কৃষ্ণশুভ্রারা বেঁচে থাকুক দূরে সুদূর স্বপ্নসীমান্তে
এই পোস্ট টি লিখতে গিয়ে কিছুটা দুঃসাহস আর অনেকটা অনধিকার চর্চা হলেও নিজের ভাবনা প্রকাশ করার তাগিদে লিখতে বসলাম। আমার প্রথম কথাটা শুনে যদি কেউ চমকে উঠেন তার জন্য আমার কথার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে আমি বাধ্য। অতএব প্রথমে বিচ্ছিন্ন কিছু গল্প শোনা যাক।
১.
ঘটনার অকুস্থল বুয়েট মাঠ , আর যাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের একজন ওপেনার। আমরা বুয়েট মাঠে হকি খেলায় ব্যস্ত আর একপ্রান্তে তিনি নিবিড় অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন স্কয়ার কাটের।
এতে সমস্যা ছিল না সমস্যা হলো তাকে দেখে আমাদের পোলাপানের মাঝে হঠাৎ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ায়। তার দিকে উদ্দেশ্য করে কটু কথা আর সেটা নিয়ে বাদানুবাদ বেশ কঠিন দিকেই চলে যেত শুধু আমরা ভার্সিটির ছাত্র বলেই নাকি তিনি রাগ করেননি শুধু একটু অভিমান করেছেন। ঘটনা শান্ত হয়ে গেছে এমন ভাবনায় আবিষ্ট হয়ে একজন খুব নির্দোষ মুখে তাকে ক্রিকেটীয় এক প্রশ্ন করে ফেলল যেটা অবশ্যম্ভাবী। ” ভাই আপনি এতো স্লো খেলেন ক্যান?” কথাটা শেষ হবার আগেই সেই ক্রিকেটীয় প্রশ্নের অক্রিকেটীয় উত্তর জুটল। ” কে স্লো খেলে কে ফাস্ট খেলে তা দেখার দায়িত্ব আপনাদের না।
”
২.
এই ঘটনা আমি শুনেছি বুয়েটের হলের জুনিয়র শরীফ এর কাছে। সে চাকুরির খাতিরে একবার খুলনায় যায়। সেখানে দেখা মিলে পাকিস্তান আমলে টেস্ট খেলা একজন সাবেক ক্রিকেটারের সাথে। শরীফ খেলাধূলা খুব ভালোবাসে। তাই সে তার সাথে ক্রিকেটীয় আলোচনায় মেতে উঠে।
এখানে ঘটনা শেষ হয়ে গেলে কারো কোনো আপত্তি থাকতো না। কিন্তু সেই স্বনামখ্যাত ক্রিকেটারের সাথে শরীফের মতের মিল না হওয়াতেই যত গোল পেকে গেলো। কোন এক খেলোয়াড় যাকে শরীফের কাছে ভালো বলে মনে হয়নি তাকে তিনি ওয়ার্ল্ড ক্লাশ অলরাউন্ডার বলে বসলেন। শরীফ একটু পিন করেই বলল, ঠিক আছি আমরা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব সে কেমন ওয়ার্ল্ড ক্লাশ প্লেয়ার। ব্যাস।
আর যায় কোথায়। পরের কিছুক্ষণ ভদ্রলোক নিজের মাতৃভাষটা ভুলে গেলেন। চিৎকার করতে লাগলেন, হু দ্যা হেল আর ইউ টু অবজার্ভ? উই নো হোয়াট ইজ ক্রিকেট উই নো হোয়াট টু ডু? ইউ আর নান হেয়ার টু সে এনি থিংক………….
উপরের ঘটনাগুলো মোটেই কাল্পনিক নয়। আর তার সাথে যোগ করুন সাধারণ মানুষকে জবাব দেয়ার কথা বলে চিৎকার করা আমাদের ক্রিকেটারদের প্রতিক্রিয়া আর মাঝে মাঝেই প্রকাশিত হওয়া সাক্ষাতকারে আমাদের সম্পর্কে ক্রিকেটারদের মনোভাব। আসলেই আমরা কেউ নই? পনেরো বছর কিংবা তরো বেশি সময় ধরে বয়ে চলা আবেগ কি তাহলে কিছুই না।
কৈশোর শৈশবের আড্ডার বড় অংশে জুড়ে থাকা এই স্বপ্ন গুলো কি কিছুই নয়? হবে হয়তো বা। তারা দেশপ্রেমিক জাতীয় বীর। আমরা কারা? ভাবনাটা খুব বেশি করে পোড়ালো। তাহলে এবার কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলি। আমাদের আবেগের জোর ঐ উদ্ধত আশরাফুলের ব্যাটের চেয়ে কিংবা বোদ্ধা রকিবুলের নির্বোধ ভাবনার চেয়ে কিংবা ফাপড়বাজ ক্রীড়া সাংবাদিকদের চাইতে অনেক বেশি।
আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস এসেছে কি শুধু আকরাম বুলবুলদের ব্যাটেই তার সাথে ১৫ কোটি মানুষের আবেগ ক্রিকেট নিয়ে উম্মাদনার কোন ভূমিকা ছিল না। শুনুন আশরাফুল এন্ড কোং , আপনারা সরকারী খরচে বছরের পর বছর বিশ্ব ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন সেটা আমাদের আবেগেই। অথচ আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে আমাদের মাথা হেট করলে আপনাদের কিছু আমরা বলতে পারবো না তাহলে ক্ষেপে যাবেন আবার বাই চান্স ভালো করে ফেললে আমাদের দিকে দাঁত খিঁচিয়ে হুঙ্কার দিবেন তাও তো আমরা সহ্য করি কিন্তু আপনারা দেখি অস্পৃশ্য। আর আপনাদের কে তারকা কে বানিয়েছে ? কাদের জন্য আপনাদের এত বেতন ? এই প্রশ্ন গুলো ভেবেছেন কী?
একটু বেশি রেগে গিয়েই কথাটা বললাম। জানি কখনো তারা আমার কথা শুনতে পাবেন না।
আমার পরের কথাগুলোও নিশ্চয় শুনতে পাবেন না। তারপরেও আমার নিজস্ব কিছু ভাবনা প্রকাশ করা দরকার বলে মনে করছি।
আমাদের দেশের ক্রিকেট টা একটা অদ্ভুত অবস্থা নিয়েছে। কখনো তা সম্ভাবনা কখনো তা সমস্যা। এর মূল শিকড় কোথায় গ্রথিত আছে তা প্রথম আলোর উটু সাহেব (উৎপল শুভ্র) খুব ভালো করে বলে ফেলেছেন।
যদিও তার কথায় লোকে আমল দেবে না বলে আইসিসি সভাপতির মুখ দিয়েই কথাটি বের করিয়েছেন (সত্যতা নিয়ে সন্দিহান)। সেটা হলো আমাদের টিম সিলেকশনে রাজনীতি হয়। এই কথাটা আমরা হয়তো বুঝবো না সেভাবে কিংবা রাজনীতি কতটা হয় সেটা হঠাৎ বুঝা যাবে না শুধু এটুকু তথ্যই যথেষ্ট যে সরকার পরিবর্তন হলে ক্রকেট বোর্ডের কর্তারা বদল হন। ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় কিভাবে আমার পরিষ্কার জানা না থাকলেও সেটা যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বোর্ড বদলে বদলে যায় নির্বাচক।
আর এর ফল তো দল নির্বাচনে পড়তে বাধ্য।
তারপরে আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের তরুণ সম্ভাবনাময় দল থাকা- ব্যাপারটা অস্বস্তির এবং বিরক্তিরও। ঠোঁটের উপরে গোফের রেখা গজায় নি এমন দু তিন জনের প্রতিবছর টেস্ট ডেব্যু হয়। বিষয়টা একটা জিনিস পরিষ্কার করে সেটা হলো মূল দলে স্ট্যাবলিটির অভাব। সারা বিশ্ব জুড়ে পদ্ধতি হলো বয়স ভিত্তিক দলগুলো থেকে এ দলে খেলবে ।
সেখানে নিয়মিত পারফর্ম করার পর জাতীয় দলে সুযোগ পাবে। কিন্তু আমাদের এ দল বলে কাগজে কলমে কিছু থাকলেও বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ফলে অনেক কাঁচা বয়সে আমাদের ছেলেগুলো আন্তর্জাতিক লেভেলে ঢুকে পড়ছে অনেকটা পোনা মাছকে পুকুর থেকে নদীতে ফেলে দেয়ার মতো। এই সেদিন আশরাফুল বললো, “আমার বয়স পঁচিশ। অন্যান্য দেশে এই বয়সে একজন প্লেয়ারের ডেব্যু হয়।
সে হিসাবে আমার ক্যারিয়ার সবে শুরু। এতদিন বোনাস খেলেছি”। দলের একজন অন্যতম মূল খেলোয়াড় যদি নয় বছর খেলে বলে বোনাস খেলেছি তাহলে হাসবো না কাঁদবো বুঝে পাই না। এখন কথা হচ্ছে এদেরকে বোনাস খেলতে দেয়া হলো কেন? উত্তর খুব সোজা । আমাদের অতি উচ্চাশা মিডিয়ার অকারণ ফালাফালি আর দলের উপর মিডিয়ার প্রভাব।
আমাদের মূল সমস্যা একটা জেনারেশন গ্যাপ। সেটার কারণ হচ্ছে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর দুর্জয়কে অধিনায়কত্ব দেয়ার (খুব সম্ভবত রাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে) মাধ্যমে বুলবুল আতাহার নান্নু আকরামদের যাবার পট তৈরি হয়ে যায়। আতাহার আগেই গেছিলেন। নান্নু টেস্ট খেলার সুযোগই পেলেন না আর বুলবুল আকরাম তাদের জনপ্রিয়তার জোরে কিছুদিন টিকলেও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারলেন না। এখানে যে গোড়ায় গলদ হলো টার ঘানি আমাদের দলকে টানতে হচ্ছে দুষ্ট চক্রে পড়ে।
বুলবুল আকরামরা অপি রোকনদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলেন। কিন্তু অপি রোকনরা পারলেন সে চাপ সামলাতে অনভিজ্ঞতার কারণেই। ফল দুর্জয় রোকন অপিরা প্রতিস্থাপিত হলেন এবার আরো আন্দা বাচ্চাদের দিয়ে। এই চক্র ক্রমাগত চলে আমাদের টিম এর স্ট্যাবিলিটিকে প্রায় শূন্যে নিয়ে এল।
আউট সাইড ক্রিকেট আরো কিছু ব্যাপার যোগ হলো তার সাথে।
সেটা হলো মিডিয়ার মাতামাতি। আমাদের দেশের তরুণ খেলোয়াড় রা যথেষ্ট ভালো তাতে সন্দেহ নাই কিন্তু সেটা ঐ বয়স লেভেলেই। আমরা ভুলে যাই বাছুরদের মাঝে চ্যাম্পিয়ন বাছুরকে হুট করে গরুর সাথে যুদ্ধে নামিয়ে দিলে বেশিরভাগ সময় হারবে। আর আমরা এটাও বুঝতে চাই না সেই রকম যুদ্ধে মাঝে মাঝে বাছুর ঝলক দেখিয়ে জিতে যেতেও পারে। তার মানে এই নয় আমরা সব গরু জবাই করে শুধু বাছুর দিয়ে ষাঁড়ের সাথে লড়াই করাবো।
এটা আমরা যদিও কোনবার ভাবার চেষ্টা করি সেটাকে একেবারে রুদ্ধ করে দেয়ার দায়িত্ব মিডিয়ার। তারা বাছুরের মহিমা বর্ণনা করে আমাদের সাধারণের চর্ম চক্ষুকে অন্ধ করে দেয়। মিডিয়ার মাতামাতির অবশ্যম্ভাবী ফল হলো ক্রিকেটারদের মাঝে আত্মম্ভরিতা জাগিয়ে তোলা নিজেকে বিশেষ কিছু মনে করে শেখার আগ্রহকে একেবারে গলা টিপে হত্যা করা।
এত সমস্যার কথা বলছি। সমাধান জানতে চান? সমাধান হলো আমাদের ক্রিকেটে ফুটবলের সালাউদ্দিন ভাইয়ের মত সৎ দক্ষ বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা একজন সংগঠক দরকার।
আর মূল খেলোয়াড়দের উন্নতির পাশাপাশি একটি সুন্দর কাঠামোবদ্ধ প্যাটর্নে শক্তিসাহালী রিজার্ভ টিম গঠন। আর হ্যা সবকিছুর শেষে সাংবাদিকদের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ করা। নতুবা উটুর মত সাম্বাদিকদের সাহিত্য রচনার আতিশয্যে আমাদের ক্রিকেটাদের আর রেকর্ডের পাতায় দেখা যাবে না বরং কোন এক সাংবাদিকের দিনলিপির পাতাতেই তারা আটকে যাবেন
( গতকাল বাংলাদেশ জিতায় মন বেশ ভালো। গতকালকের খেলায় কিছুটা ম্যাচুউরিটি দেখাইলেও আশরাফুল আর সাকিবের চরম আনপ্রফেশনাল দুটো শট কিছুতেই ভুলতে পারছি না। তারপরেও শুভকামনা।
গুড লাক বাংলাদেশ)।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।