পুর্ব প্রকাশিতর পর -
এবার আসি সেই দিনের কথায় - যেদিন আমি সফল হয়েছিলাম প্ল্যানচেটে। বিশ্বাস করাতে ও দেখাতে পেরেছিলাম আমার দুই অবিশ্বাসী ভীতু বন্ধুকে। সেও এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আর এই প্ল্যানচেট করার পর থেকেই ঘটে চলেছিল একের পর এক আশ্চর্য আশ্চর্য ঘটনা। যা সবই আমি আপনাদের জানাব আমার এই লেখার মাধ্যমে।
আমি আমার এই নিজের জীবনের পুর্ণসত্য ঘটনাগুলি আপনাদের মতো পাঠকসমাজ দের জানাতে পারছি এই "সামহোয়ার ইন ব্লগের " দৌলতে বা কারনে । এখানে আমায় লেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি এই "সামহোয়ার ইন ব্লগ " কে আমার আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি । ধন্যবাদ জানাচ্ছি সুজন ব্লগপাঠক ও লেখকদের।
এবার সেই ঘটনার কথা বলি। তখন বি.কমের জন্য তৈরী হচ্ছি।
আমার বাড়ীতে থেকে দুই কলেজের বন্ধু পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য এসেছিল। তারা ছিল একমাস আমাদের বাড়ীতে। এখানে আমি আমার গ্রামের দুইবন্ধু আর ঐ কলেজের দুই বন্ধু মোট পাঁচ জন এক সংগে থেকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার ঐ দুই বন্ধু আমাদের বাড়ীতেই খাওয়া দাওয়া করত।
কিন্তু আমরা পড়াশুনা করতাম গ্রামের একবন্ধুর দাদার ফাঁকা বাড়ীতে।
বন্ধুর দাদা ও বৌদি থাকতেন কর্মসুত্রে বাইরে। সেই জন্য বন্ধুই ই বাড়ীটি দেখাশোনা করত। সেখানে আমরা পাঁচজনে বেশ খুব মনযোগ সহকারে পড়াশুনা করতাম। বিভিন্ন প্রবলেম যে যে বিষয়ে পারদর্শী সেই সমাধান করে বাকি সকলকে বুঝিয়ে দিত। এক একজন এক একবিষয়ের দ্বায়িত্বে ছিল।
এতে সহজেই বিভিন্ন ট্রপিক্সগুলি মগজস্থ হতো। আমরা বেশি রাত জেগেই পড়াশুনা করতাম। রাত ৩টে ৪টে হয়ে যেত কোন কোন দিন। টানা ২ ঘন্টা স্টাডি তারপর আধঘন্টা রিলাক্স। এই বাইরে বা ছাদে গিয়ে ধুমপান আর জোকস বা প্রেমের কাহিনী বা হালকা কোন বিষয় এই আর কি।
তারপর আবার ডুবে যেতাম পড়াশুনায়। এই ছিল জীবন।
আমার এই ভুত-আত্মা-প্ল্যানচেট ইত্যাদি সম্বন্ধে নিরন্তর স্টাডি বা গবেষণা
সম্পর্কে তখন অনেকেই জেনে গেছেন। এরজন্য বাড়ীতেও বকাঝকা খেয়েছি খুব।
একদিন কি হলো - গ্রামের বন্ধু গিরীশ ছিল খুব ভীতু আর সোনাতন ছিল এইসব ব্যাপারে খুব অবিশ্বাসী।
আর কলেজের বন্ধু তন্ময় আর দেবপ্রকাশ এদেরও ছিল কৌতুহল। সকালে সবাই আলোচনা করলাম যে আজ আমরা রাতে প্ল্যানচেট করব। তো ঠিক আছে আমরা সবাই মনে মনে তৈরীও হয়ে গেলাম। আমি ওদের জানিয়ে দিলাম কি কি করতে হবে । কি কি লাগবে ।
কি ভাবে সকলকে থাকতে হবে। আর বেছে নিলাম কে মিডিয়াম হবে।
তন্ময় কে মিডিয়াম হিসাবে বেছেনিয়েছিলাম। দর্শক হিসাবে থাকবে - সোনাতন আর গীরিশ । আর হেল্পার হিসাবে থাকবে দেবপ্রকাশ।
সবাই কে বললাম যে আজ নিরামিষ খেতে হবে। শুদ্ধ কাপড় পড়ে আসতে হবে। আর ঘরটি ধুপ ও গংগাজল দিয়ে আগে থেকে প্রবিত্র করে রাখতে হবে।
এই সব আচার মানা হয় কেন ? বলি - এতে মন শুদ্ধ থাকে। মনে একাগ্রতা থাকে।
তাই ধ্যানের জন্য মনেও সহজেই একাগ্রতা চলে আসে।
ধুপের গন্ধে মনে আধ্যাত্মিক ভাব আসে। ধ্যান করার জন্য যা অতি প্রয়োজনীয় । নিরামিষ খাওয়ার কারণ দেহ যাতে কোন ভাবেই উত্তেজিত না থাকে। আবার মন কেও শুদ্ধ রাখা যায়।
সারাদিন কেটে গেল এক নিদারুন উত্তেজনা আর চাপা শঙ্কায়। কখন সন্ধ্যা হবে - কখন রাত্রি হবে। কি হ্য় কি হয় এই আর কি। কাউকে বলা ছিল কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। যদি বকা খেয়ে সব পন্ড হয় তার জন্য।
আমরা বাড়ীতে রাত নয়টার মধ্যে খেয়ে চলে এলাম আমাদের পড়াশুনার ঘরে।
সোনাতন আর গিরীশ ও চলে এলো তারাতারি। এসে আমরা আবার ঘরটি কে পরিস্কার করলাম- গঙ্গাজল ছিটিয়ে - ধুপ জ্বেলে জানালা দরজা বন্ধ করে সবাই ছাদে চলে গেলাম। ছাদে এসে আলোচনা করেনিলাম কার আত্মা কে আনব। যাকে সিলেক্ট করলাম সে আমাদের ই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
নাম ছিল প্রশান্ত।
দশম শ্রেণী তে সে এসে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। আমার সাথে তার ঘনিষ্ঠতাও ছিল দারুন। আমরা এক সঙ্গে থাকতাম -খুব গানের লড়াই করতাম। ও ভালো গাইতে পারতো।
খুব ইয়ার্কি করতাম দুজনে। বড়োলোক বাড়ীর এক মাত্র ছেলেছিল প্রশান্ত । ক্লাশ ইলেভেন কমার্সে কলেজে পড়ার সময় সে ব্যক্তিগত জীবনে কোন দুঃখ পেয়ে সিলিং ফ্যানে রশি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করে। তন্ময় ও দেবের সাথে আগেই পরিচয় ছিল। যদিও তন্ময় ও দেব আমাদের স্কুলে পড়েনি।
সুতরাং আত্মা সকলেরই পরিচিত। যদিও দর্শক হিসাবে যারা থাকেন তাদের ক্ষেত্রে আত্মা কে জানা না জানার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু যারা চক্রে থাকবেন তাদের চিনতেই হবে। আমরা সবাই তাকে সিলেক্ট করেনিলাম। আর চলে গেলাম অন্য দিকে।
হাসি মস্করা ইয়ার্কি করে মন থেকে ভয়, দুর্বলতা দূর করছি আর কি। চারিদিকে গভীর অন্ধকার। পুকুরের পাড়ে বড়ো বড়ো গাছ গুলিকে মনে হচ্ছে ভয়ংকর দৈত্য। এখানে ওখানে টিপ টিপ করে জ্বলছে জোনাকী। কি মায়াবী অন্ধকার - আর কি নিঃস্তব্ধ রাত।
নেই কোন কলরব । বিস্তৃর্ণ গ্রাম মায়াবী ঘুমে অচেতন। নিজেদের মনে হচ্ছিল যেন আজ জীবনের শেষ রাত। মনে হচ্ছিল অপেক্ষারত পাঁচ আসামী - মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত। প্রতীক্ষারত মৃত্যুর জন্য !!!! কেউ আর কারোর সাথে কথা বলছি না।
সবাই চুপচাপ। গভীর রাতে এক পেঁচার চিৎকারে খান খান হয়ে গেল রাতের নিঃস্তব্ধতা । টর্চ জ্বেলে দেখি ঘড়িতে একটা বাজে। নিমেষে বুকের হৃদপিন্ডের ধক ধকানি শুনতে পেলাম। সেকি কোন শংকার না উত্তেজনার - জানি না ।
সবাই নিচে নেমে এলাম। ঘরের দরজা খুলে দিয়ে প্রবেশ করলাম সবাই। একটা মোমবাতি জ্বেলে দরজা ভেজিয়ে দিলাম। দুটি জানালার একটি লাগিয়ে দিয়ে একটি হালকা ভেজিয়ে রাখলাম। তারপর চক্র এঁকে ধুপ জ্বালালাম।
চক্রের মাঝে রাখলাম ধাতব মুদ্রা । সোনাতন আর গিরীশ কিছুটা দূরে বসে পড়লো । আমি দেব আর তন্ময় চক্রে বসলাম। আমি আর তন্ময় মুখোমুখি। তন্ময় কে বল্লাম ধাতব মুদ্রাটিকে ডান হাতের তর্জনি দিয়ে ছুঁয়ে থাকতে।
এবার আমি বল্লাম শুরু করছি। তন্ময় কে বল্লাম এক মনে প্রশান্ত কে স্মরণ করতে। দুজনেই স্মরণ করতে শুরু করে দিলাম। মনে পড়ছে হাল্কা চেহারার কোঁকড়ানো চুলের প্রশান্ত কে। জ্বল জ্বল করছে প্রশান্তর মুখখানি।
মনে মনে তাকে আমন্ত্রন জানাচ্ছি। বেশিক্ষণ হয় নি। হটাৎ ভেজানো জানালা খুলে ঘরে ঢুকলো দমকা হাওয়া। মোমবাতির শিখা নিভু নিভু। ঠান্ডা হাওয়া গর্জন করতে করতে ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।
শোনাগেল ধুপ ধাপ আওয়াজ। কে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে ঘরের মধ্যে। দেওয়ালের তাক থেকে বই-খাতা পড়ে গেল। দেখি গিরীশ আর সোনাতন ঘরের এক কোণে জড়াজড়ি করে সেঁটে আছে। হটাৎ দেখি তন্ময় গোঁ গোঁ করতে করতে মাটিতে পড়ে গেল।
শুরু করেদিল নাকি কান্না।
- আঁ আঁ আঁ আঁমায় ছেঁড়েদে... তোরা আঁমায় ছেঁড়ে দে.........। আমি ভয় মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম... কে তুমি ? তোমার নাম বলো ?
সে কাঁদতে কাঁদতেই বলল - আঁমায় ছেঁড়েদে... তোরা আঁমায় ছেঁড়ে দে.........। আমি কিছুতেই ছাড়বো না আগে তোমার নাম বলো। কিছুতেই বলতে চাইছিল না।
অনেক বার জিজ্ঞাসা করে করে শেষে বলল - " আমি প্রশান্ত " - চমকে উঠলাম আমি ! এই তো আমি তো তোকেই চাইছি। মনে মনে একটু সাহসও বেড়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম - প্রশান্ত কেমন আছিস তুই ? আমাকে চিনিস তুই ?
উত্তর দিল - আমি ভালো নেই । প্রচণ্ড জ্বালাযন্ত্রনায় ভুগছি। তোকে চিনব না সে কি রে ।
তুই তো সুমন ।
আমি বল্লাম - বলতো তোর সাথে কবে কোথায় পরিচয় ?
প্রশান্তঃ আমি তোদের স্কুলে ক্লাশ টেন এ ভর্তি হয়েছিলাম । সেখানেই তো তোর সাথে পরিচয়। তুই কেমন আছিস ?
আমিঃ তোকে ছেড়ে আমাদের বড়োই কষ্ট হচ্চে রে প্রশান্ত। তুই কেন এ সব করতে গেলি ? তোর মরার কারণ কি ?
প্রশান্তঃ জানিস না ? আমি কেন মরেছি ? আমাকে তো ঐ মারলো।
তোরা শুনিস নি?
আমিঃ না রে আমরা কিছুই শুনি নি । জানতাম না । তোর মরার খবর টা পেলাম সেদিন। খুব কষ্ট হচ্ছিল রে। কেন তুই এসব করতে গেলি ।
আগে আমাদের তো কিছু বলতে পারতিস ।
প্রশান্তঃ আমি পারিনি রে । আমি পারি নি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রে । আমায় এবার ছেড়ে দে ।
প্রশান্তর কথা শুনে নিজেরও খুব মায়া হল। সেদিন আর বেশি কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি নি। দেবপ্রকাশের কথায় আমি ছেড়ে দিলাম প্রশান্ত কে। বললাম প্রশান্ত তুই আয়। যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।
তোর আত্মার শান্তি হোক শীঘ্র।
তারপর আমি তন্ময়ের কাছে থেকে ধাতব মুদ্রাটি কেড়েনিলাম। তাও খুব সহজে নয়।
ঘরের মধ্যে যেভাবে পাগলা হাওয়া টা এসেছিল ঠিক সেই ভাবেই জানালা দিয়ে হাওয়া টা চলেগেল । তন্ময় কে দেখলাম ধরাস করে মাটিতে আছার খেয়ে পড়ে যেতে।
সবাই মিলে উঠে তাকে শুশ্রূষা করতে লাগলাম। সে কি কাঠিন্য তার শরীরে। ভাঁজ হয়ে থাকা হাত পা কোনভাবেই সোজা করা যায় না। আমরা চারটে যোয়ান ছেলে কোনভাবেই তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত খুলতে পারছি না। ধীরে ধীরে চোখে মুখে জল দিয়ে সে স্বাভাবিক অবস্থায় এল।
উঠে বসে জল খেল। সারাশরীর ঘামে ভিজে গেছে।
উঠে বসে অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল কি রে তোরা আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে আছিস কেন? আঃ আমার শরীরে এত ব্যাথা কেন ? সারা গায়ে জল কেন ?
আমরা সেদিন রাতে তাকে আর কিছুই বলি নি। বল্লাম তুই ঘুমিয়ে গেছিলি। আমরা তো পড়ছিলাম।
.........এবার চল ছাদে গিয়ে একটু হাওয়া খেয়ে আসি। ছাদে গিয়ে আমরা সবাই আলাদা আলাদা স্থানে বসে পড়লাম। চিন্তা করতে লাগলাম ----- এ কি হলো। আমার আনন্দ লাগল --- আমি পেরেছি............ আমি সফল হয়েছি।
সেদিন বাকি রাত্রি কেউ আর আমরা ঘুমাতে পারি নি।
পরে গিরীশ ও সোনাতন এই ঘটনার কথা গ্রামের সকলকে বলে দিয়েছিল। এখনও গিরীশ সেই রাত্রের কথা বলে দেখা হলেই।
--- এই প্ল্যানচেট করার পর থেকেই শুরু হয়েছিল অস্বাভাবিক সব ঘটনা। সেগুলি পরের অংশে বলব।
জানাবো ভুত বা আত্মা কি ? এরা কি করে ? কোথায় থাকে ? সবিস্তার।
ধৈর্য রাখবেন দয়াকরে।
আশ্চর্য আর এক প্রশান্ত যেদিন মারা যায় সেদিন আমি ছিলাম বাড়ীর বাইরে। যেখানে দাঁড়িয়ে খবরটা শুনলাম সেখানেই এক বাড়ীর রেডিও থেকে ভেসে আসছিল সেই গান টা যেটা আমি প্রশান্তকে নিয়ে খুবই গাইতাম " গুন গুন করে মন ভ্রমরা যে ঐ - তবুও এই আমি তোমার-ই কি নই " - এ ও বড়ো অদ্ভুত ঘটনা। এই গানটি শুনলে আমার সেই দিনের কথা আজও মনে পড়ে আর ব্যাথা পাই।
- প্রশান্ত'র আত্মার শান্তি কামনা করে আজ এখানেই শেষ করলাম।
ভালো থাকবেন সকলে ।
- এই লেখাটি চলবে " বিশ্বাস অবিশ্বাসে ভূত ও ভৌতিক " এই শিরোনামে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।