস্টেশনের গুদামঘর ও জিয়া পরিষদের অফিস দখল করে আওয়ামী লীগ অফিসের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। গিয়াসউদ্দিন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন এই অফিস।
এছাড়া সম্প্রতি সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি দখল করে উপজেলা আওয়ামী লীগ অফিস বানিয়েছেন তিনি নিজে। এই জমি সওজ বাংলো করার জন্য টেন্ডার হওয়ার পর ঠিকাদার ওয়ার্ক অর্ডার পায়। এরপর এই জমি দখল করা হয় এভাবে। ঘটনার পর সওজ বিভাগের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ মামলা নেয়নি।
সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিনের বক্তব্য
তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সংসদ সদস্য গিয়াসউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি সন্ত্রাসী নই, আমি কোন সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দিই না।
আমি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে গফরগাঁওয়ের চেহারা পাল্টে গেছে। গত ছয় মাসে আমি এলাকায় যে উন্নয়ন করেছি তা আর কখনও হয়নি। এলাকার উন্নয়নের জন্য প্রায় তিন শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। টিআর এবং কাবিখা’র চাল লুটপাটের বিষয়ে তিনি বলেন, কোন সমস্যা হয়নি। কাজ হয়েছে।
সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে মারধরের ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি মসজিদে নামাজ পড়তে যাবো সেজন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কলেজের গেট বন্ধ করে রেখেছিল। এ কারণে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। নিজেকে জিয়াউর রহমান হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে সেদিন বলেছি, আমাকে ফাঁসি দিয়েছিলেন, এখন আমি আওয়ামী লীগের এমপি। আমি এখন ডিজিটাল এমপি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।