আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বাস অবিশ্বাসে ভূত ও ভৌতিক - ( ষষ্ঠ অধ্যায় )



বড়মার সাথে শেষ দেখাঃ- ইন্দিরা ঠাকরুন কে মনে আছে ? অবিকল তাঁর মতো। মাথায় সাদা চুল পিছনে ঝুঁটি বাঁধা। ধপ ধপে সাদা থান আর হাতে সোনার চুড়ি । ডান হাতে লাঠি। বেশ কয়েক বার পড়ে গিয়ে কোমড়ে আঘাত পেয়েছিলেন।

তাই কূঁজো হয়ে গিয়েছিলেন। বয়স ও হয়েছিল অনেক। একটু ঈষৎ লম্বা সাদা সাদা দাঁত । মুখেছিল অতি নির্মল হাসি। আমি তো জন্ম থেকেই উনাকে ওইরকম ই দেখেছি।

উনি আমার নিজের বড়মা ছিলেন না । ছিলেন পাড়াতুতো বড়মা। উনাদের বাড়ীর সঙ্গে আমাদের বাড়ীর খুব নিবিড় সম্পর্ক ছিল। উনি আমাদের বাড়ী বেড়াতে আসতেন খুবই এবং যখন তখন। আমার বাবা, মা ও আমাদের দারুন স্নেহ করতেন ।

আমরাও খুব ভালোবাসতাম উনাকে। খুব ভালো ভালো গল্প শোনাতেন। রূপকথার গল্প। ঐ বয়েসে তাঁর গানের গলা ছিল দারুন। সে জন্য আমার খুব ফেবারিট ছিলেন উনি।

আবার ভালো রান্না ও আচাড় বানাতেন তিনি। বাটি করে এনে কত খাইয়েছেন আমাদের। আমি কিছু কিছু কাজও করে দিতাম - এই যেমন উনার মেয়েদের চিঠি লেখা - বিস্কুট-চানাচুর এনে দেওয়া এই সব আর কি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য আমায় একটা ফাউনটেন পেন উপহার কিনে দিয়েছিলেন । বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর শরীরটা ভালো যাচ্ছিলনা।

এরকম আগেও অনেকবার হয়েছে। সুস্থও হয়ে যেতেন তিনি। ১৯৮৯ এর মে'র এক দুপুর। আমাদের ঘরের উপরের দোতলায় আমি ঘুমাচ্ছি। ঘুমের মধ্যেই আমি দেখলাম বড়মা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন পরনে সেই ধপ ধপে সাদা থান , মাথায় সেই সাদা চুলের ঝুঁটি , কপালে চন্দনের টিপ ,হাতে লাঠি আর মুখে সেই নির্মল মিষ্টি হাসি।

হাসছেন তিনি হাসছেন । হাসতে হাসতে ছোট্ট করে ঘাড়টি নাড়িয়ে দিলেন তিনি। আমি ধরাম করে উঠে বসলাম। একি ! কই বড়মা ? এই মাত্র যে আমি দেখলাম তাঁকে । আমি ভয় পেয়ে ছাদে চলে এলাম।

দেখি আমার দিদি ও কাকীমা দৌড়তে দৌড়তে আসছে উঠান দিয়ে। আমি ও দৌড়ে নিচে গেলাম হাঁফাতে হাঁফাতে । মা ছিলেন নিচে। দিদি ও কাকীমার কাছে গিয়ে আমার মুখ থেকে কেমন যেন বেড়িয়ে গেল - " বড়মা মারা গেলেন বুঝি ?" দিদি ও্কাকীমা বলল - " তুই কি করে জানলি বড়মা মারা গেছেন ? আমি বল্লাম আমি ঘুমাচ্ছিলাম এই মাত্র দেখলাম বড়মা কে । আমার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন । মা, দিদি ও কাকীমা অবাক ! মা বল্লেন তোকে খুব ভালো বাসত - তাই চলে যাবার সময় তোর সাথে দেখা করে গেল যা তুই গিয়ে দেখে আয় বড়মা কে। আমি সজল নয়নে গিয়ে দেখি বড়মা শুয়ে আছেন চোখবুজ়ে। শান্ত-সমাহিতা । আমার কি বিরাট প্রাপ্তি ! প্রনাম করলাম বড়মা কে।

মনে মনে বললাম - তুমি আবার এসো আমার বড়মা হয়ে। শশ্মানঘাটেও গিয়েছিলাম আমি। আমার আজও মনে আছে সেই হাসি। স্নেহ-বাৎসল্য অমলিন সে এক হাসি। কোনদিন আর দেখিনি সে হাসি।

তাই আমি ভুলি নি। এ হাসি ভোলা যায় না। কোনদিনও না। খোকনদার কথাঃ- দাদারা কর্মসুত্রে বাইরে থাকার কারনে আমাকেই দিদিদের বাড়ী যাওয়া-আসা করতে হত খবরাখবর আনা নেওয়া ও বিভিন্ন পালপরবে নিমন্ত্রন রক্ষা করতে যেতে হত। সেই সুবাদে আমার দিদিদের শশ্বুর বাড়ীর সকলের সাথেই আমার ছিল নিবিড় পরিচয়।

আর ভালোবাসা খাতির-যত্ন পেতামও অঢেল। খোকনদা ছিলেন আমার এক দিদির ভাসুর । নিজে বিয়ে থা করেন নি। তাঁর শরীর ভালো ছিল না। আমাকে খুব স্নেহ করতেন।

আমি গেলেই আমাকে আর ছাড়তেন না। সারাদিন গল্প হত। তিনি নিজের কথা বলতেন, তিনিও অনেক বার ভুত দেখেছেন- সেই কাহিনীও শুনিয়েছেন আমায় বহুবার। আমি গেলেই আমার খাওয়া দাওয়ার উপর লক্ষ্য রাখতেন খুব। বাড়ী ফিরতে দিতে চাইতেন না।

এই কাল যাবে - আজ থাকো। আবার কাল গেলে বলতেন এই আজ যেও না - আজ থেকে যাও - কাল যাবে। আসলে উনি খুব খুশি হতেন আমি গেলে। শুধু আমি না আরও কেউ এলেই উনি এমন করতেন। খুব অমায়িক আর অথিতি বৎসল ছিলেন উনি।

মনটা ছিল জলের মতো স্বচ্ছ। শারিরীক কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। একদিন হটাৎ সকলকে কাঁদিয়ে তিনি বিদায় নিলেন এই পৃথিবী থেকে । খবরটা পাওয়া মাত্রই গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু শেষ দেখা আর দেখতে পাই নি।

তখন শশ্মান যাত্রীরা ফিরছেন। মনটা ভীষণ খারাপ হল আমার। কত ভালোবাসতেন আমায় কত স্নেহ করতেন আমায় - আমি তাঁকে শেষ দেখাও দেখতে পেলাম না। - বাড়ী ফিরে আমি আবার তাঁর পারলৌকিক কাজ়েগিয়েছিলাম । পারলৌকিক কাজ সেরে আমি চলে আসি দিদির বাড়ী থেকে।

আবার গিয়েছিলাম মাস দুই তিনেক বাদে। আমি গেলেই উপরের একটা ঘরে আমার শোবার জন্য বন্দোবস্ত করা হত। আমি আগেই বলেছি আমি নিরিবিলি থাকতে ভালোবাসি। তাই আমার একা শুতে ভালোলাগত। উপরের ঘরে সারাদিন বিভিন্ন তাত্ত্বিক বই - গল্পের বই পড়েই কাটিয়ে দিতাম।

রাত্রে আমি একাই শুতাম। সেদিন রাত্রেও আমি একাই শুয়ে আছি। মশারি ছিল খাটানো। টিউব লাইট নিভিয়ে জিরো পাওয়ারের ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। রাত তখন অনেকটা হবে - আচমকা আমার নাম ধরে কে ডাকল একবার - আমি ভুলকিছু শুনলাম ভেবে আমার নিদ্রামগ্ন হলাম দ্বিতীয় বার আমার নাম ধরে আবার কে ডাকল - আমি চোখ বুজেই ভাবছি দিদি বা জামাইবাবু এরা কেউ নন তো ? দরজা তো বন্ধ ।

কিছু বিপদ বা দরকার নয় তো ? দরজা খুলতে হবে , দেখতে হবে কেন ডাকছেন - এই ভেবে আমি চোখ খুলে ঊঠে বসেছি- দেখি খোকনদা সহাস্য মুখে দাঁড়িয়ে । মুখে ৪/৫ দিনের না কামানো দাড়ি। একি ! খোকন দা ? এখানে কি করে কিভাবে এলেন ? মশারি তুলে ভালোকরে দেখতে গিয়ে দেখি তিনি আর নেই। শিউরে উঠলাম আমি। উঠে লাইট জ্বেলে - ভালো করে দেখলাম কিছুই দেখতে পেলাম না আর।

জলের বোতল থেকে জল বের করে খেলাম। আমি সেই রাতে আর ঘুমাই নি। তখন তো এসব আমার কাছে নতুন নয়। আমি এসব আগেও দেখেছি। জেনেছি, অনুভব করেছি।

পরের দিন আমি এই ঘটনা দিদিদের সকল কেই বলি। সবাই বললেন তোকে ভালোবাসত খুব তাই তোকে দেখা দিল। পরে আমি অনেকবার দিদির বাড়ী গেছি - ওই উপরে একা শুয়েছি থেকেছি - আর কোন দিন তাঁকে দেখিনি। আজ তাঁর কথা লিখতে গিয়ে আমার চোখের জল এসে যাচ্ছে। এও সম্ভব ।

আজ আর কিছু লিখলাম না - সময় শেষ। পরের অন্য ঘটনা লিখব সময় করে। এখানেই আজ ইতি টানলাম। --- ভালো থাকুন সকলে। লেখাটি চলবে - " বিশ্বাস অবিশ্বাসে ভূত ও ভৌতিক " এই শিরোনামে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.